ভারতীয় অর্থনীতির নৌকা প্রবল গতিতে এগিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্থান দখল করতে চলেছে বলে প্রধানমন্ত্রী যত প্রচারই করুন, নানা সমীক্ষায় মাঝে মাঝেই সামনে এসে যাচ্ছে যে সেই নৌকার তলা আসলে ফেঁসে রয়েছে। ঠিক যেমন, ব্লুম ভেঞ্চার নামে একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থার সাম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে, ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে, ১০০ কোটি মানুষের কাছেই নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসটুকু কেনার পর ইচ্ছেমতো খরচ করার সামান্য পয়সাটুকুও থাকে না। এর মানে, দেশের প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষেরই পকেট ফাঁকা! প্রধানমন্ত্রীজি, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ কেমন চেহারা!
ব্লুম ভেঞ্চারের এই রিপোর্টে আবারও সামনে এসেছে ভারতীয় অর্থনীতির প্রবল বৈষম্যের ছবি। পরিসংখ্যান দিয়ে সেখানে দেখানো হয়েছে, এ দেশে সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা বাস্তবে সে ভাবে বাড়ছে না। যা বাড়ছে তা হল, ইতিমধ্যেই যারা অতিধনী, তাদের সম্পদের পরিমাণ। অর্থাৎ মানুষে মানুষে আর্থিক বৈষম্য আরও তীব্র হচ্ছে।
সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, সাধারণ মানুষ যে সব ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করে, তার চাহিদা বাড়ছে না। কারণ সহজবোধ্য– সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই দু’বেলার খাবার আর বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু না হলেই নয় সেটুকু কেনার খরচ জোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছেন। ফলে কোপ পড়ছে সাবান, শ্যাম্পু এমনকি বিস্কুটের মতো পণ্যের কেনাকাটাতেও। অন্য দিকে ব্যবসা বাড়ছে বড় কোম্পানির তৈরি ব্র্যান্ডেড পণ্যের। বিলাসবহুল বাড়ি, দামি ফোন ইত্যাদির বাজার বাড়ছে, অথচ বিক্রি কমছে মাঝারি থেকে কম দামের ফ্ল্যাটবাড়ি সহ সাধারণ জিনিসপত্রের। অর্থনীতিবিদদের পরিভাষায় অর্থনীতির বিকাশের চেহারা ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের আকার নিচ্ছে, যার একটা বাহু ক্রমাগত উপরের দিকে ওঠে, আর একটা বাহু নেমে যায় নিচের দিকে। অর্থাৎ ভারতে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে আরও দারিদ্রের অতলে, আর ধনীরা হয়ে উঠছে আরও ধনী। ১৯৯০ সালে ভারতের মোট জাতীয় আয়ের ৩৪ শতাংশ ছিল ১০ শতাংশ অতিধনীর হাতে। বাড়তে বাড়তে তা এখন হয়েছে ৫৭.৭ শতাংশ। ওই সময়ে নিচের তলার ৫০ শতাংশ ভারতীয়ের দখলে ছিল মোট জাতীয় আয়ের ২২.২ শতাংশ, কমতে কমতে যা এখন পৌঁছেছে ১৫ শতাংশে। দেশের বিরাট অংশের মানুষের শুধু কেনার ক্ষমতা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ কমার সাথে সাথে বাড়ছে টাকা ধার করার প্রবণতাও। কেন এমন হচ্ছে, তার উত্তর রাষ্ট্র পরিচালক, অর্থনীতির নীতি-নির্ধারকরা সহ সাধারণ মানুষের একটা অংশেরও এখন জানা। এর মূল কারণ, পুঁজিপতি শ্রেণির তীব্র শোষণের পরিণামে অর্থনীতিতে কার্যকরী চাহিদা কমে যাওয়া– অর্থাৎ প্রয়োজনীয় রোজগার না থাকার কারণে বেশিরভাগ মানুষের হাতে কেনাকাটার মতো টাকাপয়সা না থাকা। মানুষের হাতে টাকা নেই কেন? ভয়াবহ বেকার সমস্যা, ছাঁটাই, লে-অফ, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি চালু সংস্থাগুলিতে কম শ্রমিক নিয়োগ করে অতিরিক্ত যন্ত্র-নির্ভরতা এর প্রধান কারণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর ব্যবহার এই বিপদের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
দেশের সরকার ও নীতি-নির্ধারকরা এ-ও জানেন যে, অতি-মুনাফার তীব্র লালসায় পরিচালিত চলমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। শোষণমূলক এই ব্যবস্থার নিয়মেই শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষকে লুঠ করে ধনী ক্রমে অতিধনী হয়, আর দেশে বাড়তে থাকে ক্রয়ক্ষমতাহীন নিঃস্ব সর্বস্বহারা মানুষের সংখ্যা।
সরকারগুলি একচেটিয়া পুঁজির একনিষ্ঠ সেবক হিসাবে এ ভাবেই জনগণের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুকেও পুঁজিপতিদের স্বার্থের কাছে বলি দিচ্ছে। তাই এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটেও কাজের সুযোগ তৈরি করে জনসাধারণের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা দেখা গেল না। বরং ব্যক্তিগত আয়করের সীমা বাড়িয়ে দেশের ধনী অংশের মানুষের হাতেই আরও টাকা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করল নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার। এ দিকে একশো দিনের কাজ প্রকল্প, যা দেশের বড় অংশের গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থানে খানিকটা হলেও সাহায্য করে, সেখানেও বরাদ্দের পরিমাণ একই রাখা হল।
এই অবস্থায় জনস্বার্থবিরোধী এই সরকারকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধ্য না করতে পারলে জীবনে আরও আঁধার ঘনিয়ে আসবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের। ফলে, সঠিক নেতৃত্বে জোট বেঁধে কর্মসংস্থানের দাবিতে, ছাঁটাই বন্ধে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেই আন্দোলনের পথ ধরেই শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে, না হলে এই বৈষম্যের অবসান ঘটবে না।