*গত সংখ্যার গণদাবী ৭৫বর্ষ ১২ সংখ্যা পর
পতিতাবৃত্তি নির্মূল করেছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্র
দেশ থেকে পতিতাবৃত্তি নির্মূল করার জন্য ১৯২৩ সাল নাগাদ সোভিয়েত রাষ্ট্র বিশেষ ভূমিকা নেয়৷ কেন নারীরা এ পথে যায় তা বুঝতে প্রথমে একটা প্রশ্ণপত্র তৈরি করে হাজার হাজার নারীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ ডাক্তার, মনোবিদ, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের তৈরি এই প্রশ্ণপত্র শোরগোল ফেলে দেয়৷ নারীরা কেন পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে? এর উত্তরে দুটি বিষয়ে জানা যায়– প্রথমত, দারিদ্রের চাপে, অর্থনৈতিক নিষ্পেষণে মেয়েরা এই জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়৷ দ্বিতীয়ত, কারও না কারও প্ররোচনায় তারা এ পথে পা বাড়ায়৷ এই প্ররোচনাকারীরা কারা? তারা হল পতিতালয়ের পরিচালক, যারা নারীদেহ নিয়ে ব্যবসা করে বিপুল মুনাফা অর্জন করে৷
পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিরামহীন সংগ্রাম শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠিক করে একে নিছক প্রচারের মধ্য দিয়ে দূর করা যাবে না৷ পতিতাবৃত্তিকে নির্মূল করতে হলে দরিদ্র মেয়েদের অবস্থার উন্নতি করতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷ ১৯২৫ সালে দু’দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়– প্রথমে অভাবগ্রস্ত নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়৷ ব্যবস্থা করা হয় তাদের বাসস্থানের৷ বিশেষত সেই সব মেয়েদের যাদের স্থায়ী বাসস্থান নেই৷ সাথে সাথে কেন্দ্রীয় ডিক্রি জারি করা হয়৷ পতিতাদের বিরুদ্ধে জার আমলের দমনমূলক আইন সংশোধন করে পতিতাবৃত্তি দ্বারা মুনাফাকারীদের নির্মূল করার জন্য কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়৷ এর ফলে এক ধাক্কায় প্রচুর সংখ্যক পতিতা–ব্যবসায়ীর জায়গা হয় জেলখানায়৷ আঘাত নেমে আসে খদ্দেরদের উপরেও৷ খদ্দেরদের নিরস্ত করার ব্যবস্থাও করা হয়৷ ঘোষণা করা হল, পতিতাদের খোঁজে অভিযান চালানোর সময় কোনও পুরুষ ধরা পড়লে তার নাম–ধাম–পরিচয় জানিয়ে বড় অক্ষরে লিখে দেওয়া হবে ‘নারী দেহের ক্রেতা’৷ এই ঘোষণা একটা নিয়ন্ত্রণ হিসাবে কাজ করে৷
পাশাপাশি শুরু হয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন৷ ইজভেস্তিয়া পত্রিকার সম্পাদকীয়তে উত্থাপিত হয় একটি নৈতিক প্রশ্ন– ‘যদি নারীকে শোষণ করে বাঁচা জঘন্যতম অপরাধ হয় তা হলে নারীর সম্মান ক্রয়ও কি সমান অপরাধ নয়’? সোভিয়েত পুরুষদের অবশ্যম্ভাবী এক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়৷ প্রশ্ন তোলা হয়– সোভিয়েত নারী ও পুরুষের আইনি, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অধিকার সমান৷ প্রেমের স্বীকৃতির সমস্ত বাধা অপসারিত৷ তাই সেখানে ‘যৌনতা ক্রয়’ বিবেকবর্জিত অসহ্য কাজ৷ নারীকে অধঃপতিত করাই শুধু নয়, নিজের শালীনতার সীমাও এর দ্বারা লঙঘন করা হয়৷ যে ব্যক্তিগত তৃপ্তির জন্য নারীকে শোষণ করে, সে কি নিজেকে সমাজের নাগরিক হিসাবে দাবি করতে পারে? এইসব বিষয় মানুষকে ভাবাল৷ অপরদিকে থিয়েটার, নাটক, গল্প, কবিতার মাধ্যমে জনগণকে সোভিয়েত রাশিয়া অতি দ্রুত সমাজজীবন থেকে গণিকাবৃত্তি উচ্ছেদ করতে সক্ষম হল৷
সমাজতন্ত্র পণপ্রথার অবসান ঘটিয়েছিল
পণপ্রথা নারীজীবনের এক মারাত্মক অভিশাপ৷ এর পিছনে রয়েছে সম্পত্তি বৃদ্ধির পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি৷ এই দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত পুরুষ পণের জন্য স্ত্রীর উপর চাপ সৃষ্টি করে৷ বহুক্ষেত্রে মেয়েরাও এই দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হয়৷ এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ভারতের মতো বুর্জোয়া দেশে পণপ্রথা বিরোধী আইন থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না৷ সমজতন্ত্র এই মানসিকতার উৎসটাকেই উপড়ে ফেলে দিয়েছিল সম্পদের উপর ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানারা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে৷ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক মাসের মধ্যে যে সোভিয়েত বিবাহ আইন জারি করা হয়, তাতে পণপ্রথার উপর কুঠারাঘাত করা হয়৷ ঘোষণা করা হয়, সোভিয়েত পরিবারের ভিত্তি হবে পারস্পরিক প্রেম ও সমানাধিকার৷
এঙ্গেলস বলেছেন, ‘‘বিবাহের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তখনই পাওয়া যেতে পারে, যখন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা বিলোপ হবে এবং তা থেকে উদ্ভূত সম্পত্তি–সম্পর্ক দূর হয়ে যাবে৷ সঙ্গে সঙ্গে যে গৌণ অর্থনৈতিক কারণগুলি এখন পাত্র–পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাও দূর হয়ে যাবে৷ …..যখন পুরুষের পক্ষে আর অর্থ দিয়ে অথবা অন্য উপায়ে কোনও সামাজিক ক্ষমতা দিয়ে নারীকে ক্রয় করা যাবে না৷ আর নারীর পক্ষেও প্রকৃত ভালবাসা ছাড়া অন্য কোনও কারণেই পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে না, অথবা আর্থিক পরিণামের ভয় তাদের প্রিয়জনকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাধা হবে না, তখন বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র–পাত্রীর পরস্পরের ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই বিবেচ্য হবে না’’৷
সমাজতন্ত্র ক্লান্তিকর একঘেয়ে কাজ থেকে নারীকে মুক্ত করেছিল
রান্নাঘরে নারীদের বন্দিদশা লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘‘বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা৷ রাঁধার পর খাওয়া৷ আর খাওয়ার পর রাঁধা৷’’ এই ক্লান্তিকর একঘেয়ে জীবন থেকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নারীকে মুক্ত করেছিল৷ হাজার হাজার গণ–রান্নাঘর তৈরি করে লক্ষ লক্ষ মহিলাকে রান্নাঘরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সমাজতন্ত্র৷ নারীকে যাতে রান্নায় ব্যস্ত থাকতে না হয়, তার জন্য ১০/১৫টি পরিবার নিয়ে কো–অপারেটিভ কিচেন, কো–অপারেটিভ ডাইনিং হল, কো–অপারেটিভ লন্ড্রি, এসব ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে কোনও পরিবারে কেউ আটকে না থাকে৷ শ্রমজীবী নারীদের সুবিধার্থে কারখানার কাছাকাছি নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেনের ব্যবস্থা থাকত, যাতে মহিলারা সন্তানদের দুধ খাওয়াতে পারেন, যত্ন নিতে পারেন৷ যৌথ কৃষি ব্যবস্থাও নারীকে মুক্ত করেছিল৷ নভেম্বর বিপ্লবের আগে রাশিয়ায় মেয়েরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খেটেও জানতে পারত না, তাদের রোজগার কতটুকু৷ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর প্রত্যেক নারী বুঝতে পারল, পরিবারের জন্য তার উপার্জন কতটা৷ সন্তানসম্ভবা মহিলাদের সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি, সন্তান জন্মের ১২ সপ্তাহ আগে থেকে ১২ সপ্তাহ পর পর্যন্ত৷ তারপর ১ বছর সবেতন ছুটি৷ তারপর কাজে গেলে ক্রেশে সন্তানকে রেখে দিত৷ সেই সন্তানকে খাওয়ানোর, পোশাক দেওয়ার দায়িত্ব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের৷ কারণ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র শিশুকে সামাজিক সম্পদ মনে করে৷
এই প্রতিবেদন তৈরির সময় গত ৪ নভেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নয়া দাসত্ব’ সম্পাদকীয়টি ভারতে নারীদের দুঃসহ চিত্র দেখিয়ে গেল৷ রাজস্থানে কিশোরী ও তরুণী মেয়েদের নিলামে তুলে ঋণ শোধ করছে পরিবারের পুরুষরা৷ নিলামে বিক্রি হওয়া এই মেয়েদের পাচার করা হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে৷ তাদের স্থান হচ্ছে পতিতালয়ে৷ এর কারণ তো শুধু পুরুষতন্ত্র নয়, পুঁজিবাদী শোষণতন্ত্র৷ সম্পাদকীয়টি এই মর্মান্তিক খবর সামনে আনলেও এর মূলোচ্ছেদের কোনও পথ দেখাতে পারেনি৷ এর জন্য যে সমাজতন্ত্র প্রয়োজন, তা বুর্জোয়ারা প্রচার করতে পারে না৷ এটা বুঝতে হবে, সমস্যাদীর্ণ মানুষকেই৷ হয় সমাজতন্ত্র, নয় মৃত্যু, অমর্যাদার জীবন– এটা শুধু একটা কথার কথা নয়৷ অত্যন্ত বাস্তব৷
উন্নততর সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছিল সমাজতন্ত্র
সোভিয়েত সমাজতন্ত্র মনে করত, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার প্রয়োগ ছাড়া মানুষ পূর্ণ হতে পারে না৷ তাই মানুষের ভাবজগতকে অধ্যাত্মবাদী চিন্তা, কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা দরকার৷ তার মননজগত, রুচিবোধ ব্যক্তিবাদী স্বার্থবোধ থেকে মুক্ত করে সমাজতন্ত্রের উপযোগী যৌথ সংস্কৃতির ভিত্তিতে উন্নীত করা দরকার৷ অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক মানুষ গড়ে তোলার জন্য শিল্প সংস্কৃতি, সঙ্গীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র– এককথায় মানব–মনের সমস্ত ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনা দরকার৷ সোভিয়েত সমাজতন্ত্র তা শুরু করেছিল৷
১৯৩৪ সালে সোভিয়েত লেখক সংঘ ঘোষণা করেছিল, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাই হবে শিল্পীদের শিল্প সৃষ্টির মূল পদ্ধতি– যার উদ্দেশ্য হবে, লেনিনের ভাষায়, ‘‘সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানুষ তৈরি করা’’৷ এই সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা কী? স্ট্যালিন বলেছিলেন, ‘‘শিল্পীদের কাজ হল, জীবন যেমন তাকে তেমন দেখানো৷ আর যদি সে জীবনকে সত্য রূপে দেখতে পারে, তবে সে দেখবে জীবন সমাজতন্ত্রের দিকেই এগিয়ে চলেছে৷ এই হল সমাজতান্ত্রিক বাস্ততা৷ …. সাহিত্যিকরা হবেন মানবাত্মার রূপকার’’৷
সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদি কি ছাঁচে ঢালা? একদমই না৷ স্ট্যালিন ছিলেন, এর ঘোরতর বিরোধী৷ তিনি বলতেন, ‘ধৈর্য ধর, আলোচনা কর, তর্ক–বিতর্ক কর, যারা ভ্রান্ত পথের পথিক তাদের বিভ্রান্তি দূর কর, তোমাদের সৃষ্টিশীল কাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ কর৷ কিন্তু কোনও মতেই কারও কণ্ঠরোধ করা চলবে না৷’’ তিনি আরও বলেছেন, সংসৃক্তির ক্ষেত্রে সমস্ত ধারার মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার পক্ষেই আমরা দাঁড়াব৷ কোনও একটা গোষ্ঠী বা সংগঠন সাহিত্য বা প্রকশনার জগতে একচেটিয়া কর্তত্ব করবে এ আমরা মেনে নিতে পারব না৷ … এর অর্থ হবে সর্বহারা সংসৃক্তিকে ধ্বংস করা৷
১৯৩২ সালে গোর্কির বাড়িতে সোভিয়েত লেখকদের সাথে আলোচনায় স্ট্যালিন বলেছিলেন, কবিতা ভাল, উপন্যাস আরও ভাল, কিন্ত এই মুহূর্তে আমাদের দরকার নাটক৷ সোভিয়েত নেতারা মনে করতেন দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার পর সবাই গল্প–উপন্যাস পড়ে উঠতে পারে না৷ তাদের জন্য প্রয়োজন নাটক৷ সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কাছে যে চিন্তা নিয়ে যেতে হবে, নাটকই তা ভাল করতে পারবে৷ স্ট্যালিন চাইতেন চলচ্চিত্র এমন হোক যা দেখে মানুষ আনন্দ পাবে, যা মতাদর্শগত দিক থেকে জনগণকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে৷ ফিল্ম, রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক বিষয়ে জনগণের চেতনার মানের বিকাশ ঘটাবে৷
স্ট্যালিন বলতেন, ‘দর্শকরা আনন্দ চায়, চায় তেজোদীপ্ত মন৷ ফিল্মে সে নিজের আশা–আকাঙ্খা–আনন্দ–বেদনার প্রকাশ দেখতে চায়৷ কিন্তু জনপ্রিয় ফিল্ম তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, তাকে প্রয়োজনীয়ও হতে হবে, সমসাময়িক বিষয় নিয়েও তাকে কাজ করতে হবে৷ আর তা করতে হবে এমনভাবে যাতে তা নিষ্প্রাণ, গুরুগম্ভীর, নিরানন্দময় না হয়৷’’
শিল্প–সাহিত্য কি সমাজতান্ত্রিক সরকারের অন্ধ অনুগত হবে? একদমই নয়৷ স্ট্যালিন বলতেন, সেভিয়েত চলচ্চিত্রের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের ক্ষেত্রে সোভিয়েত সরকারের সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া৷ তিনি বলতেন, সিনেমা যদি এই কাজ করতে না পারে, তবে মনে হবে সব কিছুই আগে থেকে ঠিক করা, সাজানো–গোছানো৷ তা হলে দর্শকের মনে আবেগ তৈরি হবে না৷
রাশিয়ার ফিল্মে এই সমালোচনামূলক প্রক্রিয়া ছিল৷ ট্রাই গোভারিক ফিল্মে একটা নির্মাণ ক্ষেত্রের তিনজন নেতাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল৷ এদের মধ্যে একজন নেতার দুর্নীতি কীভাবে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে তা দেখানো হয়েছিল৷ স্ট্যালিন একে সমর্থন করে বললেন, এটা দেখানো দরকার ছিল৷
ক্লারা জেটকিন তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, লেনিন বলতেন শিল্প সম্পর্কে আমরা কী ভাবি তা গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ শিল্প সম্পর্কে কোটি কোটি জনগণ কী ভাবে তা গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ শিল্প সম্পূর্ণতা লাভ করে যখন তা কোটি কোটি জনগণের হৃদয়ে প্রোথিত হয়৷
সিডনি ওয়েব ও বিয়াত্রিস ওয়েব লিখেছেন, সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা মনে করে বৈষয়িক লাভ মানবজীবনের মূল লক্ষ্য হতে পারে না৷ ….মানবজীবনের প্রধান লক্ষ্য হল, মানবজাতির সর্বজনীন কল্যাণ৷ ….সোভিয়েত সমাজতন্ত্র মনে করে সেই জীবন সুন্দর যা সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবনে কল্যাণকর৷ এই জীবনবোধেরই বাস্তব প্রতিফলন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে৷ তাই সে বিকাশের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে পেরেছিল৷’’
মানব ইতিহাসে যত সমাজব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে, সমস্ত দিক থেকে সমাজতন্ত্র তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ৷ কিন্তু এর শত্রুরও অভাব নেই৷ কারা সমাজতন্ত্রের শত্রু? যারা পরের শ্রমের উপর নির্ভর করে পরগাছার মতো জীবনযাপন করতে চায়, যারা শোষক পুঁজিপতি শ্রেণি, তারা এর বিরুদ্ধে৷ পুঁজিপতিদের প্রসাদে পুষ্ট যারা, সমাজতন্ত্র কায়েমে যাদের বিলাসবহুল, আমিরি জীবনে ঘা পড়েছে, তারা এর বিরুদ্ধে৷ তারা দিন রাত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, কমিউনিজমের বিরুদ্ধে মিথ্যার উপর মিথ্যা সাজিয়ে নিরন্তর কুৎসা করে বেড়াচ্ছে৷ সমাজতন্ত্র যে দর্শনকে ভিত্তি করে বাস্তবায়িত হয়, সেই মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে এদের অপপ্রচার নিরন্তর৷ এর দ্বারা সাময়িক ভাবে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারে, তাতে সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি কিছুটা শ্লথ করতে পারে, কিন্তু শোষিত–নিষ্পেষিত মানুষের কাছে এর প্রয়োজনীয়তা এতটুকু গুরুত্ব হারায় না৷
জীবনে বড় না হলে বড় জিনিসকে চেনা যায় না৷ যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভাবান তারা সমাজতন্ত্রের কদর বোঝেন৷ আন্তর্জাতিক চিকিৎসক ডাঃ নর্মান বেথুন এক আবেদনে বলেছেন, ‘‘আসুন আমরা কমিউনিস্ট বিরোধিতার জঘন্য প্রতারণা পরিত্যাগ করি৷ এতে হিটলার, মুসোলিনির স্বার্থ সাধিত হয়, কিন্তু দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ সাধারণ মানুষের কোনও উপকার হয় না৷’’ সাহিত্যিক প্রেমচন্দ লিখেছেন, ভারতের মতো দেশ যেখানে জনসংখ্যার বড় অংশ গরিব, সেখানে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সব ধরনের শ্রমিক রয়েছে সেখানে সমাজতন্ত্র ছাড়া তাদের আদর্শ আর কী হতে পারে?’’ বার্নাড শ লিখেছেন, ‘‘আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীরা (৩০ জন) সম্প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম৷ আমরা কেউ কেউ সভ্য এই দেশের অধিকাংশ জায়গায় ঘুরেছি৷ আমরা বলতে চাই, কোথাও আমরা অর্থনৈতিক দাসত্ব, অনাহার, বেকারি ও আয়েশে থাকার জন্য উন্মাদের মতো প্রচেষ্টা লক্ষ করিনি৷ সর্বত্র আমরা দেখেছি, আশায় ভরপুর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জনগণ৷ অত্যাচারী শাসকদের অযোগ্যতা থেকে মুক্ত হয়ে তারা গড়ে তুলছে জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড, বিকাশ ঘটাচ্ছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার, শিক্ষার বিস্তার করেছে, নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে এসেছে, শিশুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে৷ এসব তারা করেছে পর্বতপ্রমাণ বাধা অতিক্রম করে৷ … শ্রমের এবং আচরণের এমন একটা দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করেছে যা অনুসরণ করার জন্য যদি আমরা আমাদের শ্রমজীবী মানুষদের উদ্বুদ্ধ করতে পারি তবে তারা খুবই উপকৃত হবেন৷’’ (শেষ)