সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী রাজ্যের শিল্প বৈঠকের মঞ্চ থেকে সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, যারা সরকারের ইতিবাচক দিক তুলে ধরবে, তাঁর সরকার সেই সংবাদমাধ্যমকেই সাপোর্ট দেবে। বলেছেন, অন্য রাজ্যের সংবাদমাধ্যম সেই রাজ্যের পজিটিভ দিক তুলে ধরে। কিন্তু বাংলার সংবাদমাধ্যম শুধু নেগেটিভ প্রচার করে। বলেছেন, যাদের এত সাপোর্ট দিই, দু-একজন ছাড়া তারা একটা পজিটিভ কথা বলে না। বলেছেন, এখানে ব্যবসা করবেন, আবার এখানকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, দুটো একসঙ্গে হতে পারে না।
সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণতন্তে্রর অতন্দ্র প্রহরী, সমাজের আয়না হিসাবে তার কাজ করার কথা। একটি সমাজ কতটা গণতান্ত্রিক তা তার সংবাদমাধ্যম কতটা স্বাধীন তা দিয়েই বোঝা যায়। যে দেশে গণতন্ত্র যত শক্তিশালী সে দেশের সংবাদমাধ্যম তত স্বাধীন। সরকারের স্বচ্ছতা, বিশ্বাসযোগ্যতা কিংবা নীতিপঙ্গুত্ব, নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি, কর্পোরেটের দুর্নীতি সব কিছুকে জনসমক্ষে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্টে্রর রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসেবে কোনও সরকার যখন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে কেড়ে নিতে চায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তার বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিবাদ দমন করে তখন সংবাদমাধ্যম সরকারের, প্রশাসনের সেই সব কুকর্মকে জনগণের সামনে তুলে ধরে, যা আসলে সরকারকেও সচেতন করে, সাবধান করে। সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে গণতন্তে্রর ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকলে এতে তাঁরা সচেতন হন। আর যদি তা না থাকে তবে সংবাদমাধ্যমের উপর খড়গহস্ত হন।
মুখ্যমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট তিনি চান দলদাস সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যমের কাজ কোনও সরকারের পক্ষে ড্রাম বাজানো নয়, সরকারের খামতির দিকগুলিকে সামনে নিয়ে আসাই তার প্রধান কাজ হওয়া উচিত। তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী যাকে ইতিবাচক দিক বলে প্রচার করতে চান, সংবাদমাধ্যম তাকে ইতিবাচক দিক না-ও মনে করতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী ইতিবাচক-নেতিবাচক সংবাদের কথা বলেছেন। বলেননি যে, সংবাদমাধ্যম তাঁদের সরকার সম্পর্কে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। সংবাদ যদি মিথ্যা না হয়, তবে তাতে রাগ করার কিছু থাকে কি? একটি সরকার গণতান্ত্রিক হলে তো তার নেতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরার জন্য সংবাদমাধ্যমকে মুখ্যমন্ত্রীর ধন্যবাদ দেওয়া উচিত এবং দ্রুত সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে সেগুলিকে ইতিবাচক দিকে পরিণত করার চেষ্টা করা উচিত। পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী সমালোচক সংবাদমাধ্যমকে ‘সাপোর্ট’ না দেওয়ার হুমকি দিলেন।
সংবাদমাধ্যমকে সরকারের সাপোর্ট দেওয়া মানে কি? মানে হল, অপছন্দের সংবাদমাধ্যমে সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করা। অর্থাৎ যাকে বলে ভাতে মারা। সেটাও তো গণতন্তে্রর লঙ্ঘনই। সংবাদমাধ্যমকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার অবশ্যই সরকারি নির্দিষ্ট নীতি থাকে। সেই নীতি মেনেই বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা। সেই নীতি কি শাসক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বদলে যেতে পারে? যদি যায় তবে তাকে গণতান্ত্রিক আচরণ বলে কি?
আর, ‘এখানে ব্যবসা করবেন, আবার এখানকার আইনশৃঙ্খলা তুলে ধরবেন, দুটো একসঙ্গে হতে পারে না’ বলে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন তা তো একেবারেই কোনও নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর মুখে মানায় না। কোনও রাজ্যে কোনও সংবাদমাধ্যমের ব্যবসা করার এটা শর্ত হতে পারে না যে, তার বিনিময়ে সেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিষয়ে তাকে নীরব থাকতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই এই বক্তব্যকেও গণতান্ত্রিক বলা যায় না। এটি পুরোপুরি কোনও একটি রাজ্যকে সেই সরকারের বা সরকার-প্রধানের খাস তালুক ভেবে নেওয়ার মনোভাব। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সেই মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী প্রায়শই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক বলেন। সঠিক ভাবেই বলেন। কিন্তু কোনও আচরণ অপরে করলে দোষ, আর নিজে করলে তাতে কোনও দোষ হয় না, এমন তো হতে পারে না। সম্প্রতি কেন্দে্রর বিজেপি সরকার সাংবাদিকদের সরকারি স্বীকৃতির কতগুলি নিয়ম ঘোষণা করেছে। কোনও সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের লেখা বা বিবরণকে দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সংহতি কিংবা অন্য রাষ্টে্রর সাথে সম্পর্কের পক্ষে ক্ষতিকারক বা বিপজ্জনক মনে হলে সরকার সংবাদমাধ্যমের বা নির্দিষ্ট সাংবাদিকের সরকারি স্বীকৃতি বাতিল করবে। অর্থাৎ সরকার যে সংবাদমাধ্যমকে বা সাংবাদিককে অপছন্দের মনে করবে তার বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ আনতে পারবে। সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের যে আচরণ ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে, তা সে হাথরস নিয়ে খবর করতে যাওয়া কেরলের কাপ্পান হোন বা কাশ্মীর জুড়ে সংবাদমাধ্যমের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা বা সাংবাদিকদের হেনস্থা হোক, তাতে সরকার যে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম নয়, কর্তাভজা অনুগত সংবাদমাধ্যমই চায়, তা স্পষ্ট। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কি দিল্লির পথেই নিজেকে চালিত করতে চাইছেন?
অবশ্য স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে শাসকদের খড়গহস্ত হওয়া কোনও নতুন বিষয় নয়। ব্রিটিশ শাসনে সংবাদপত্রের স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে বারবার সরকারি দমন-পীড়ন নেমে এসেছে। ব্রিটিশ বিরোধী লেখার জন্য সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্পাদককে জরিমানা করা হয়েছে, জেলে ভরা হয়েছে। এই কাজকে আইনসঙ্গত করতে নিত্য-নতুন অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছে। স্বাধীন ভারতেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। ইন্দিরা গান্ধীর শাসনে সংবাদমাধ্যমের উপর দমন-পীড়ন, সাংবাদিকদের জেলে ভরার ঘটনা শাসকের আচরণের নজির হয়ে আছে।
আজ যখন শাসক দলগুলির নেতাদের নীতিহীনতা, দুর্নীতি অতীতের সব নজিরকে ছাড়িয়ে গেছে তখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী ঠিক তার বিপরীত রাস্তাতেই হাঁটতে শুরু করেছেন। রাজ্যে তৃণমূল শাসনে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে কারচুপি, ছাপ্পা, জবরদস্তি কিংবা বিরোধীদের ওপর হামলায় আর কোনও গোপনীয়তা রাখছেন না দলের নেতারা। চলছে জনগণের টাকার ব্যাপক তছরুপ। বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার ভয়ঙ্কর নজির আনিস হত্যার ঘটনা। স্বাভাবিক ভাবেই এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনরোষ ফেটে পড়েছে। গণবিক্ষোভের সেই সংবাদ প্রকাশ করায় সংবাদমাধ্যমের উপর রুষ্ট হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী দলীয় দুষ্কৃতী বাহিনীকে সংযত করার পরিবর্তে সংবাদমাধ্যমকেই ‘সাপোর্ট’ না দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। অথচ সংবাদমাধ্যম তার উপর ন্যস্ত দায়িত্বই পালন করেছে।
স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর এমন আচরণ সংবাদ মাধ্যম এবং গণতন্ত্রপ্রিয় সাধারণ মানুুষ উভয়ের কাছেই বিপজ্জনক ইঙ্গিত হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা, একই সাথে জনস্বার্থ রক্ষার স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীর এমন মনোভাবের তীব্র সমালোচনা সমাজের সব স্তর থেকেই হওয়া দরকার।