সব রাজ্যের সব শাসকের ভরসা ‘খয়রাতি’তেই

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট নাগরিকদের অধিকার। প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার। বিধানসভা, লোকসভার মতো আইনসভাগুলিতে কে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তাঁদের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা এই সভাগুলিতে তুলে ধরবেন, তা নির্ধারণের অধিকার। আচ্ছা, সেই অধিকার কি এখন টাকার বিনিময়ে বাজারে আলু-পটল-মাছের মতো করে বিক্রি হচ্ছে?

অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্ন উঠছে, যখন দেখা গেল মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে প্রচারসভায় বত্তৃতা করতে যাওয়া একের পর এক বিরোধী নেতার হেলিকপ্টারে নির্বাচন কমিশনের অফিসাররা তল্লাশি করতে শুরু করলেন। রেগে লাল হলেন বিরোধী নেতারা। বললেন, কই করুক তো দেখি মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টার তল্লাশি। এরপরই বিজেপি এক্স হ্যান্ডেলে মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে, উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়ণবীস এবং সবশেষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হেলিকপ্টারে ব্যাগ তল্লাশির ছবি পোস্ট করল। নিন্দুকেরা বলল– লোকদেখানো।

সবচেয়ে বড় কথা হল, কী এমন ঘটল যে, কংগ্রেস সভাপতি, মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রভৃতির মতো তাবড় সব মন্ত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি করতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের অফিসারদের? তল্লাশি চালিয়ে কী খুঁজলেন তাঁরা? খুঁজলেন টাকার বান্ডিল। পেয়েছেন কি পাননি তা এখানে বড় কথা নয়। বড় কথা এই যে, সরকার এবং বিরোধী উভয় পক্ষ মিলে রাজনীতিকে আজ এমন নিকৃষ্ট জায়গায় নামিয়ে এনেছে যে, ভোট কেনার জন্য তাঁদের ব্যাগ-বোঝাই টাকার বান্ডিল নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে এবং তার জন্য কমিশনকে ছবি তোলার জন্য হলেও নজরদারি করতে হচ্ছে।

নির্বাচন মানেই এখন একদিকে টাকার স্রোত, অন্য দিকে খয়রাতির বর্ষণ। ভোটসর্বস্ব এই সব রাজনৈতিক দলগুলির এমন পরিস্থিতি যে তাদের এখন ভোট কিনতে হয়। যে দলের ব্যাগে যত টাকা সে দল তত বেশি পরিমাণে তা গুঁজে দিচ্ছে ভোটারদের হাতে। ব্যক্তিগত ভাবে হাতে টাকা দেওয়া ছাড়াও এরা কখনও টাকার বিনিময়ে চুক্তি করছে পরিবারের কর্তার সঙ্গে, কখনও বা একটি পাড়া বা একটি গোষ্ঠীর মাথার সঙ্গে। আবার কখনও সমাজের কোনও গোষ্ঠীর বিশেষ দাবিপূরণের আশ্বাসের বিনিময়ে ভোট পাওয়া নিশ্চিত করছেন এই সব নেতারা। কখনও কোনও গোষ্ঠীকে দিচ্ছেন সংরক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া, তো কখনও চাকরির প্রতিশ্রুতি।

এ সব কিছুকেও যা ছাড়িয়ে গেছে তা হল সরকারি তহবিল থেকে খয়রাতির প্রতিযোগিতা। সংসদীয় দলগুলি এখন খয়রাতিকে ভোট রাজনীতির অপিরহার্য অঙ্গে পরিণত করে ফেলেছে। পশ্চিমবাংলার মানুষ ভোটের মুখে খয়রাতির ফুলঝুরি দেখতে বেশ কিছু দিন ধরেই অভ্যস্ত। এ বারের মহারাষ্ট্র বিধানসভার ভোট যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। এনডিএ তথা মহাযুতি জোটের বড় শরিক বিজেপি তাদের ইস্তাহারে রাজ্যের মহিলাদের ২১০০ টাকা মাসিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলে পাল্টা ইন্ডিয়া মঞ্চ তথা মহাবিকাশ আঘাড়ী জানিয়ে দিয়েছে তারা ক্ষমতায় এলে মহিলাদের মাসিক তিন হাজার টাকা ও বিনামূল্যে বাসে যাতায়াতের ব্যবস্থা করবে।

মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে দলের হয়ে ‘সঙ্কল্প পত্র’ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্বয়ং। তাতে মহিলা-কৃষক ও যুব সমাজের জন্য ২৫ দফা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বিজেপির সঙ্কল্প পত্রে বলা হয়েছে, এনডিএ সরকার ক্ষমতায় এলে লাডলি বহিন যোজনায় মহিলারা মাসিক পনেরোশো টাকার পরিবর্তে একুশশো টাকা করে বছরে ২৫ হাজার টাকা পাবেন। যদিও বিরোধী শিবির পাল্টা মাসিক তিন হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা করে দিয়েছে। বিজেপি এ ছাড়াও বিদ্যুতে ৩০ শতাংশ ভর্তুকি, কৃষক সম্মান নিধি যোজনায় ১২ হাজার টাকার পরিবর্তে ১৫ হাজার টাকা, প্রবীণদের ভাতা ১৫০০ থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা, ১০ লক্ষ শিক্ষার্থীকে মাসে দশ হাজার টাকা অনুদান ও ২৫ লক্ষ নতুন চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্য দিকে মহাবিকাশ আঘাড়ীও পাল্টা নানা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা, কেরালা বা কর্ণাটক– সব রাজ্যে সব শাসকদলেরই এখন ভরসা শুধু খয়রাতিতেই।

অনেকেরই মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী এক সময় এই খয়রাতির রাজনীতিকে ‘রেউড়ি রাজনীতি’ অর্থাৎ সরকারি টাকায় মণ্ডা-মিঠাই বিলির রাজনীতি বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। এখন তাঁর দলই রেউড়ি রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন সেজেছে। প্রধানমন্ত্রীর একটিও নিন্দাবাক্য কেউ শোনেনি। অর্থাৎ তিনিও জানেন, ভোটে জিততে এখন আর লুকিয়ে টাকা দেওয়া নয়, বুক ফুলিয়ে সরকারি ভাবে টাকা বিলোনোর প্রতিশ্রুতিটাই বেশি কার্যকরী।

স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্ন উঠছে যে, এই খয়রাতির রাজনীতিতে জনগণের সত্যিকারের মঙ্গল কতটুকু? তার আগে দেখা যাক, ভোট রাজনীতিকে আজ এই রাস্তায় যেতে হল কেন? কেন সরকারি দলগুলি তাদের কাজকর্মের দ্বারা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারছে না কেন? বিরোধী দলগুলিই বা সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে নিজেদের জনমুখী নীতি ঘোষণার দ্বারা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারছে না কেন? কেন নির্বাচনী ময়দানে মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি– নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, শিক্ষা-চিকিৎসার খরচ বৃদ্ধি প্রভৃতি প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়ার পরিবর্তে কোন দল কত বেশি খয়রাতি দিতে পারবে, তা-ই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠছে?

বাস্তবে ভোটসর্বস্ব দলগুলির নাম এবং পতাকার রঙের কিছু পার্থক্য থাকলেও নীতিগত ক্ষেত্রে ফারাক প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারি দলগুলির যেমন কোনও ভূমিকা নেই, তেমনই এই সব বিরোধী দলগুলিও সরকারকে বাধ্য করার মতো কোনও ভূমিকা নেওয়ার নীতিগত অবস্থানে নেই। যে দল যখনই ক্ষমতায় বসেছে তাদের কার্যকলাপে মানুষ অন্য দলের সঙ্গে কোনও পার্থক্য খুঁজে পায়নি। এই দলগুলি যেমন পুঁজিপতিদের লেজুড়বৃত্তি করে, তেমনই মজুতদার, কালোবাজারিদের সঙ্গে এদের গভীর সখ্যতা। তারাই এদের দলের খরচ, ভোটের খরচ সব জোগায়। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ তাদের দীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছে যে, এই দলগুলির কোনওটিই তাদের স্বার্থে কিছু করবে না। তাই নগদে বা খয়রাতি হিসাবে যার থেকে যতটুকু বেশি পাওয়া যায়, মানুষ সেটুকুকেই প্রাপ্তি বলে মনে করছে। ফলে যে দল বেশি দেবে ভোটও তারই বেশি।

অর্থাৎ দলের নীতি বিচারটা চলে যাচ্ছে পিছনে। তার মানে একটা দল যদি চরম নীতিহীন, দুর্নীতিগ্রস্তও হয়, দলের নেতারা সব যদি পুঁজিপতিদের দালালও হয়, তবু যদি সেই দল খয়রাতি বেশি দিতে পারে, তবে মানুষের সমর্থন সেই দলের পিছনেই যাবে। অর্থাৎ জনগণের স্বাধীন মতামত নয়, দলগুলির টাকার থলি এবং সরকারি টাকা কে কতটা নগদে পাইয়ে দিতে পারছে, তা-ই মতামত তৈরি করে দিচ্ছে। এর মধ্যে কোথাও কি গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও রয়েছে? অথচ এই দলগুলি সবাই দু’বেলা গণতন্তে্রর জয়গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। অবশ্যই জনগণের চোখে ধুলো দিতে।

সংবাদমাধ্যমের একাংশ, অর্থনীতিবিদদের একাংশ এই খয়রাতি রাজনীতির ব্যাপক প্রচার দিয়ে এর জয়গান গাইছে এবং পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে একেই স্বাভাবিক হিসাবে দেখাতে চাইছে। বাস্তবে এই খয়রাতির রাজনীতির দ্বারা জনগণের ট্যাক্সের টাকাই জনগণের হাতে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল মানুষ তার আয়ের বেশির ভাগটাই ভোগ্যপণ্যের পিছনে খরচ করে, তার ফলে সেই টাকা বাজারে পণ্যদ্রব্যের চাহিদা কিছুটা হলেও বাড়াচ্ছে। এর ফলে উৎপাদনে খানিকটা চাঙ্গা ভাব আসছে। ফলে এর দ্বারা মুমূর্ষু পুঁজিবাদকেও কিছুটা অক্সিজেন জোগানো যাচ্ছে।

বাজার চলতি কাগজ এবং সরকারি অর্থে পুষ্ট এই সব অর্থনীতিবিদরা একটা জিনিস অতি সযত্নে গোপন করে যাচ্ছে যে, এর দ্বারা সাধারণ মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলির কোনও সমাধান হবে না। বরং পুঁজিপতি শ্রেণির লাগামছাড়া শোষণ-লুণ্ঠনে তা আরও বাড়তেই থাকবে। খয়রাতি-রাজনীতির দ্বারা জীবনের এই মৌলিক সমস্যাগুলি থেকেই জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-চিকিৎসার লাগামছাড়া খরচবৃদ্ধির তুলনায় এই খয়রাতি কতটুকু! বেশির ভাগ মানুষের স্থায়ী রোজগার না থাকায় সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা হয় না, পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হয় না, মাথার উপর একটা ছাদ স্বপ্নই থেকে যায়। ভোটের কারবারিরা চায় মানুষের এই দুর্দশা স্থায়ী হয়ে থাক, মানুষ ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির অনুগ্রহ-প্রার্থী হিসাবে তাদের অনুগত হয়ে থাকুক। আর একে হাতিয়ার করে এই দলগুলি তাদের দুর্নীতি আর লুঠের রাজনীতি চালিয়ে যাক। এর মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের আত্মমর্যাদার জায়গাটাকেই শুধু মেরে দেওয়া হচ্ছে না, তাদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকু দাবি করার মন এবং তা লড়াই করে আদায় করার মানসিকতাকেও মেরে দেওয়া হচ্ছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খয়রাতির বিপুল অর্থ সরকার জোগাচ্ছে ঋণ করে। সেই ঋণ শোধের টাকা জনগণের উপর কর চাপিয়ে বা মদের বিক্রি, লটারির টিকিট বিক্রি বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করে সরকার। কর বৃদ্ধিতে মানুষের আর্থিক বোঝা যেমন বাড়ে, তেমনই মদের বেশি বিক্রি সমাজ জুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে। তা ছাড়া খয়রাতির পিছনে সরকারের ব্যয় যত বাড়ে, মানুষের যথার্থ উন্নয়নের পিছনে খরচ তত কমে। যেমন, সরকার একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের হাতে ট্যাব তুলে দিচ্ছে, কিন্তু সেই ছাত্রছাত্রীরা যে স্কুলে পড়ে সেখানে শিক্ষকদের ব্যাপক ঘাটতি মেটাচ্ছে না। ফলে অধিকাংশ স্কুলেই নিয়মিত ক্লাস হয় না। স্কুলবাড়িগুলির ভাঙাচোরা দশা, পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি নেই। এই পরিস্থিতিতে ট্যাব নিয়ে ছাত্রাছত্রীরা করবে কী? একই ভাবে হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। প্রশাসনের অন্য ক্ষেত্রগুলিও নিয়োগের অভাবে ধুঁকছে, পরিষেবা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে, খয়রাতির রাজনীতি যে আসলে প্রতারণার রাজনীতি তা যদি আমরা ধরতে না পারি তবে আগামী দিনে এই ফাঁদে আমরা আরও বেশি করেই জড়াতে থাকব।