আগামী ৫ আগস্ট সর্বহারার মহান নেতা, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪৬তম মৃত্যু দিবস। এই উপলক্ষে তাঁর অমূল্য শিক্ষার কিছু অংশ গণদাবীর পাতায় আমরা তুলে ধরছি– সম্পাদক, গণদাবী
বিপ্লবীদের মনে রাখতে হবে, বিপ্লবীর সংগ্রাম সর্বত্র। তার ‘এগজিসটেন্স’টাই (অস্তিত্বটাই) সংগ্রাম। সে সবসময় একজন বিপ্লবী হিসাবে সচেতনভাবে অবস্থান করে। কী সেই সচেতনতা? না, সে এইটা বুঝতে পেরেছে যে, তার বিকাশ, তার মুক্তির প্রশ্নটি সমাজের প্রগতি এবং বিকাশের প্রশ্নের সাথে জড়িত। সমাজের প্রগতি ব্যাহত হলে, সমাজ পরিবেশে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তারও বিকাশ ব্যাহত হয়। তারও পরিবারে তার ছায়া পড়ে। গোটা সমাজকে বাদ দিয়ে সে একা একা মুক্তি অর্জন করতে পারে না। একা একা মুক্তি অর্জনের রাস্তা অধ্যাত্মবাদীদের, যারা সংগ্রামের ময়দানে এসেছে তাদের নয়, বিপ্লবীদের নয়। আর একটা কথাও এখানে বুঝতে হবে। তা হচ্ছে, আমরা যে বলি, সমাজের অগ্রগতির স্বার্থের সাথে প্রতিটি ব্যক্তির বিকাশের স্বার্থ, উন্নতির স্বার্থ, সবকিছুর স্বার্থ জড়িত– এই ধারণাটিও ভাসাভাসা– যদি না বুঝতে পারা যায় শ্রেণিবিভক্ত সমাজে কোন সেই শ্রেণি, যে শ্রেণি শোষিত শ্রেণিগুলির অগ্রণী বা নেতা শ্রেণি– যে শ্রেণির মুক্তির স্বার্থের সঙ্গে, প্রগতি-উন্নতি ও স্বাধীনতার স্বার্থের সঙ্গে গোটা সমাজের প্রগতি, উৎপাদনের উন্নতি, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ও সংস্কৃতির, প্রগতির স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এইটা বুঝলেই বুঝতে পারা যাবে, যেহেতু সেই বিশেষ শ্রেণির মুক্তির প্রশ্ন, স্বাধীনতার প্রশ্ন এবং সেই শ্রেণির সংগ্রাম ও নেতৃত্বের প্রশ্নের সঙ্গে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত মুক্তির প্রশ্ন জড়িত, সেই কারণেই যে শ্রেণিসংগ্রাম গোটা সমাজকে সেই বিশেষ শ্রেণির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে একজন বিপ্লবী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
এটাই হচ্ছে আজকের সমাজের যথার্থ ‘রিকগনিশন অব নেসেসিটি’ (প্রয়োজনের উপলব্ধি)। এই প্রয়োজনের স্বীকৃতি বলতে একজন ব্যক্তির নিজের খাওয়া-পরার, চাকরি-বাকরির বা তার নিজের একটা ঘর গোছানোর প্রয়োজন বোঝায় না। বিপ্লবীদের প্রয়োজনবোধ এটা নয়। প্রতিটি মানুষের সত্যিকারের যা প্রয়োজন, সমাজের যা যথার্থ প্রয়োজন, অর্থাৎ প্রগতিশীল বিপ্লবী শ্রেণির যা যথার্থ প্রয়োজন– যে প্রয়োজন থেকে সামাজিক একটা আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, বিপ্লবীর প্রয়োজনবোধ হচ্ছে তাই। যে মানুষ ব্যক্তিবাদ থেকে, কূপমণ্ডুকতা থেকে বা স্বার্থবাদ এবং প্রবৃত্তির তাড়না, যা তার নিজের মধ্যেই রয়েছে, তার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায় সে একা একা লড়ে এগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে না। কারণ আজকের শ্রেণিবিভক্ত পুঁজিবাদী সমাজে বিভিন্ন শ্রেণিচিন্তার যে প্রভাব রয়েছে তার ফলেই, সমাজব্যবস্থার প্রভাবের ফলেই তার মধ্যে এগুলি দেখা দিচ্ছে। ফলে যে শ্রমিক শ্রেণি এইগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে সমস্ত সমাজকে মুক্ত করতে চাইছে, সেই শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির প্রশ্নের সঙ্গে আজকে যদি গোটা সমাজের উৎপাদনের প্রগতির প্রশ্ন, বিজ্ঞানকে পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির প্রশ্ন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে পুঁজিবাদী শোষণের জুলুম ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে, তাহলে ব্যক্তির মুক্তির প্রশ্নও শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তা হলে এই মুক্তির প্রয়োজন উপলব্ধিই হল ব্যক্তির মুক্তির প্রয়োজন উপলব্ধি। এই প্রয়োজন উপলব্ধির থেকেই সমাজে একজন মানুষ বিপ্লবী হচ্ছে।
তা হলে সমাজে একজন বিপ্লবীর অবস্থান কী? না, সমাজে সে এমন একটি চেতনসত্ত্বা হিসাবে অবস্থান করছে যে, সমস্ত সমাজ পরিবেশের মধ্যে, বস্তু পরিবেশের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে সেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যথার্থ স্বরূপটি অনুধাবন করতে পেরেছে এবং সে ধরতে পেরেছে এই দ্বন্দে্বর মধ্যে কোন কোন দু’টি মূল বিরোধী শক্তির দ্বন্দে্বর দ্বারা প্রগতির গতি নির্ধারিত হচ্ছে। যে সময়ে প্রগতির গতি নির্ধারিত হচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্তে্রর বিরুদ্ধে গোটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বারা, সেই সময়ে একজন ব্যক্তির উন্নতি, তার স্বাধীনতা এবং সত্যিকারের প্রয়োজনের চেতনা, মুক্তির প্রয়োজনের চেতনা ছিল সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তার সমস্বার্থবোধ। তখন সেই স্বাধীনতার প্রয়োজনবোধই ছিল তার যথার্থ প্রয়োজনবোধের উপলব্ধি, তার যথার্থ সমাজচেতনার এবং শ্রেণিচেতনার প্রকাশ। আবার আজকের সমাজে একদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর একদিকে শোষিত শ্রেণি অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণি এবং শ্রমিক শ্রেণির দ্বন্দ্ব-সংঘাতই হচ্ছে মূল সংঘাত বা আজকের সমাজের মূল দ্বন্দ্ব– যে দ্বন্দে্বর মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিচেতনা, ব্যক্তিসত্ত্বা আবর্তিত হচ্ছে। এই মূল সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির বিজয়, বুর্জোয়া গণতন্তে্রর জায়গায় সর্বহারা শ্রেণির গণতন্ত্র, উৎপাদন-শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-নৈতিকতা সমস্ত ক্ষেত্রে বুর্জোয়া একাধিপত্যের জায়গায় সর্বহারা শ্রেণির একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্যেই প্রগতির পথ নির্দেশিত হচ্ছে। এই অবস্থায় আজকের সমাজে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির প্রয়োজনের উপলব্ধির সঙ্গে যখন একজন ব্যক্তির প্রয়োজনের উপলব্ধি একীভূত হয়েছে তখনই সে বিপ্লবী।
সুতরাং এই সমাজে একজন বিপ্লবী অবস্থান করছে মানেই সে বুর্জোয়া শ্রেণি এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবস্থান করছে। এই বিরোধ শুধুমাত্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে নয়– ঘরে-বাইরে, সংস্কৃতিতে, নৈতিকতায়, রুচিতে সর্বত্র এই বিরোধ। ফলে একজন বিপ্লবীর কাছে ভাল লাগা বা রুচির ধারণা হচ্ছে তা-ই যা বিপ্লবের পরিপূরক, যা শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি আন্দোলনের পরিপূরক, যা উৎপাদনকে, শিল্পকে, সাহিত্যকে, বিজ্ঞানকে বুর্জোয়া ‘প্রি-কনসেপশন’ (পূর্বধারণা) থেকে মুক্ত করার পরিপূরক। একজন বিপ্লবীর ভাল লাগা বা রুচির ধারণা– বুর্জোয়ার উপলব্ধি, তার সংস্কৃতি, তার সৌন্দর্যবোধ, তার পরিবারের ধারণা, তার ভালবাসার ধারণা, তার যৌন স্বাধীনতার ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী। এই হল বিপ্লবীর যথার্থ অবস্থান।
তা হলে বিপ্লবী এইভাবে অবস্থান করে। সে অবস্থানই করছে প্রচণ্ড সংগ্রামের মধ্যে। এই সংগ্রামের পরিকল্পনার মধ্যে কতকগুলি রুটিন ওয়ার্ক আছে। সেই রুটিন ওয়ার্ক একমাত্র তারাই সহ্য করতে পারে যারা শ্রেণিসচেতন, যারা মূল লক্ষ্যটা ধরতে পেরেছে। এই মূল লক্ষ্যটাকে গড়ে তোলবার জন্যই দীর্ঘদিন ধরে একটা পরিকল্পনায় বিপ্লবীদের কাজ করতে হয়। এলোমেলোভাবে যদি বিপ্লবীরা কাজ করে তাহলে সুসংগঠিত বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তারা ভাঙতে পারবে না। আমরা শুধু তার পুলিশকে দেখছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই পুলিশই সব নয়। আক্রমণে শেষ মোকাবিলা করতে হবে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্তে্র সুসজ্জিত সব থেকে সুসংগঠিত রাষ্টে্রর আর্মি বা মিলিটারির সঙ্গে। সেই শেষ মোকাবিলার আগে প্রয়োজনীয় জনশক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী আন্দোলন চালাবার মতো সংগঠন গড়ে তোলবার জন্য বিপ্লবীদের লড়াই শুরু করতে হয় ঘরে-বাইরে, নিজের মধ্যে, আদর্শের ক্ষেত্রে, নৈতিকতার ক্ষেত্রে, রুচির ক্ষেত্রে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সর্বত্র। তাই মাও সে তুঙ-ও বলেছেন, যে কোনও বিপ্লবের পরিপূরক সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে বিপ্লব সেই বিপ্লবের আগে শুরু করতে হয়। এ কথার অর্থ, প্রতিক্রিয়াবাদীরাই হোক আর প্রগতিশীল বা বিপ্লবীরাই হোক– একে অপরকে যখন ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইবে, সত্যিকারের ক্ষমতাচ্যুত করবার সেই লড়াইটি গড়ে উঠবার আগে দীর্ঘদিন ধরে আদর্শগত ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাদের প্রচার এবং কাজ করে যেতে হয়। এই কাজটি এড়িয়ে গিয়ে মূল লড়াইতে জয়যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। আর এই কাজটিই হচ্ছে খুব কঠিন। যখন কোনও গরম বা ফিভার সৃষ্টি করার মতো লড়াই নেই তখন দিনের পর দিন প্রবল নিষ্ঠা এবং জ্বলন্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে রুটিন ওয়ার্ক চালিয়ে যেতে পারা, সংগঠন গড়ে তোলবার জন্য কষ্টসাধ্য সংগ্রামে নিযুক্ত থাকতে পারা একমাত্র একজন প্রকৃত সচেতন বিপ্লবীর পক্ষেই সম্ভব। আমি আগেই বলেছি, দীর্ঘদিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই বিপ্লবী সচেতনতা গড়ে তোলবার সংগ্রামে যারা আসেনি, দিনের পর দিন রুটিন ওয়ার্কের মতো কঠিন সংগ্রাম করবার কোনও ক্ষমতাই যাদের নেই, তারাও মাঠে-ময়দানে যখন লড়াইটা চলে তখন সে লড়াইতে কত সহজে এসে যায়– যাকেই আমরা ভুল করে একমাত্র স্ট্রাগল বলে মনে করি। আর প্রতিদিন রুটিন ওয়ার্ক চালিয়ে যাওয়াটা, আমরা মনে করি, স্ট্রাগল নয়। অথচ বিচার করলে দেখা যাবে, দীর্ঘদিন ধরে এই রুটিন ওয়ার্কের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া অনেক বেশি কঠিন। এর জন্য চাই চরিত্রের বল, চাই আদর্শের নিষ্ঠা, চাই সমস্ত জিনিসটাকে সম্যক উপলব্ধি করার ক্ষমতা।
তা হলে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, রুটিন ওয়ার্কটা দেশের অভ্যন্তরে বিপ্লব গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য কাজ এবং এটাও স্ট্রাগলেরই একটা রূপ। ফলে পার্টির কাজ সম্পর্কে সঠিক সমালোচনা হবে এটা বিচার করে দেখা যে, রুটিন ওয়ার্কটা কেবলমাত্র কতকগুলো বাঁধাধরা ছকে হচ্ছে, নাকি তার মধ্যে প্রতিনিয়ত জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলবার একটা পরিকল্পনা আছে। জনগণের সঙ্গে সংযোগের ভিত্তিতে কাজ করার এই প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত কনট্রাডিকশন আছে, তার টারময়েল (তীব্র মানসিক আলোড়ন) আছে এবং বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিত্যনতুন প্রক্রিয়ায় তাকে গড়ে তোলবার জন্য আন্দোলন আছে। আন্দোলন বলতে শুধু বাইরের একটা স্লোগান দেওয়া, মিছিল, মিটিং, ব্যারিকেড করে লড়াই, পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি এবং ক্ষমতা দখল করা নয়। এগুলো সবই আন্দোলনের এক একটা রূপ– চেতনার স্তরভেদে, সংগঠনের স্তরভেদে রূপভেদ। চেতনার স্তর, সংগঠনের স্তর, গণসমাবেশের স্তর এবং আক্রমণের ধারা এবং রীতি এই কয়েকটা জিনিস মিলে এই লড়াইয়ের ঢংগুলো, ফর্মগুলো– অর্থাৎ কোনটা কোন ফর্মের লড়াই, কোন সময়ে কোন লড়াইটা হবে তা পালটে যায়। আলোচনা করা, তর্কবিতর্ক করা, ডিবেট করা, লোককে বোঝানো, বিরুদ্ধ মতবাদের বিরুদ্ধে ফাইট করা, ইউনিয়ন গড়া, কলেজ ইউনিয়ন চালানো, রাজনৈতিক ক্লাস পরিচালনা করা, পোস্টারিং করা, ডোর-টু-ডোর অ্যাপ্রোচ করা, বিরুদ্ধ মতবাদকে পরাস্ত করে জনগণের মধ্যে বিপ্লবী মতবাদ সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে তোলার জন্য ধীরে ধীরে দীর্ঘদিন ধরে পেইনস্টেকিং (কষ্টসাধ্য) আলোচনা চালিয়ে যাওয়া– এগুলো সবই সংগ্রামের বিভিন্ন বিচিত্রতর এবং জটিলতর রূপ। এই সংগ্রামে যে কর্মী নিয়োজিত সে কখনও আপন নিয়মে কাজ করে না। সে ‘কালেকটিভে’র (যৌথ নেতৃত্বের) প্রোগ্রাম অনুযায়ী খুশি মনে কালেকটিভের সঙ্গে মিলে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে এই কাজটি করে।
(যুক্তফ্রন্ট রাজনীতি ও পার্টির সাংগঠনিক কাজকর্মের কয়েকটি দিক)