70 year 27 Issue, 23 Feb 2018
পূর্ব প্রকাশের পর
সমাজতান্ত্রিক কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থা
গড়ে তোলার সংগ্রামের নতুন অধ্যায়
লেনিনের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বর মহাবিপ্লবের সূচনা হল৷ শীতপ্রাসাদ ও অন্যান্য সরকারি কেন্দ্রগুলি দখল করার পরই ৮ নভেম্বর রাত্রে ঘোষিত হল ঐতিহাসিক নির্দেশনামা৷ ঘোষণা করা হল, ‘‘এই মুহূর্ত থেকে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারদের ভূসম্পত্তি লোপ করা হল৷’’ এই নির্দেশনামার দ্বারা মোট ৪০ কোটি একরেরও বেশি জমি পাওয়া গেল এবং চাষিরা জমিদারের চড়া হারে খাজনা দেওয়া থেকে পরিত্রাণ পেল৷ কিন্তু নির্দেশনামা অনুযায়ী জমির দখল ঘোষিত হলেও বাস্তবে তখনও তা ছিল জমিদার ও কুলাকদের দখলে৷ নবজাত সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে যে সব এলাকায় চাষিদের সংগঠিত করা গিয়েছিল সে সব এলাকায় গরিব চাষি ও কুলাকদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলতে থাকল৷
১৯১৮ সালের জুন মাসে এক নির্দেশনামায় সর্বত্র গরিব চাষিদের কমিটি গঠন করা হল৷ এই কমিটি জমিদারদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত জমি উদ্ধার করে চাষিদের মধ্যে বন্টন, কৃষিযন্ত্র বিতরণ, কুলাকদের কাছ থেকে বাড়তি খাদ্য সংগ্রহ ও শ্রমিক কেন্দ্রগুলিতে এবং লালফৌজের জন্য খাদ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে৷ এই বছরের শেষে গরিব চাষি কমিটিগুলি গ্রাম সোভিয়েতগুলির সাথে মিশে গিয়ে কুলাকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তীব্রতর করে তোলে৷ অন্য দিকে সেই সময়ই অন্তত চোদ্দোটি বিদেশি শক্তি রাশিয়ার বিপ্লবকে ধবংস করার জন্য কুলাকদের সঙ্গে যোগসাজসে প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপকে তীব্রতর করে তোলে৷ চার বছর ধরে চলে সেই তীব্র লড়াই৷
১৯২১ সালের মধ্যে বহু এলাকায় জমিদার ও কুলাকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে জমি উদ্ধার হয়৷ সেই জমি গরিব চাষিদের মধ্যে চাষের জন্য বন্টন করা হয়৷ তখন থেকে চাষিদের কাছ থেকে বাড়তি খাদ্য সংগ্রহের নির্দেশনামা রদ করা হয়৷ শহরের মানুষ ও লালফৌজের খাদ্য সরবরাহের জন্য বিকল্প হিসাবে চাষিদের মধ্যে বন্টন করা জমিতে ফসলি–খাজনা প্রবর্তন করা হয়৷ প্রতিবছর বসন্তকালে বীজ বপনের পূর্বে কত ফসলি–খাজনা আদায় করা হবে তা কৃষকদের জানিয়ে দেওয়া হত৷ খাজনা হিসাবে ফসল জমা দেওয়ার পর বাকি ফসল চাষির কর্তৃত্বে পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া হত৷ এর ফলে চাষিরা স্বাধীনভাবে ফসল বিক্রি বা ব্যবহারের স্বাধীনতা পায়৷ লেনিন এই সময়ের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে বলেন যে, এর ফলে বাণিজ্যের স্বাধীনতার দ্বারা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় শুরুর দিকে পুঁজিবাদের খানিকটা পুনরুজ্জীবন ঘটবে৷
তার পরেই লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় শুরু হয় ‘নয়া অর্থনৈতিক কার্যক্রম’৷ নতুন এই কার্যক্রম অনুযায়ী চাষিরা তাদের হাতে থাকা ফসল বিক্রির ব্যাপারে সমবায় গঠন করে৷ এই সময় লেনিন দেখালেন যে, চাষিদের সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্যে স্বেচ্ছায় টেনে আনতে গেলে সুসংগঠিত উৎপাদক–সমবায় ব্যবস্থায় চাষিদের যুক্ত করতে হবে৷ শুরু হয় চাষের জমি একত্র করে সমবায় প্রথায় চাষ৷ এই সমবায় আন্দোলন বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে সমগ্র রাশিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ এর পরবর্তী ধাপ হিসাবে বৃহদায়তন যৌথ খামার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়৷ ট্রাক্টর এবং অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি হবে এই বৃহৎ যৌথ খামারের অন্যতম অঙ্গ৷ কৃষির এই যন্ত্রীকরণে শ্রম–সাশ্রয় ও ডৎপাদন বৃদ্ধির ফলে চাষির কতটা সমৃদ্ধি ঘটবে তা বোঝাতে গিয়ে লেনিন বললেন, ‘‘যদি আমরা আগামীকাল জ্বালানি তেল ও চালক সহ এক লক্ষ উৎকৃষ্ট মানের ট্রাক্টর সরবরাহ করতে পারি তাহলে মাঝারি চাষিরা বলবে ‘আমি সাম্যবাদের পক্ষে’৷ স্থির হয় যৌথ খামার গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা৷
কিন্তু দেখা যায়, নতুন কার্যক্রম শুরুর দু’বছর পরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারকে বৃহৎ খামারে পরিণত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বহু দূর বাকি৷ পুরাতন পদ্ধতিতে চাষের ফলে কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতির হারও খুব কম৷ প্রতিটি চাষির নিজের সারা বছরের খাদ্যের জন্য ফসল রাখার পর বিক্রির জন্য ফসলের পরিমাণ থাকত খুবই কম৷ তার ফলে শহরবাসী ও সৈন্যদের জন্য খাদ্য সংগ্রহের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকে এবং শহরে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়৷
রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে কায়েমি স্বার্থবাদীরা তখনও পর্যন্ত ছিল প্রবল শক্তিশালী৷ বহু গরিব চাষি তখনও ছিল ধনী চাষিদের অনুগত৷ ছোট চাষিদের জমি আঁকড়ে থাকার মানসিকতাও ছিল প্রবল৷ তার ফলে কৃষি উৎপাদনে এক নতুন সংকট সৃষ্টি হয়৷ এই সংকটের সময়ে লেনিন বলেন – ‘‘অবশ্যই এ কথা মনে রাখতে হবে– যতক্ষণ আমরা ক্ষুদ্র কৃষি অর্থনীতির দেশে বাস করব, ততক্ষণ রাশিয়ায় পুঁজিবাদের নিশ্চিত ভিত্তি থাকবে, সাম্যবাদের ভিত্তি তৈরি হবে না৷ শহরের জীবনযাত্রার তুলনায় গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রা যদি কেউ সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে তা হলে সে দেখতে পাবে আমরা পুঁজিবাদের শিকড় উপড়ে ফেলিনি, তার ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারিনি, অভ্যন্তরীণ শত্রুর শক্তিকে দুর্বল করতে পারিনি৷ এই শত্রুরা ক্ষুদ্র উৎপাদনের উপর নির্ভর করছে৷ একে দুর্বল করার একটাই মাত্র পথ আছে৷ তা হল কৃষি সহ দেশের অর্থনীতিকে নতুন ভিত্তির উপর দাঁড় করানো, আধুনিক বৃহদায়তন উৎপাদনের প্রযুক্তির ভিত্তির উপর দাঁড় করানো৷’’৬ নয়া অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালুর এই পর্যায়ে ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি মহান লেনিনের মৃত্যু হয়৷
স্তালিনের নেতৃত্বে বহুমুখী সংগ্রাম
সমাজতান্ত্রিক নির্মাণে মহান লেনিনের ঘনিষ্টতম সহযোদ্ধা স্তালিনের ডপর দায়িত্ব বর্তায় সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার৷ দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে কৃষি–উৎপাদন বৃদ্ধি করা তখন ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ৷ স্তালিনও মার্কসবাদ–লেনিনবাদের শিক্ষাকে স্মরণে রেখে ক্ষুদ্র জোতে পুরনো যন্ত্রপাতি নিয়ে চাষের বদলে যৌথখামার পদ্ধতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির উপর জোর দেন৷
বাস্তবে ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর প্রথম দশ বছর ভূমি–ব্যবস্থার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের কার্যক্রমটি ছিল অত্যন্ত কঠিন৷ এ কাজে বাধা যেমন জমিদার, কুলাক, গ্রামীণ কায়েমি স্বার্থবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির দিক থেকে এসেছে, তেমনি ট্রটস্কি, কামেনেভ, বুখারিন সহ একদল পথচ্যুত সংশোধনবাদী নেতার কাছ থেকেও বাধা এসেছে প্রবল৷ এরা নয়া অর্থনৈতিক নীতির বিপ্লবী তাৎপর্য না বুঝে একে সমাজতন্ত্র থেকে পশ্চাদপসারণ ও পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তন বলে বর্ণনা করতে থাকে৷ নানা কারণে অসংখ্য মাঝারি চাষি, গরিব চাষিকেও কৃষি–ব্যবস্থার এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সামিল করানো যায়নি৷ প্রথমে লেনিনের নেতৃত্বে এবং লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিনের নেতৃত্বে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে চাষিদের বুঝিয়ে এই কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে৷
১৯২৪ সালে মে মাসে অনুষ্ঠিত বলশেভিক পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে নানা তথ্য থেকে দেখা যায় যে, কৃষি সমবায়গুলিতে সদস্য সংখ্যা আগের বছরগুলির থেকে কমে গিয়েছে৷ আবার সমবায় সদস্যদের মধ্যে মাত্র শতকরা ১৩ জন কমিডনিস্ট৷ স্তালিন এই ঘটনাকে গ্রামাঞ্চলে সংগঠনের সাংগঠনিক দুর্বলতা বলে অভিহিত করেন৷ যেহেতু তখনও পর্যন্ত মোট চাষের জমির তুলনায় সমবায় ও যৌথ খামার ছিল খুবই কম, তাই গরিব চাষিরা তখনও ছিল প্রবলভাবে অভাবগ্রস্ত৷ এই অভাব দূর করার জন্য স্তালিন বলেন যে, ‘‘গ্রামাঞ্চলে আন্দোলন প্রধানত সুনির্দিষ্ট বাস্তব দাবিতে হওয়া দরকার৷ এই দাবিগুলির মধ্যে থাকবে গরিব ও মাঝারি চাষিদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঋণদান সহ সম্ভাব্য সমস্ত প্রকার সাহায্য দেওয়া৷ ক্ষুদ্র চাষিদের সাহায্য করার জন্য ১৯২৪–২৫ সালে প্রায় ২৯ কোটি রুবল বরাদ্দ করা হয়৷ এর ফলে ১৯২৬ সালে সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন যুদ্ধপূর্ব সময়ের (১৯১৩ সালের) প্রায় সমান স্তরে পৌঁছায়৷ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ছোট জোতে পুরনো পদ্ধতিতে চাষ এবং যতটুকু সমবায় ও যৌথ খামার গড়ে ডঠেছে সেখানে পর্যাপ্ত যন্ত্রীকরণের অভাব ও কুলাকদের নানা রকম বিরোধিতার ফলে চাহিদার তুলনায় বাজারীকৃত ফসলের পরিমাণ তখনও যুদ্ধ পূর্ববর্তী বছরের অর্ধেকেই থেকে যায়৷
অন্য দিকে, যেখানে চাষিদের উপর পার্টির প্রভাব কম ছিল সেখানেই প্রতিক্রিয়াশীলরা চাষিদের দাবিগুলি নিয়ে তাদের বন্ধু সেজে বিপথে পরিচালিত করেছে৷ ১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে জর্জিয়াতে মেনশেভিকরা এভাবেই কৃষকদের বিদ্রোহ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে৷ ইডক্রেন, যা সে দেশের অন্যতম খাদ্যভাণ্ডার, সেখানকার কুলাকরা জার্মানির প্ররোচনায় ক্রমাগত খামারের যৌথিকরণকে বিঘ্ণিত করার চেষ্টা করেছে৷
এই ধরনের কৃষক বিক্ষোভ বা বলশেভিক দলের সাথে কৃষকদের দূরত্বের ঘটনাবলি লক্ষ করে ১৯২৪ সালের অক্টোবরে গ্রামাঞ্চলে পার্টির আশু কর্তব্য সম্পর্কে রাশিয়ার গ্রামীণ পার্টি ইডনিটগুলির সেক্রেটারিদের সম্মেলনে স্তালিন বলেন– গ্রামাঞ্চলে পার্টির কর্মকাণ্ডে দুর্বলতা, সংগঠনের অভাব ও কর্মীদের উপযুক্ত মানের অভাব হল পার্টির প্রধান ত্রুটির দিক৷ বাড়তি খাদ্য সংগ্রহের নির্দেশনামা রদ করা ও ফসলী খাজনা চালুর পর চাষিদের অবস্থার উন্নতি হলেও সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েই গিয়েছে৷ কেন? তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শহরে পার্টির শক্তির উৎসের উল্লেখ করে স্তালিন বলেন, ‘‘শহরে আমাদের পার্টির চারপাশে রয়েছে পার্টি সভ্য নয় এমন বিশাল একদল সক্রিয় শ্রমিক৷ সংখ্যায় তারা লক্ষ লক্ষ৷ বিপুল শ্রমজীবী জনগণ এবং পার্টির মধ্যে একটা সেতু হিসেবে তারা কাজ করছে৷ … পার্টি নতুন সদস্য নিয়োগ করে এই সক্রিয় জনগণ থেকেই৷ এরই মাধ্যমে পার্টি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করে৷ … ওই পার্টি বহির্ভূত জনতা শুধু সংযোগ রক্ষাকারী একটা সেতুই নয়, বরং তা শক্তির একটা আধার৷ … পার্টি তখনই বেড়ে ডঠবে, শক্তি অর্জন করবে, যখন পার্টির চারপাশে বিশাল পার্টি বহির্ভূত জনগণ বেড়ে উঠবে, শক্তি অর্জন করবে৷ এমন সক্রিয় জনগণ না থাকলে পার্টি দুর্বল হয়ে পড়বে, নড়বড়ে হয়ে পড়বে৷ তিনি বলেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলে পরিস্থিতি কেমন? পার্টি সংগঠন গ্রামাঞ্চলে অত্যন্ত দুর্বল৷ পার্টির প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন কৃষকরা রয়েছেন৷ তাদের সংগঠনও একইরকম দুর্বল৷ তারপরে রয়েছে পার্টি বহির্ভূত জনগণের এক মহাসাগর, লক্ষ লক্ষ কৃষক৷ পার্টি বহির্ভূত সক্রিয় কর্মীদের দুর্বল সংগঠন এদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না, করেও না৷ সত্যি বলতে কী এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে কেন এই সংগঠন চাপ সহ্য করতে পারে না, ভেঙে পড়ে প্রায়ই৷
সাধারণ কৃষকদের সাথে পার্টির এই সংযোগ স্থাপনের কাজটির উপর স্তালিন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন৷ এই সংযোগ স্থাপনের অন্যতম শর্ত হিসাবে তিনি বলেছিলেন, ‘‘কৃষকদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে৷ এই পরিবর্তন কেমন হতে হবে? কমিডনিস্ট শিক্ষা বলে, পার্টি বহির্ভূত মানুষের কাছে যেতে হবে তাদের সমান হয়ে৷ উদ্ধত হলে চলবে না, বরং মন দিয়ে শুনতে হবে মানুষ কী বলতে চায়৷ পার্টি বহির্ভুত মানুষদের শুধু শেখালে চলবে না, নিজেকেও শিখতে হবে তাদের কাছ থেকে৷ আর পার্টি বহির্ভূত মানুষের কাছ থেকে কিছু শেখার আছে বৈকি৷ আমাদের পার্টির রীতিনীতিগুলোর মধ্যে পার্টি সদস্য আর জনতার মধ্যে সম্পর্কের প্রশ্ন একটা প্রধান প্রশ্ন৷ এই সম্পর্ককে লেনিন ‘পরস্পরের প্রতি আস্থা’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন৷ কিন্তু পার্টি বহির্ভূত কৃষককে যতক্ষণ না নিজের সমান করে দেখছি ততক্ষণ সে আমাদের উপর আস্থা রাখতে পারবে না৷ এইসব ক্ষেত্রে আস্থার বদলে তৈরি হবে অবিশ্বাস৷ ফলে প্রায়ই দেখা দেবে পার্টি আর পার্টি বহির্ভূত জনতার মধ্যে খাড়া হয়ে গেছে নিরেট দেওয়াল৷ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে পার্টি৷ পরবর্তী বছরগুলিতে কৃষকদের সাথে সেই সম্পর্ক স্থাপন করতে পারার ফলে গ্রামাঞ্চলে পার্টির মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব হয়েছিল৷
১৯২৭ সাল থেকে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তখনও পর্যন্ত টিঁকে থাকা ছোট ছোট কৃষি–জোতগুলিকে অতি দ্রুত একত্র করে যৌথ কৃষিজোত তৈরির দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে৷ বলশেভিক পার্টির পঞ্চদশ কংগ্রেসেও স্তালিন কৃষি উৎপাদনের পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে তুলতে আবারও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কৃষিজোতগুলিকে মিলিত কৃষিকর্মের ভিত্তিতে বিরাট বিরাট সংহতিবদ্ধ কৃষিজোতে রূপান্তরিত করা, নতুন ও উন্নততর উৎপাদন পদ্ধতির ভিত্তিতে যৌথ চাষ–ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেন৷তিনি আরও বললেন– ‘‘কৃষকের উপর চাপ না দিয়ে তাদের বুঝিয়ে, তাদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্পদ–প্রমাণ কৃষিজোতগুলিকে ক্রমে ক্রমে অথচ সুনিশ্চিত গতিতে বিরাট বিরাট কৃষি জোতে রূপান্তরিত করা– যে কৃষিজোতগুলি পরিচালিত হবে ঐক্যবদ্ধ, সমবায়ী ও যৌথ কৃষিকর্মের ভিত্তিতে, কৃষিযন্ত্র ও ট্রাক্টরের সাহায্যে এবং নিবিড় কর্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে৷’’
ইতিমধ্যেই দেশে ট্রাক্টর ও অন্যান্য কৃষিযন্ত্র উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করে যৌথ খামারগুলিতে তা সরবরাহ করে যন্ত্রীকরণের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়৷ অনুর্বর ও দুর্বল খামারগুলিকে বিনামূল্যে রাষ্ট্রীয় সাহায্য দিয়ে উন্নত করা, উৎপাদন বাড়াতে সরকারি ডদ্যোগে ট্রাক্টর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি স্বল্পমূল্যে ভাড়া দেওয়া, গরিব ও মধ্যচাষিকে ঋণ সরবরাহ, উন্নত বীজ ও রাসায়নিক সার সরবরাহ, বৃহৎ সেচ ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানসম্মত উন্নত চাষে কৃষককে সাহায্য করা প্রভৃতির ফলে ১৯২৭ সালেই কৃষি উৎপাদন ডল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়ে যুদ্ধপূর্ব উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়৷ এই অভিযানের পর গ্রামাঞ্চলে বিশাল আকারে কৃষির যৌথিকরণের এক বাস্তব এবং অনুকুল পরিস্থিতি তৈরি করে৷