মনে রাখবেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদই হোক, আর যে কোনও আদর্শবাদই হোক, শুধু কতকগুলো কথার মধ্যে কোনও আদর্শের মর্মবস্তু নিহিত থাকে না। যে কোনও আদর্শের আসল পরিচয় বা মর্মবস্তু নিহিত থাকে তার সংস্কৃতিগত, নীতিগত এবং রুচিগত মানের মধ্যে। না হলে বই পড়ে বড় বড় রাজনীতির কথাগুলো যে কোনও ‘মিডিওকার’ পর্যন্ত আয়ত্ত করতে পারে এবং সেগুলো বলতে পারে। তাই মা’র্ থেকে শুরু করে লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে-তুঙ পর্যন্ত বা যাঁরাই হাতেকলমে বিপ্লব করেছেন, সকলেই একটা কথার উপর জোর দিয়েছেন, তা হচ্ছে, কোনও আদর্শ বড় হলেই তাকে বাস্তবে রূপায়িত করা যায় না, যদি সেই আদর্শকে রূপায়িত করবে যে মানুষগুলো তারা সেই আদর্শকে রূপায়িত করবার মতো বড় মানুষ এবং উন্নত চরিত্রের না হয়। তাই মার্ক্সবাদী আন্দোলনে ডি-ক্লাসড রেভোলিউশনারি বা প্রফেশনাল রেভোলিউশনারি গড়ে তোলবার প্রয়োজনীয়তার প্রতি তাঁরা এত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই মাও সে-তুঙকে বলতে শুনি– কেউ মার্ক্সবাদ বুঝেছেন কি না এবং তত্ত্ব ও কর্মের সংযোজন ঠিক মতো করতে পেরেছেন কি না, তার প্রমাণ তিনি কত বই পড়েছেন বা কত বই লিখেছেন তাতে নেই বা তার প্রমাণ কত স্লোগান তিনি দিয়েছেন এবং কত জেল তিনি খেটেছেন তাতেও নেই। তার একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে, তিনি উন্নত সংস্কৃতি এবং উন্নত নৈতিক বলের অধিকারী হয়েছেন কি না। ইয়েনানের স্কুলে পার্টির নেতা ও কর্মীদের কাছে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এই কথা বলেছেন। বলেছেন, কারওর মধ্যে মার্ক্সবাদের উপলব্ধি ঠিক মতো ঘটেছে কি না, তা বোঝবার এইটিই একমাত্র কষ্টিপাথর। অথচ আমাদের দেশের মার্ক্সবাদী আন্দোলনে এই কষ্টিপাথরটির উপরে আমরা একেবারে জোর দিই না। বামপন্থী আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন এ দেশে দীর্ঘদিন শুরু হওয়া সত্ত্বেও এমন ভাবে তা যে বিপথগামী হল, তা যে বারবার নানা ধরনের সুবিধাবাদ, সংস্কারবাদ এবং শোধনবাদের খপ্পরে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পড়ছে, এক ধরনের শোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে আর এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ছে, বা এক ধরনের বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে আর এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ছে, তার একটা প্রধান কারণ, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের এই মর্মবস্তুর দিকটিকে এখানে অবহেলা করা হয়েছে।
এ দেশের অনেক তথাকথিত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীদের এমন কথাও বলতে শুনেছি যে, নীতিনৈতিকতা, আদর্শবাদ এগুলো সব নাকি বুর্জোয়াদের কুসংস্কার। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নাকি নীতিনৈতিকতা, আদর্শবাদ বলে কোনও জিনিস নেই। আমি কিন্তু এমনভাবে মার্ক্সবাদ বুঝিনি। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ এমন বুঝলে আমি বহুদিন আগেই তা পরিত্যাগ করতাম। আমি বুঝেছি, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে এ যুগের সবচেয়ে উন্নত মানের আদর্শবাদ। এর মধ্যেই রয়েছে এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নীতিনৈতিকতার ধারণা, এর চেয়ে বড় আদর্শবাদ নেই। বুর্জোয়া মানবতাবাদের সঙ্গে, ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে এর পার্থক্য হচ্ছে, বুর্জোয়া মানবতাবাদ বা ধর্মীয় মূল্যবোধে নীতিনৈতিকতার একটা শাশ্বত কাঠামো আছে– আর, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে যে নীতিনৈতিকতার ধারণা, জীবনসংগ্রামের দ্বারা তার রূপ ক্রমাগত পাল্টায়। বাস্তব অবস্থা এবং মানুষের যথার্থ প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এর নীতিনৈতিকতার ধারণা পাল্টাতে থাকে। মানুষের এই যে যথার্থ প্রয়োজন, এটা কারও ব্যক্তিগত প্রয়োজনবোধ নয়। পরিবর্তনের যেটা যথার্থ প্রয়োজন, তার দিকে লক্ষ রেখে এর নীতিনৈতিকতার ধারণাগুলোরও ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটে। যেমন করে সমাজ পাল্টাচ্ছে, উৎপাদন ব্যবস্থা পাল্টাচ্ছে, মানুষের প্রয়োজনের উপলব্ধি বা প্রয়োজনবোধ পাল্টাচ্ছে, সংগ্রামের প্রক্রিয়া পাল্টাচ্ছে, শ্রেণিসংগ্রামের রূপ পাল্টাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে এক স্তর থেকে আর এক স্তর পর্যন্ত, তেমনই এর নীতিনৈতিকতার ধারণাও পাল্টাচ্ছে।
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে নীতিনৈতিকতার ধারণা রয়েছে বৈকি এবং সেটা খুব উন্নত ধারণা, বুর্জোয়া মানবতাবাদের চেয়েও উন্নত ধারণা। তাই দেখবেন, মার্ক্স কমিউনিজমের কথা কেন বলেছেন, তা নিয়ে একদল তাঁকে একসময় প্রশ্ন করেছিলেন। কারণ, তাঁরা মনে করতেন, মানবতাবাদের চাইতে উন্নত আদর্শবাদ কিছু নেই। মার্ক্স তার উত্তরে তাঁদের বলেছিলেন, তাঁরা যে মানবতাবাদের কথা বলছেন, তা আসলে বুর্জোয়া মানবতাবাদ। আর, তিনি যে কমিউনিজমের কথা বলছেন, তাও মানবতাবাদই। কিন্তু কমিউনিজম হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে মুক্ত মানবতাবাদ। এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি কথাটা শুধু বস্তুগত অর্থে তিনি বোঝাতে চাননি। অর্থাৎ বাড়ি-ঘর, টাকা-পয়সা, আরাম-আয়েস, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, এই যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির আধার, এটাকেই তিনি শুধু বোঝাননি। যারা তাঁর কথা ঠিকভাবে বুঝেছে, তারা জানে যে, তিনি এর দ্বারা এতদূর পর্যন্ত বলতে চেয়েছেন যে, এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি যখন চলে যাবে বা কেউ ছেড়ে দেবে, তখনও ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে গড়ে ওঠা যে মানসিক ধাঁচা থেকে যাবে– অর্থাৎ ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বা প্রফেশনাল ইগোসেনট্রিসিজম-এর মধ্যে যার রূপ আমরা দেখতে পাই, তার থেকেও নিজেকে মুক্ত করতে পারে যে মানবতাবাদ, সেই মানবতাবাদ হচ্ছে কমিউনিজম।
তা হলে ভারতবর্ষে এই সমস্ত তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টির যাঁরা নেতা, তাঁরা নিজেরা আগে কমিউনিস্ট হলে এবং এই কমিউনিস্ট নীতিনৈতিকতার অধিকারী হলে তবে তো অপরকে নেতৃত্ব দেবেন। তা এই সমস্ত তথাকথিত কমিউনিস্ট নেতাদের অনেকেই বস্তুগত অর্থেও ব্যক্তিগত সম্পত্তি যেখানে আজও ছাড়তে পারেননি, সেখানে তাঁরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে উদ্ভূত মানসিক ধাঁচা থেকে নিজেদের মুক্ত করবেন কী করে? বিষয়টা এত সোজা নয়।
‘বর্তমান পরিস্থিতি এবং গণআন্দোলনে প্রধান বিপদ’ – শিবদাস ঘোষ ।। ২৪ এপ্রিল, ১৯৭৪-এর ভাষণ