পূর্ব প্রকাশের পর
যৌথ খামার গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিও অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়৷ শুরুতে যৌথ খামার ছিল যার যার জমির সত্ত্বকে বজায় রেখে যৌথচাষ৷ এখানে উৎপাদনের প্রধান উপকরণ ও শ্রমের সামাজিকীকরণ করা হয়৷ কিন্তু গবাদি পশু, কৃষি যন্ত্রপাতি, ভিটের সঙ্গে থাকা জমিকে ব্যক্তিগত অধিকারে রাখা হয়৷ বেশ কিছু জেলায় পার্টির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে নতুন ধরনের যৌথ খামার বা কৃষি কমিউন গড়ে তোলা হয়, যেখানে ভিটের ব্যক্তিগত জমি সহ সব কিছুর সামাজিকীকরণ করা হয়৷ এই যৌথ খামারের সদস্যরা উৎপাদিত ভোগ্যপণ্য সব কিছুই সমানভাবে বন্টনের কথা বলে৷ কিন্তু অনুন্নত প্রযুক্তি, উৎপাদনের স্বল্পতা ও কমিউন পরিচালনায় ব্যবস্থাপনার অভাবের জন্য তারা নিজেরাই এই কৃষি কমিউন বাতিল করে দলের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ‘কৃষি আর্টেল’–এ ফিরে আসে৷ এই কৃষি আর্টেলই যৌথ খামারের মূল ভিত্তি এবং প্রধান রূপ হিসেবে আবির্ভূত হয়৷ এই আর্টেলে মূল উৎপাদন যন্ত্রসমূহ, জমি ও শ্রমের সামাজিকীকরণ করা হলেও নিজেদের জীবনধারণের অন্যান্য সহায়ক উদ্যোগ যেমন কিচেন গার্ডেন, হাঁস–মুরগি–গবাদি পশু প্রভৃতি ব্যক্তিগত অধিকারে রাখার সংস্থান করা হয়৷
রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন হলেও ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত সমূহের প্রথম অল ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়৷ সেই অধিবেশনে লেনিন ও স্তালিনের প্রস্তাবক্রমে সোভিয়েত জাতিগুলির স্বেচ্ছায় এক রাষ্ট্র–সংঘে সম্মিলিত হয়ে ‘সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের যুক্তরাষ্ট্র’ বা ‘ইউ এস এস আর’ গঠিত হয়৷ এই যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমে রুশ, ট্রান্স–ককেসীয় (আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও জর্জিয়া), ইউক্রেনীয় ও বেলোরুশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলি সম্মিলিত হয়৷ এর পর উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তান স্বেচ্ছায় ইউ এস এস আর–এ মিলিত হয়৷ এর পরেও পর পর আরও বহু প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নে যুক্ত হয়েছিল৷ এর ফলে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে দীর্ঘদিন পর্যন্ত এক একটি প্রজাতন্ত্র উন্নয়নের এক একটি স্তরে ছিল৷ কেউ অনেক বেশি উন্নত, কেউ বা অত্যন্ত পশ্চাদপদ৷
এই পশ্চাৎপদতাকে লক্ষে রেখে স্তালিন বলেন– ‘‘আমাদের যৌথ খামারের নীতির সাফল্য নির্ভর করছে যৌথ খামার আন্দোলনের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চরিত্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়ার উপর৷ বল প্রয়োগ করে যৌথ খামারকে কোনও মতেই প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না৷ … কৃষক সমাজের অধিকাংশের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সমর্থনের উপর নির্ভর করে যৌথ খামার আন্দোলনকে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে৷ উন্নত এলাকার যৌথ খামারের সৃষ্টির উদাহরণকে যান্ত্রিকভাবে অনুন্নত এলাকার ক্ষেত্রে কোনও মতেই প্রয়োগ করা যাবে না৷ এ হবে নির্বোধের মতো প্রতিক্রিয়াশীল কাজ৷ এই ধরনের ‘নীতি’ এক ধাক্কায় যৌথিকরণের ধারণাকে কলঙ্কিত করবে৷’’
যৌথ খামার ব্যবস্থায় শ্রেণির অবস্থানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘যৌথ খামারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, কারণ এর মধ্যে এমন একটা শ্রেণি আছে যারা এখনও ব্যক্তিবাদী ও কুলাক মনস্ক্তার অবশেষ থেকে মুক্ত নয়৷ এরা যৌথ খামারের মধ্যে যে অসাম্য আছে, তাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে৷ আর একদল আছে যারা এই ব্যক্তিবাদী ও কুলাক মনস্কতার অবশেষ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাতে চায়৷ … যৌথ খামার প্রতিষ্ঠা করলেই সমাজতন্ত্র নির্মাণের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ হয়ে গেল, এমন ভাবা ভুল হবে৷ যৌথ খামারের সমস্ত সদস্য সমাজতন্ত্রী হয়ে গেছে একথা ভাবা আরও ভুল হবে৷ যৌথ খামারের কৃষকদের পাল্টানোর জন্য আরও অনেক পথ যেতে হবে৷ তাকে ব্যক্তি মানসিকতা থেকে মুক্ত করার জন্য এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের একজন প্রকৃত সদস্যে পরিণত করার জন্য আরও অনেক কাজ করতে হবে৷’’
১৯২৯ সালে ষোড়শ পার্টি কংগ্রেসে প্রধান আলোচ্যসূচি ছিল আরও সুসংহতভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার ‘পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা’৷ শুরু হয় এক নতুন ধরনের কর্মোন্মাদনা৷ এই পরিকল্পনা অনুসারে ১৯২৯–৩৩ বর্ষে কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নে বরাদ্দ হয় ২,৩২০ কোটি রুবল– এই বিপুল বরাদ্দ বাস্তবে ছিল অবাক করে দেওয়ার মতো একটি ঘটনা৷ এর ফলে একদিকে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে অন্যদিকে যৌথ ও রাষ্ট্রীয় খামারের মাধ্যমে কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্রের দৃঢ় বনিয়াদের উপর দাঁড় করানো সম্ভব হয়৷ শিল্পক্ষেত্রের মতো কৃষিতেও শ্রম তৎপরতার এক প্রবল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় এবং এই উদ্দীপনা সমাজতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার রূপ গ্রহণ করে৷
এতদিন পর্যন্ত বৃহৎ খামারে চাষের উপযুক্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় বড় বড় অনাবাদী জমি ভেঙে চাষযোগ্য করার কোনও উপায় ছিল না৷ নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারা যৌথ খামারে কৃষি কাজের জন্য ট্রাক্টর, কম্বাইন হার্ভেস্টার ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি ‘মেশিন ও ট্রাক্টর স্টেশন’ (MTS) থেকে সরবরাহ করা শুরু হয়৷ ট্রাক্টর ও যন্ত্রপাতিগুলি কীভাবে চালাতে হবে, তাতে কতটা শ্রম সাশ্রয় হবে, উৎপাদন কতটা বাড়বে, অনাবাদী শক্ত জমি কীভাবে যন্ত্রের সাহায্যে চাষযোগ্য করা যাবে তা মেশিন ও ট্রাক্টর স্টেশনগুলিতে প্রদর্শন করা হত৷ তা দেখে চাষিরা যৌথ খামারে যোগ দিতে সংকল্প নিত৷ যৌথ খামারগুলির সাথে চুক্তির ভিত্তিতে পরিষেবা দিতে মেশিন ও ট্রাক্টর স্টেশনগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে৷ যৌথ খামারে কৃষকদের টেনে আনতেও তা বিপুল সাহায্য করে৷ ১৯২৮ সালে যৌথ খামারের অন্তর্গত মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ১৩ লক্ষ ৯০ হাজার হেক্টর৷ সেখানে ১৯২৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪২ লক্ষ ৬২ হাজার হেক্টর এবং ১৯৩০ সালে ১ কোটি ৫০ লক্ষ হেক্টর ছাড়িয়ে যায়৷ এই ঘটনার উল্লেখ করে স্তালিন ‘বিপুল পরিবর্তনের একটি বছর’ প্রবন্ধে লিখলেন– ‘‘বর্তমান যৌথ খামারের আন্দোলনের নতুন ও চূড়ান্ত বৈশিষ্ট্য হল, চাষিরা এখন আর আগের মতো আলাদা আলাদা ভাবে যোগ না দিয়ে গোটা গোটা গ্রাম হিসেবে, এমন কী সারা ভোলস্ত (কয়েকটা গ্রাম) হিসেবে, সারা জেলা হিসেবে এমন কী সারা অঞ্চলের সকলে এসে যোগ দিচ্ছে৷’’ ১৯৩০ সালের মধ্যে বৃহৎ যৌথ খামার ও রাষ্ট্রীয় খামারে বীজ বপনের জন্যও বৃহদাকার যন্ত্র ব্যবহার শুরু হয়৷ অনেকগুলি স্থানে বৃহৎ যন্ত্রপাতি উৎপাদনের কারখানা স্থাপিত হওয়ায় ১৯৩৬ সালের মধ্যে তিন লক্ষ ট্রাক্টর তৈরি করা সম্ভব হয়৷
যৌথ খামার আন্দোলনের অগ্রগতির সাথে সাথে আর্টেল–এর সদস্য চাষিদের ব্যক্তিগত অধিকারে কী কী থাকতে পারে তারও সুনির্দিষ্ট নীতি নির্ধারিত হয়৷ জমির উর্বরতা মান ও অঞ্চল বিশেষে এই ব্যক্তি–সম্পত্তির পরিমাণও কম–বেশি ছিল৷ প্রত্যেকে ০.৬২ থেকে ১.২৫ একর এবং ক্ষেত্র বিশেষে ২.৫ একর পর্যন্ত জমি, একটি থেকে পাঁচটি পর্যন্ত দুধেল গরু, ১০ থেকে ২৫টি ছাগল বা ভেড়া তারা ব্যক্তিগত ভাবে রাখতে পারত৷ প্রত্যন্ত প্রজাতন্ত্রগুলিতে যেখানে যাযাবর বা আধা–যাযাবর জাতির মানুষের আধিক্য, সেখানে তারা অনেক বেশি সংখ্যায় ছাগল, ভেড়া এবং এমনকী গাধা, ঘোড়া, উটও রাখতে পারত৷ তবে এসব বাজারে বিক্রি করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ছিল৷
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক বছর আগেই৷ কর্মোন্মাদনার এ এক অনন্য নজির, যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায়নি৷ এই সময়ের মধ্যে সারা দেশে তৈরি হয়েছে দুই লক্ষ যৌথ খামার ও পাঁচ হাজার রাষ্ট্রীয় খামার৷ এরা চাষের জমি বাড়িয়েছিল ২ কোটি ১০ লক্ষ হেক্টর৷ মোট কৃষি জমির ৭০ ভাগ ছিল এই খামারগুলির আয়ত্তে৷ দ্বিতীয় পঞ্চবাষিকী পরিকল্পনা শেষে যৌথ খামার গড়ে তোলার কাজটি সম্পন্ন হয়ে যৌথ খামারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৪০০টি৷ প্রতিটি খামারের গড় আয়তন হয় ৩,৮২০ একর৷ ১৯৪০ সালে সারা দেশে ট্রাক্টর ৬ লক্ষ ৮৪ হাজার, কম্বাইন হার্ভেস্টার ১ লক্ষ ৮২ হাজার এবং কৃষিপণ্যবাহী লরি ২ লক্ষ ২৮ হাজার উৎপন্ন হয়– যা বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ আয়তনের খামার ও সর্বব্যাপক যন্ত্রীকরণের এক অভূতপূর্ব নজির৷
রাশিয়ার যৌথ খামারের সাফল্য বর্ণনা করে প্রখ্যাত মার্কিন লেখক মরিস হিন্ডাস লিখেছেন : এগারো বছরের মধ্যে রাশিয়ায় ব্যাপক যান্ত্রিক কৃষিশালা দেশে পরিণত হল৷ কঠিন যুগের কণামাত্র আর অবশিষ্ট রইল না৷ পুরনো দিনের লাঙল আর হাল গুদামজাত করে রাখা হল যাদুঘরের দর্শনীয় বস্তু হিসেবে৷ … একটা নতুন যুগের মানুষ গড়ে উঠেছে যারা আগের দিনের ভাগ চাষ বা কাঠের যন্ত্রপাতির কথা কিছুই জানে না৷ তারা শুধু জানে যন্ত্র–ট্রাক্টর, চাকতি হাল (ডিস্ক্ প্লাড), আর কম্বাইন৷ জানে যৌথ চাষের সংবাদ৷ … এরা এমন এক উত্তরাধিকার লাভ করেছে যার সম্ভাবনা ওদের বাবা–মার কাছে কল্পনাতীত ছিল৷
সোভিয়েত কৃষি ব্যবস্থার বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখলেন ‘‘নিজেদের দেশের চাষি মজুরদের কথা মনে পড়ল৷ মনে হল আরব্য উপন্যাসের জাদুগরের কীর্তি৷ বছর দশেক আগেই এরা ঠিক আমাদেরই দেশের জনমজুরদের মতোই নিরক্ষর, নিঃসহায় ও নিরন্ন ছিল৷ তাঁদেরই মতো অন্ধ কুসংস্কার এবং মূঢ় ধার্মিকতা৷ দুঃখে বিপদে এরা দেবতার দ্বারে মাথা খুঁড়েছে, পরলোকের ভয়ে পাণ্ডা পুরুতদের হাতে এদের বুদ্ধি ছিল বাঁধা, আর ইহলোকের ভয়ে রাজপুরুষ মহাজন ও জমিদারদের হাতে, যারা এঁদের জুতোপেটা করত, তাদেরই সেই জুতো সাফ করা এঁদের কাজ ছিল৷ কয়েক বছরের মধ্যে এই মূঢ়তার অক্ষমতার পাহাড় নড়িয়ে দিলে যে কী করে সে কথা এই হতভাগ্য ভারতবাসীকে যেমন একান্ত বিস্মিত করেছে এমন আর কাকে করবে বল?
দশ বছরের মধ্যে রাশিয়ার চাষিরা ভারতবর্ষের চাষিদের কত বহু দূরে ছাড়িয়ে গেছে৷ কেবল বই পড়তে শেখেনি, ওদের মন গেছে বদলে, ওরা মানুষ হয়ে ডঠেছে৷ শুধু শিক্ষার কথা বললে সব কথা বলা হল না, চাষের উন্নতির জন্য সমস্ত দেশ জুড়ে প্রভূত উদ্যম সেও অসাধারণ৷ … এরা অতি দুঃসাধ্য সাধন করতে প্রবৃত্ত৷’’
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলি সম্পন্ন হওয়ায় সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নে শিল্পের সঙ্গে কৃষিতেও দৃঢ় সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এরই মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে সর্বস্তরে ব্যাপক আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়ে ১৯৩৬ সালে স্তালিন রাশিয়ায় এনেছিলেন নতুন ‘সমাজতান্ত্রিক সংবিধান’৷ সমাজতান্ত্রিক এই সংবিধান সম্পর্কে বলতে গিয়ে ১৯২৪ এবং ১৯৩৬ সালের রাশিয়ার ভূমি ব্যবস্থা ও কৃষির তুলনা করে স্তালিন বলেন –‘‘আমাদের কৃষির অবস্থা ছিল আরও খারাপ৷ … সব মিলিয়ে, সেই সময় (১৯২৪ সালে) কৃষি ছিল ক্ষুদ্র ব্যক্তি–কৃষি খামারের সীমাহীন সমুদ্রের মতো৷ এদের হাতে ছিল পিছিয়ে পড়া, মধ্যযুগীয় যন্ত্রপাতি৷ যৌথ কৃষি খামার ও রাষ্ট্রীয় কৃষি খামার ছিল এই সমুদ্রের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মতো৷ সঠিকভাবে বলতে গেলে, জাতীয় অর্থনীতিতে এদের কোনও বিশেষ ভূমিকা ছিল না৷ যৌথ খামার আর রাষ্ট্রীয় খামার ছিল দুর্বল৷ অন্য দিকে কুলাকরা যথেষ্ট শক্তিশালী৷ সেই সময় আমরা কুলাকদের ধ্বংস করার কথা বলতাম না, বলতাম তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা৷ … কৃষিক্ষেত্রে এখন আমাদের আছে যন্ত্রচালিত বৃহদায়তন উৎপাদন৷ এই ধরনের বৃহদায়তন উৎপাদন দুনিয়ার কোথাও নেই৷ এই উৎপাদন হল সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সর্বব্যাপক যৌথ ও রাষ্ট্রীয় খামার৷’’
বাণিজ্যের উল্লেখ করে স্তালিন বলেন, ‘‘এই ক্ষেত্র থেকে ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোরদের পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে৷ সমস্ত বাণিজ্যই এখন সমবায় সমিতির ও যৌথ খামারের হাতে৷ নতুন ধরনের সোভিয়েত বাণিজ্য সৃষ্টি হয়েছে এবং তা বিকশিত হয়েছে৷ এই বাণিজ্যে কোনও মুনাফাখোর নেই, কোনও পুঁজিপতি নেই৷ তাই জাতীয় অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পূর্ণ বিজয় হল এখন ঘটনা৷’’
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই ‘বিজয়’ অর্জন করতে রাশিয়ার লেগেছিল কুড়ি বছরেরও কম সময়৷ সে দেশে কুড়ি বছর আগে যে চাষিকে তার একখণ্ড জমি চাষ করার জন্য জমিদারের কাছে গিয়ে ঘোড়া আর লাঙল ধার পেতে হা–পিত্যেশ করতে হত, বেগার খেটে দিতে হত, না খেয়ে থাকতে হত, ঋণের ফাঁদে পড়তে হত, অভাবের তাড়নায় বৌ–বাচ্চা ফেলে শহরে কাজের খোঁজে যেতে হত, বড় লোকের নানা রকম জুলুম সইতে হত– নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সে হল তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত৷ এই নতুন ব্যবস্থায় সকাল থেকে রাত অবধি তাকে খেটে মরতে হয় না৷ ছেলেপিলের পড়াশুনার জন্য, অসুখে চিকিৎসার জন্য, বেকারি ঘোচাতে কাজের সন্ধানের জন্য তাকে ভাবতে হয় না– কারণ সে ভাবনাটা রাষ্ট্রের৷ মাঝারি বা অপেক্ষাকৃত ধনী চাষি, যে জীবনে একটু সুস্থিতি চাইত, কিন্তু উত্তরাধিকারিদের ভাগ–বাটোয়ারায় জমি ভাগ হয়ে ছোট চাষিতে পরিণত হত, দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলে রুটি জোগাতে ঋণ করত, ভাল ফলন হলে ফসলের দাম পেত না– নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেও হল তা থেকে মুক্ত৷ জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা দেশ থেকে ডঠেই গেল৷ পরবর্তী বছরগুলিতে রাষ্ট্রীয় খামার ব্যবস্থা হল আরও বেশি সুসংহত৷ চাষি হল সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত৷ শুধু ধনী–গরিবের পার্থক্য দূর হল তাই নয়, রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পরিবহন, বিদ্যুৎ পরিষেবায় গ্রাম–শহরের পার্থক্যও দূর হল৷
রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লব ও তার ফলাফল সে দেশের শ্রমিক–কৃষকের জীবনে শুধু সমৃদ্ধি নিয়ে এল না, সর্বপ্রকার শোষণ মুক্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠনের ক্ষেত্রটিকেও সে সংকুচিত করল৷ অন্য দিকে নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবে প্রতিটি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশে শ্রমিক–কৃষকের আন্দোলনে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের স্লোগান তীব্র হয়ে উঠল এবং সেই আন্দোলনের জোয়ার শাসকদের ঘুম কেড়ে নিল৷ সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশগুলিতেও মুক্তি আন্দোলন নতুন প্রাণ পেল নভেম্বর বিপ্লবের প্রেরণায়৷ আর তাই রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিটি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশের শাসকের চক্ষুশূল হয়ে উঠল৷ বেনজির অর্থনৈতিক অসহযোগিতা, কুৎসার বন্যা, প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, সামরিক অভিযান– কোনও কিছুই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার অগ্রগতি রোধ করতে পারল না৷ বিশ্বের কাছে সে হয়ে উঠল এক নতুন বিস্ময়৷ এটা ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে একটা অসহ্য ব্যাপার৷ তারই পরিণতিতে প্রভুত্বকামী সাম্রাজ্যবাদী জার্মানির ফ্যাসিবাদী হিটলার তাকে ধ্বংস করার জন্য কোনও রকম নিয়ম–কানুন, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, নৈতিকতা না মেনে আক্রমণ করল সোভিয়েত রাশিয়াকে৷ সেই আক্রমণ ছিল এ যাবতকালের সমস্ত যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে ধবংসাত্মক, সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী৷ বহু মূল্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইডনিয়ন৷ এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর দেশকে পুনর্গঠন করে অতি অল্পদিনে কৃষিতে, শিল্পে, শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, বিজ্ঞানে, সংস্কৃতিতে, শিল্পকলায়, খেলাধূলায় বিশ্বের উচ্চ শিখরে পৌঁছে গেল সোভিয়েত দেশটি৷ যার নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড স্তালিন৷ ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর মাত্র ছয় বছর দুই মাস বেঁচে ছিলেন লেনিন৷ মহান লেনিনের শিক্ষাকে হাতিয়ার করে স্তালিন বহু বাধা–বিঘ্ণ অতিক্রম করে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষা করেছিলেন বহু আকাঙিক্ষত সেই সমাজতান্ত্রিক সমাজকে৷ ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ মহান স্তালিনের মৃত্যু হল৷ রেখে গেলেন বিপ্লবের পর মাত্র ৩৫ বছর ধরে গড়ে তোলা সেই শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজকে এবং সেই সমাজ গড়ে তোলার মহান শিক্ষাকে৷
শতবর্ষে নভেম্বর বিপ্লব : শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আজও প্রেরণার উৎস
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ৭০ বছর অতিক্রান্ত৷ প্রবন্ধের সূচনায় বলা হয়েছিল, একশ বছর আগে ভারতের চাষি আর রাশিয়ার চাষির অবস্থা ছিল প্রায় একই রকম৷ বরং বলা ভাল সে দেশের প্রত্যন্ত প্রদেশগুলির চাষিদের অবস্থা ছিল ভারতের প্রত্যন্ত এলাকার চাইতেও খারাপ৷ এই ৭০ বছরে ভারতেও কৃষির উন্নতির জন্য গ্রামোন্নয়নের বহু পরিকল্পনা, নামী–দামী অর্থনীতিবিদদের সুপারিশ, কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা, ডচ্চফলনশীল জাত, সবুজ বিপ্লব, উৎপাদন বৃদ্ধি– বহু কিছুই হয়েছে৷ কিন্তু চাষির জীবনে এ সবের কী ফল বর্তেছে?
চাষের উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বোঝা, খরা–বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়া, ফসলের দাম না পাওয়া, ঋণভার বইতে না পারা কৃষকের চলছে আত্মহত্যার মিছিল৷ ২০০৬ সালের ১৮ মে লোকসভায় কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে দেশে আত্মহত্যাকারী কৃষকের সংখ্যা ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৩৪১ জন৷ ২০০৪ থেকে ২০১৬, এই ১২ বছরে আত্মহত্যাকারী কৃষকের সংখ্যা আরও ২ লক্ষ ১৬ হাজার যুক্ত হয়েছে৷ অর্থাৎ ২০ বছরে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার৷ এত মৃত্যুর পর এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক– এজন্য দায়ী কে, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা নয় কী? দেশের চাষিদের ঋণ দিয়ে উপকার করার কথা বলেছিল সরকার৷ আর ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ওয়াই ভি রেড্ডি আমেরিকার পিটারসন ইনস্টিটিউটে ভাষণ দিতে গিয়ে জানালেন, ‘‘যেসব রাজ্যে কৃষকদের ব্যাংক ঋণ বেশি দেওয়া হয়, সেসব রাজ্যেই কৃষকদের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা বাড়ছে৷’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ অক্টোবর ২০০৭)৷ কৃষক আত্মহত্যা করলে যে নেতারা দুঃখে চোখের জল ফেলে, ফসলের নায্য দাম আর ঋণমকুব চাইলে সেই নেতারাই তাদের গুলি করে মারে– এই দৃশ্যও আমরা দেখছি৷ আমরা দেখছি, চাষি পরিবারের যুবকরা জমি হারিয়ে, ঘর সংসার,আত্মীয়–পরিজন ছেড়ে লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় কাজের খোঁজে ছুটছে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে, পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে৷ যাপন করছে পরিযায়ী শ্রমিকের অনিশ্চিত জীবন৷ যার জমি নেই, তার জীবন যেমন অনিশ্চিত, তেমনি যে চাষির জমি আছে, তারও জীবনে নেই কোনও নিশ্চয়তা৷ এই হল বর্তমান গ্রাম–জীবনের বাস্তব চিত্র৷ চাষির উন্নতির কত রকম প্রতিশ্রুতি দেশনেতারা দিলেও স্বাধীনতার পর ৭০ বছরেও রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লেখা এদেশের চাষির হাহাকারের সেই চিত্রটির কোনও পরিবর্তন হল না৷
বাস্তবে কে কত প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তার উপর চাষির জীবনের উন্নতি নির্ভর করে না৷ চাষির জীবনের উন্নতি নির্ভর করে কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী কৃষি ব্যবস্থা চলছে তার উপর৷ আমাদের দেশে কৃষির কোনও ডন্নতি হয়নি, ফলন বৃদ্ধি হয়নি– এটা তো ঘটনা নয় এ ডন্নতি খণ্ডিত৷ আর উন্নতি যতটুকু হয়েছে, উৎপাদন বৃদ্ধি যা হয়েছে, কৃষকের জীবনে তার সুফল বর্তায়নি৷ তার সুফল আত্মসাৎ করেছে এদেশের ধনী চাষি, গ্রামীণ পুঁজিপতি, বীজ কোম্পানি, সার–কীটনাশক উৎপাদক কর্পোরেট মালিক, কৃষিপণ্যের বৃহৎ ব্যবসায়ী ও মজুতদার৷ এরা যত স্ফীত হবে ততই চাষির কঙ্কালসার চেহারা সংখ্যায় বাড়বে৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এটা অবশ্যম্ভাবী ফল৷
আজ উপরে বর্ণিত সোভিয়েত ইডনিয়ন নেই৷ নেই রাশিয়ার সেই সমাজতন্ত্র৷ মহান স্তালিনের মৃত্যুর পর সে দেশের শোধনবাদী নেতৃত্ব প্রায় দীর্ঘ চল্লিশ বছর তাদের দলকে এবং দেশকে সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে পরিচালিত করে আবার ফিরিয়ে এনেছে পুঁজিবাদ৷ আর সেই পুঁজিবাদ সঙ্গে নিয়ে এসেছে জমির উপর ব্যক্তিমালিকানা, ধনী–দরিদ্রের বিভেদ, পুঁজিবাদী বৈষম্যমূলক বন্টন ব্যবস্থা এবং শোষণ ও মুনাফা৷ এই ঘটনা আবার প্রমাণ করল পুঁজিবাদ মানেই ধনী–গরিবের বৈষম্য, মালিকের শোষণ ও মুনাফা এবং সাধারণ মানুষের বেকারি, শিক্ষা–স্বাস্থ্যের অধিকারহীনতা ও জীবনের অনিশ্চয়তা৷
রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ তাই আবার স্মরণ করিয়ে দেয়– পুঁজিবাদ শ্রমিক–চাষির জীবনের নানা ক্ষেত্রে অসহনীয় সমস্যা নিয়ে আসে, কিন্তু সে সব সমস্যার সমাধান পুঁজিবাদের হাতে নেই৷ তার জন্য একমাত্র নির্ধারিত পথ হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ রাশিয়ার মানুষকে যেমন পুঁজিবাদের অসহনীয় শোষণ থেকে মুক্তির জন্য নতুন পরিস্থিতিতে আবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করার পথে যেতে হবে, আমাদের দেশের মানুষকেও মুক্তি পেতে হলে সেই পথেই এগোতে হবে৷ এটাই মানবমুক্তির ইতিহাস নির্ধারিত পথ৷ মহান নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ শোষিত মানুষের কাছে সেই পথেরই সাথী হতে আহ্বান জানায়৷
(শেষ)