সব দল ব্যস্ত ভোটের হিসাবে, এসইউসিআই(সি) আন্দোলনে
৩০ জানুয়ারি মহামিছিলে যোগ দিন
ভোটের গন্ধ পেয়েই ভোটবাজ দলগুলির তরজা জমে উঠেছে৷ এ জোট না ও জোট, তাই নিয়ে কতই তোড়জোড়৷ একের পর এক ব্রিগেড সমাবেশের ডাকে সরগরম পশ্চিমবঙ্গ৷ কার মিটিংয়ে কোন শিবিরের কত হেভিওয়েট নেতার আবির্ভাব ঘটবে তা নিয়ে জোর চর্চা সংবাদমাধ্যমে৷ অথচ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারির ধাক্কায় রাজ্যের নিতান্ত সাধারণ খেটে–খাওয়া, ছা–পোষা মানুষের যে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়৷ শীতের সকালেও বাজারে সবজিতে–মাছে হাত দিলে যে আগুন দামের ছ্যাঁকা লাগছে তা নিয়ে হুঁশ নেই এই রঙ–বেরঙের হেভিওয়েট নেতাদের মানুষ চাইছে তাদের জীবনের এইসব জ্বলন্ত সমস্যাগুলির সমাধান, সে সমাধান কি কোনও দলকে নিছক ভোটে জিতিয়ে আসবে? মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে গত সত্তর বছরে অনেক ভোট হয়েছে, নানা রঙের নানা সরকার এসেছে, তাদের জীবনের সমস্যার সমাধান হয়নি৷ তাই মানুষের দাবিগুলি নিয়ে উঠে এসেছে গণ–আন্দোলনের ডাক৷ যে ডাক দিয়েছে আন্দোলনের শক্তি এস ইউ সি আই (সি)৷ এই ডাকে সারা দিয়ে ৩০ জানুয়ারি মহামিছিলে সামিল হবেন রাজ্যের লক্ষাধিক খেটে খাওয়া মানুষ৷
বিজেপি সরকারের আচ্ছে দিনের কারবার এমন চলেছে তাতে আম্বানি–আদানি–টাটা–বিড়লাদের হাতে শোষিত হতে হতে ছিবড়ে হয়ে যাওয়া দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে৷ যার জেরে কমেছে শিল্প–কলকারখানার উৎপাদন৷ এমনিতেই তা কমছিল, এবারে বিগত ১৭ মাসের কমার হারের থেকেও নিচে নেমে গেছে তা৷ এর ফলটা যে কী, তা হাড়ে হাড়ে বোঝেন এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ৷ উৎপাদন যতই কমুক একচেটিয়া মালিকদের মুনাফার পাহাড় এতটুকুও টোল খাবে না৷ কিন্তু নতুন করে ছাঁটাই হবেন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক৷ নতুন করে ঝাঁপ বন্ধ হবে বেশ কিছু কলকারখানার৷ তার শ্রমিকরা কিছুদিন কারখানার দেওয়ালের আশেপাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে বেড়িয়ে অবশেষে অভাবের জ্বালায় প্রথমে ঘটিবাটি বন্ধক দেবেন, তাঁদের ঘরের মেয়েরা অভাবের জ্বালায় নিজের মাংস বেচতে বাজারে লাইন দেবে৷ বন্ধ চা বাগান শ্রমিকের ঘরের মেয়ে থেকে শিশুরা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যাবে মানুষরূপী পশুদের লালসার বাজারে৷ তারপর– এতেও যখন কুলোবে না, শেষ আশ্রয় হবে রেললাইনে গলা দেওয়া, না হলে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়া ভোটের কারবারিরাও তাদের নিয়ে খানিকটা চোখের জল ফেলে একে অপরের বিরুদ্ধে তোপ দাগবেন৷ কিন্তু ভোটে যারাই জিতুক বন্ধ কারখানার–কাজ হারানো ওই সমস্ত শ্রমিকের কোন উপকারটি হবে?
কী কেন্দ্র, কী রাজ্য কোনও সরকারই প্রতিশ্রুতির ফোয়ারায় কিছু কম যায় না৷ এই মোদি সাহেব বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি দিয়ে ফেলছেন, তো রাজ্যের তৃণমূল সরকার এককোটি চাকরি দিয়েই ছাড়ছেন৷ অথচ দিনে দিনে কমছে স্থায়ী কাজের সুযোগ, চাকরি নতুন হবে কি যারা কাজ করছিল তাদের কাজ চলে যাচ্ছে৷ প্রতিদিন বাড়ছে বেকার সংখ্যা৷ কেন্দ্রীয় সরকারের নানা দপ্তর, রেল থেকে শুরু করে রাজ্যের সরকারি চাকরিতে অসংখ্য পদ খালি৷ অথচ উভয় সরকারই সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে৷ সামান্য যা নিয়োগ হচ্ছে তাও অস্থায়ী ক্যাজুয়াল কিংবা ঠিকা হিসাবে৷ সরকারি কাজ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বেসরকারি কোম্পানিকে দিয়ে করিয়ে নেওয়াটাই রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে৷ শিক্ষিত বেকার যুবক–যুবতীরাও সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি দূরে থাক সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে দিনে দিনে ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছেন৷ আশা–অঙ্গনওয়াড়ি–আইসিডিএস কর্মীরা সারা বছর কাজ করে পরিবার প্রতিপালন দূরে থাক, একজনের পেট চলার মতো ভাতাটুকুও পাচ্ছেন না৷ একসময় বেকার যুবক–যুবতীদের সামান্য কিছু বেকারভাতা ভিক্ষার মতো ছুঁড়েও সরকার দিত, এখন সেটুকুও বন্ধ৷ এইসব খেটে খাওয়া মানুষের দাবি কি ভোটের বাক্সে কোনও দিন সমাধান হয়েছে? নাকি আদায় যা হয়েছে আন্দোলনের ময়দানেই৷
ভোটের গন্ধে কৃষক দরদে যেন জোয়ার এসেছে দেশ জুড়েই৷ তাতে কংগ্রেস–বিজেপি–তৃণমূল কেউ কম যায় না৷ অথচ কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম কোথায়? দেশ জুড়েই এখন ধান উঠেছে, একই সাথে উঠছে সবজি–ডাল–পেঁয়াজ এমন কত ফসল৷ আগে ছড়ায়–কবিতায় এই পৌষে চাষির মুখের হাসির কত না ছবি আঁকা হত! অথচ ঠিক এই সময়টাতেই আজ ভারতের হাজার হাজার চাষি পরিবারে হাহাকার৷ ফসল বিক্রি করে তাঁদের খরচটুকুও উঠছে না৷ বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষি, অন্ধ্র–তেলেঙ্গানা–তামিলনাড়ুর ধানচাষি, উত্তরপ্রদেশ–পাঞ্জাবের আখচাষি, হরিয়ানার গমচাষি যেমন সর্বনাশের দোরগোড়ায়, সারা দেশেই চলছে চাষির আত্মহত্যার মিছিল৷ একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের ধানচাষিরাও লাভজনক মূল্য দূরে থাক, সরকারি সহায়ক মূল্যটুকুও পাচ্ছে না৷ সরকার নিজেই রেডিও–টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে স্বীকার করছে চাষিদের নাম করে এই দাম লুটে নিয়ে যাচ্ছে মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়ে–মহাজনরা৷ সরকার ধানকল মালিকদের উদ্দেশে মাঝে মাঝে কাগুজে হুঙ্কার ছাড়ছে, চাষির থেকে ধান কেনার লক্ষমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্যও তাদের কোনও সদিচ্ছা আছে বলে বোঝা যাচ্ছে না৷ ফলে বড় বড় ধানকল মালিক, খাদ্যশস্য ব্যবসায় টাকা ঢালা বড় বড় পুঁজিমালিকদের কারসাজিতে খোলাবাজারে চালের দাম কমার বদলে বাড়ে৷ অন্যদিকে চাষি ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করেই জ্বালা জুড়োতে বাধ্য হয়৷ রাজ্য সরকার নাকি আত্মঘাতী চাষির পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা দেবে৷ অথচ চাষির চাষের খরচ যাতে কমে, সার–বীজ, কীটনাশক, ট্রাক্টরের যন্ত্রাংশ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি চাষিদের যেভাবে শোষণ করে তার বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিলে চাষিকে আত্মঘাতী হত না৷ সরকার চাষিকে সেচের পাম্পের জন্য ডিজেল কিংবা বিদ্যুৎ সস্তায় দেওয়ার বন্দোবস্ত করলে, পরিকল্পনা মাফিক খাল কাটলে চাষির জীবন বাঁচত৷ সে কাজ সরকার করল না৷
চাষিকে ফসলের ন্যায্য দাম পাইয়ে দেবে কে? ঋণমকুবের মিথ্যা ফানুস দেখিয়ে চাষিকে আরও যারা ঋণের জালে জড়াতে চায় তারা? একচেটিয়া মালিকদের হাতে কৃষিপণ্যের পুরো বাজারটাকে যারা খুলে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তারা? কোনও ভোটবাজ দল কি কোনও দিন চাষির চোখের জল মুছিয়েছে? নাকি চাষিকেই দাবি আদায় করতে হয় সংঘবদ্ধ ভাবে এসেছে সেই বিচারের দিন৷
এই পশ্চিমবঙ্গে আজও অনাহারে মানুষ ধুঁকতে ধুঁকতে মরে৷ ১০০ দিনের কাজের মজুরি মেলে না৷ হাসপাতালে গেলে মেলে না চিকিৎসা–ওষুধ৷ অথচ পাড়ায় পাড়ায় মদের স্রোত বইয়ে দেওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত রাজ্য সরকার৷ দরিদ্র সাধারণ পরিবারগুলি ভেসে যাচ্ছে মদের নেশার সর্বনাশা টানে৷ মদ্যপদের হাতে শিশুকন্যা থেকে শতায়ু বৃদ্ধা কারও রেহাই নেই৷ অথচ রাজস্বের লোভে ঢালাও মদের প্রসারেই ব্যস্ত সরকার৷ নারী পাচারে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষ স্থানে আছে৷ রাজধানী দিল্লি সহ সারা দেশেই প্রতিদিন যেমন ধর্ষণ থেকে খুন চলছে, পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়৷ অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতীদের সাজা দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই৷ সব মিলিয়ে চলছে এক শ্বাসরোধকর পরিস্থিতি৷
সিপিএম সরকার তাদের আমলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি এবং পাশ–ফেল প্রথা তুলে দিয়ে একটা বিরাট প্রজন্মের কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছে৷ তৃণমূল ২০১১–তে ক্ষমতায় এসেই কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের করা আইনের দোহাই দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দিয়ে সেই ক্ষতিকে আরও বহুগুণ বাড়িয়েছে৷ সারা দেশেই এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে৷ অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার জনমতের চাপে পাশ–ফেল ফেরানোর কথা কিছুটা হলেও মানতে বাধ্য হয়েছে৷ ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই ডাকা ধর্মঘটের সামনে দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকার এ বিষয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতেও বাধ্য হয়ে ছিল৷ কিন্তু আজও তারা এ নিয়ে কেন্দ্রের দোষ দিয়ে টালবাহানা করে চলেছে৷ এই একটি নীতিতে কোটি কোটি সাধারণ ঘরের ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে গেছে, রাজ্যের বহু বাংলা বা হিন্দি মাধ্যম সাধারণ স্কুলগুলি উঠে যাওয়ার দশায় পৌঁছেছে৷ স্কুলস্তর থেকেই শিক্ষা প্রায় পুরোপুরি বেসরকারি হাতে চলে গেছে৷ শিক্ষা নিয়ে ব্যবসার পথ খুলে রাখতেই কি সরকারের এই কালক্ষেপ এই প্রশ্ন উঠেছে জনমনে৷ আজ দাবি উঠেছে একটি দিনও বিলম্ব নয় সরকার এখনই ঘোষণা করুক প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ– ফেল ফিরিয়ে আনা হবে৷
চাষি, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, খেটেখাওয়া সব স্তরের মানুষের এই জ্বলন্ত দাবিগুলি নিয়ে আজ দরকার তীব্র আন্দোলনের জোয়ার তোলা দেশ জুড়ে৷ বিজেপি এবং কংগ্রেসের একচেটিয়া মালিকদের নির্লজ্জ সেবার নীতির বিরুদ্ধে বামগণতান্ত্রিক শক্তিগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামবে এটাই ছিল আজ সময়ের দাবি৷ অথচ ভোটের বাদ্যি বাজতেই তথাকথিত বৃহৎ বামপন্থীরা হিসাব করতে বসেছে কী করে কিছু সিট বাগিয়ে নেওয়া যায়৷ তার জন্য কংগ্রেস কিংবা জাতপাতবাদী নানা দলের সাথে যে কোনও শর্তে আপসেও তারা রাজি৷ আশার কথা নানা কিছুর মধ্য দিয়ে মানুষ আজ বুঝছে আন্দোলনই পথ, শুধুমাত্র সরকার বদলের খোয়াব দেখে তার কোনও সমস্যার সমাধান হবে না৷ আন্দোলন বারেবারে মাথাচাড়া দিতে চাইছে৷ মধ্যপ্রদেশের কৃষক আন্দোলন, মহারাষ্ট্রের কৃষক আন্দোলন তো এই সত্যকেই দেখিয়ে দিয়েছে৷ অথচ এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া সব দল ব্যস্ত এই ক্ষোভকে আবার ভোটের বাক্সে পুরে ঠাণ্ডা ঘরে জমা করতে৷
তাই ডাক এসেছে আন্দোলনের৷ এসেছে ৩০ জানুয়ারি মেহনতি শ্রমিক–কৃষক–মধ্যবিত্ত সকল স্তরের মানুষের বজ্র নির্ঘোষে তোলা দাবিকে দরিদ্রের কুটির, শ্রমিকের কারখানায়, কৃষকের খেতে, ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সর্বত্র পঁৌছে দেওয়ার ডাক৷ এ ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসছেন হাজার হাজার মানুষ৷ তাঁরা পা মেলাবেন হেদুয়া পার্ক থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত মহামিছিলে৷