সমালোচনার মুখ বন্ধ করতেই সংবাদমাধ্যমের উপর হামলা

ইউএপিএ আইনে প্রায় সাত মাস জেলবন্দি থাকার পর সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ছাড়া পেলেন নিউজক্লিক সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, তাঁকে দিল্লি পুলিশ যে ভাবে গ্রেফতার কর়েছিল তা শুধু আইন মেনে হয়নি তাই নয়, গোটা প্রক্রিয়াটির মধ্যেই আইনকে ধোঁকা দেওয়ার একটা পরিকল্পিত চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। প্রবীরবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল– বিদেশের টাকায় ভারত বিরোধী প্রচার চালানো, গোষ্ঠীসংঘর্ষকে মদত দেওয়া– যার কোনওটির পক্ষেই পুলিশ উপযুক্ত প্রমাণ দিতে পারেনি।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, তা হলে পুলিশ তড়িঘড়ি ওই সাংবাদিককে গ্রেফতার করে একেবারে ইউএপিএ-র মতো একটা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কঠোর আইন জুড়ে দিল কেন? এমনকি তাঁকে যে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তা লিখিত ভাবে তাঁকে জানানোর নিয়মও লঙ্ঘন করা হল কেন? এ প্রশ্নও উঠছে যে, এ কি শুধুই পুলিশের কীর্তি? এতখানি ঔদ্ধত্য কি শুধু পুলিশের হতে পারে যে, একটি সংবাদমাধ্যমের অফিসে এবং তার সাংবাদিক ও কর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে তাঁদের মোবাইল, ল্যাপটপ ও অন্যান্য নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করছে তারা? ইউএপিএ আইনে জেলে ভরছে তাঁদের? নাকি এটি আরও বড় পরিকল্পনার অঙ্গ? দিল্লি পুলিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অঙ্গুলিহেলন ছাড়া এমন কাজ কি সম্ভব?

শুধু তো নিউজক্লিকই নয়, গোটা সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে বিজেপি সরকারের মনোভাব আজ কারও অজানা নয়। মোদি শাসনে সরকারের কাজের সমালোচনা মানে রাষ্ট্রবিরোধিতা। শুধু সরকারের বা মন্ত্রীদের সমালোচনা নয়, এমনকি মোদি ঘনিষ্ঠ ধনকুবেরদের অবাধ লুঠপাটের সমালোচনা করলেও একই রকম ভাবে তা দেশদ্রোহিতা হিসাবে গণ্য করা হয়। হয় তাকে সরকারপন্থী ‘গোদি মিডিয়া’ হতে হবে, না হলে সরকারি হামলার মুখোমুখি হতে হবে, রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা দিয়ে জেলে ভরে দেওয়া হবে। এর উদাহরণ তো কম নয়।

কিন্তু গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে পরিচিত সংবাদমাধ্যমের উপর মোদি সরকার এত খড়গহস্ত কেন? কোনও একটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র কতখানি মুক্ত ও অবাধ তা বিচার হয় সেখানে সংবাদমাধ্যম কতখানি স্বাধীন তা দিয়ে। রাষ্ট্র এবং সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যা যা ঘটছে তা জনসাধারণকে অবগত রাখাই স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কাজ এবং গণতন্ত্রের পক্ষেও তা বিশেষ প্রয়োজনীয়। তা হলে যে বুর্জোয়ারা একদিন সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেই বুর্জোয়াদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসেবে মোদি সরকার কেন আজ তার কণ্ঠরোধ করছে? কেন আজ ইডি, সিবিআই, পুলিশ বারে বারে হানা দিচ্ছে একের পর এক সংবাদমাধ্যমের দফতরে?

এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশের স্তর অতিক্রম করে অন্তিম স্তরে পৌঁছনোর ইতিহাসটি। পুঁজিবাদ তার বিকাশের স্তর অতিক্রম করে সাম্রাজ্যবাদে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে তার সমস্ত প্রগতিশীল ভূমিকা হারিয়ে আজ প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র অর্জন করেছে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সমস্ত রকম সামাজিক অগ্রগতির পথে সে আজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র আজ একচেটিয়া পুঁজির লেজুড়ে পরিণত হয়েছে। একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থপূরণই রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ। অবাধ গণতন্ত্র এ কাজে প্রধান বাধা। তাই আজ সে গণতন্ত্রকে দুপায়ে মাড়াচ্ছে। মুক্ত সংবাদমাধ্যমের উপর আক্রমণ মুমূর্ষু পুঁজিবাদের সেই প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রেরই অংশ।

পুঁজিবাদ আজ স্বাধীন কিংবা বিরোধী কোনও রকম মতপ্রকাশেরই বিরোধী। স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীন সাংবাদিকতা আজ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের আক্রমণের সম্মুখীন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের উপর নিত্যনতুন আইন এবং নিষেধাজ্ঞা এমন করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে কোনও সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম সরকারের কোনও কাজের সমালোচনা করতে না পারে। পাশাপাশি শাসক একচেটিয়া পুঁজিমালিকরা অর্থের জোরে প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলি কিনে নিয়ে সেগুলিকে নিজেদের দাসানুদাসে পরিণত করছে এবং নির্মম পুঁজিবাদী শোষণকে আড়াল করার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে– যারা পুঁজিবাদী সমস্ত রকম শোষণ-লুণ্ঠন এবং সরকারের সমস্ত রকমের জনবিরোধী কুকর্মকে আড়াল করে জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়গুলিকেই মানুষের সামনে বড় করে তুলে ধরছে। এগুলিই এখন ‘গোদি মিডিয়া’ তথা সরকারের তাঁবেদার সংবাদমাধ্যম হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই ভাবে পুঁজির আধিপত্য সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে। তাই মোদি শাসনে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের জায়গা হয়েছে ১৬১তে। গত বছর যা ছিল ১৫০।

গত দশ বছরের মোদি শাসনের ব্যর্থতা সমাজ জুড়ে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার ভয়াবহ ব্যয়বৃদ্ধি, বেকারত্ব নিয়ে মানুষের তীব্র ক্ষোভ বাকি সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। রামমন্দির নিয়ে বিজেপি নেতারা যেমনটি ভেবেছিলেন, এই দিয়েই তাঁরা আসমুদ্রহিমাচল হিন্দুদের মন জয় করে নেবেন, যে জন্য প্রধানমন্ত্রী অসমাপ্ত মন্দিরই উদ্বোধন করে দিলেন, বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। কারণ মানুষের জীবনের ভয়ঙ্কর আর্থিক সঙ্কট এই সব ভাবাবেগকে ম্লান করে দিয়েছে। ক্ষুব্ধ মানুষের সামনে বিজেপি নেতাদের দিশেহারা দশা।

এই অবস্থায় একটি স্বৈরাচারী সরকারের সামনে আর একটি রাস্তাই খোলা থাকে। তা হল, গায়ের জোরে সমালোচনার মুখ বন্ধ করে দেওয়া। দেশে এখনও যে অজস্র সংবেদনশীল মানুষ, চিন্তাশীল গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন পেশার মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে যে সমালোচনাগুলি প্রকাশ পাচ্ছে, সেগুলি যাতে আরও বড় হয়ে দেখা না দেয়, সেই জন্য সব স্বৈরশাসকের মতো বিজেপির কাছে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করাটা খুবই জরুরি। আজ সরকারের নীতির বিরোধিতাকে– যে নীতির একমাত্র লক্ষ্য দেশের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করা, দেশবিরোধিতা হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা তাদের অন্যতম কৌশল হয়ে উঠেছে। এর আসল লক্ষ্য, সব ধরনের সমালোচককে ভয় দেখানো, সমঝে দেওয়া, বুঝিয়ে দেওয়া যে, সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললে দুর্গতি আছে। দেখো কী করতে পারি। সরকারের বিরুদ্ধে বললেই ইউএপিএ দিয়ে লাইফ হেল করে দেব। জেলে পচতে হবে। অর্থাৎ সারা দেশে এমন একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করো যাতে যে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পায়। অত্যন্ত আশার কথা, মোদি সরকারের এই স্বৈরশাসন সকলেই মুখ বুজে মেনে নেয়নি। শ্রমিক, কৃষক সহ জনসাধারণের মধ্যেও যেমন এই শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বাড়ছে, তেমনই বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, বিচারপতি, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক সহ সমাজের শিক্ষিত অংশের মধ্যেও এই স্বৈরশাসনের বিরোধিতা বাড়ছে। তারই প্রতিফলন যেমন দেখা যাচ্ছে, জাতীয় শিক্ষানীতির দেশজোড়া বিরোধিতায় শিক্ষক অধ্যাপক শিক্ষাবিদদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে তেমনই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধেও সাংবাদিক সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী এর তীব্র বিরোধিতায় সোচ্চার।

বিচারপতিদের একটি অংশ এখনও যে মোদি সরকারের জো-হুজুরে পরিণত হয়নি, একের পর এক রায়ে তা স্পষ্ট হচ্ছে। নিউজ ক্লিক সম্পাদকের মুক্তি যেমন তারই প্রতিফলন, তেমনই বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তির বিরুদ্ধে রায়েও তা স্পষ্ট হয়েছিল। বাস্তবিক মুমূর্ষু পুঁজিবাদের স্বৈরাচারী রূপের বিরুদ্ধে এই সচেতন সাহসী বিরোধিতাই ভরসা। সর্বাত্মক ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের সামনে উদারবাদী বুদ্ধিজীবী সহ শিক্ষিত সচেতন অংশের এই প্রতিবাদ একটা কার্যকরী বাধা।