হামদি নূরি। বছর কুড়ির এক সুস্থ সবল আফগান জোয়ান ছেলে। কাবুলে বাড়ি। যখন পনেরো বছর বয়স, তখন সে তার যুদ্ধবিধ্বস্ত, হতদরিদ্র, দিশাহীন মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যায়। ইস্কুলে পড়ার বিলাসিতা ছেড়ে সে পার্শ্ববর্তী ইরান পাড়ি দেয় রোজগারের সন্ধানে। এমন হাজার হাজার, শুধু হাজার কেন, লাখ-ছাড়ানো আফগান কিশোর-যুব নূরির মতো ইরান যাত্রা করে। না, কোনও ধর্মের জন্য নয়, স্রেফ দু’মুঠো খাওয়া, আর যতটা পারে পরিবারকে অর্থ জোগানোর জন্য। অবশ্য যদি তাদের পরিবার-পরিজনেরা ততদিনে মার্কিন হানাদার, মৌলবাদী তালিবানি নৃশংস ঘাতক আর যুদ্ধবাজ গোষ্ঠীপতিদের অবিরাম লড়াইয়ে শেষ না হয়ে গিয়ে থাকে।
যাই হোক, ইরানে গিয়ে নূরি এঘাট ওঘাটে ঠোক্কর খেতে খেতে এই কাজ ওই কাজ করতে করতে শেষমেষ এখনকার কাজটা পায়। পাথর কাটার কাজ। একটা বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ, মধ্য ইরানের ইস্পাহান শহরের একটা ফ্যাক্টরিতে। যা মাইনে পেত, চলে যেত, এমনকি কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটিয়ে মাসের শেষে কাবুলে পরিবারের হাতে প্রায় দুশো ডলারের মতো পাঠাতে পারছিল আটজনের পরিবারের কাছে তার দাম ছিল অনেক।
কিন্তু এ সুখও বেশিদিন সইল না। এল এক মারণ অসুখ, করোনা ভাইরাস, কোভিড-১৯। কিছুদিনের মধ্যে ইরানে হু হু করে ছড়িয়ে গেল করোনা অতিমারি। লোক মরতে লাগল মশামাছির মতো। আর তাল মিলিয়ে বন্ধ হতে লাগল কল-কারখানা-অফিস। নূরির কাজটাও চলেগেল, উঠে গেল ফ্যাক্টরিটাই। লাখ দুয়েক আফগানের মতো নূরি রওনা হল দেশের দিকে। ইরান তখন বিশ্বে প্রথম সারির করোনা-আক্রান্ত দেশ। সেখান থেকে নূরিরা চলল এমন এক দেশে যেখানে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা দূরে থাক, তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর ন্যূনতম ক্ষমতাটুকুও নেই। তবু তো নিজের দেশ– এইসব ভাবছিল কুড়ি বছরের ছেলেটা। তার সব স্বপ্নটপ্ন আফগানিস্তান-ইরানের গরম হাওয়ায় উবে গিয়েছে। মনে পড়ল একটা ভারতীয় ছেলের কথা। সে চাকরি করছে তারই দেশে, আফগানিস্তানে। বিরাট চাকরি। তাদের দেশটাকে তো বোমা মেরে মার্কিনিরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয়রা সাহায্য করছে আবার গড়ে তুলতে। ছেলেটা ছুটিতে ইরান বেড়াতে এসেছিল, যা মাইনে পায় বলল শুনে নূরির মাথা ঘোরার জোগাড়। সে কয়েক বছরেও তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারবে না। নূরি কথা না বাড়িয়ে সরে পড়েছিল। ভাবল সে কথা, আর বর্ডারের লাইনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার হাড়- হাভাতে, দেশে ফিরতে ইচ্ছুক মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ল, ছেলেটা বলেছিল তোমাদের আফগানদের দেখতে খুব সুন্দর হয়। যেমন ফর্সা রং, তেমন লম্বা-চওড়া। মনে মনে ছেলেটাকে বলল, ঠাট্টা করছ? দেখ তো ওই লোকগুলোকে, চোখ আর নাক ছাড়া ওদের কোথাও সৌন্দর্য আছে? হঠাৎ নূরির মনে হল এই যে এত বাচ্চা, বুড়ো, মেয়েরা লাইনে দাঁড়িয়ে, এদের শরীরে যদি ভাইরাস ঢুকে থাকে? কী করে বাঁচবে ওরা? ভেবে থই পায় না নূরি, কারণ সে জেনেছে তার দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল কী। শুনেছে ইতিমধ্যে ২৭৩ জন নিশ্চিত করোনা-আক্রান্তের মধ্যে ২১০ জন ইরান ফেরত। ৪ জন মারাও গিয়েছে। নূরি এসব জেনে গিয়েছে, তাই তার মনে হল এই তা হলে বিশ্বায়ন। কিন্তু এর ধাক্কায় যদি এইভাবে হাজার হাজার মানুষ দেশে ফেরে তো সর্বনাশ। এদিকে ইরানেরও এক অবস্থা, তারা ঠিকই করেছে দশ লাখের মতো অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আফগানকে ফেরত পাঠাবে। যারা একবার ইরান থেকে আফগানিস্তানে ফিরেছে, তারা যাতে আর ইরানে ঢুকতে না পারে তার ব্যবস্থা করেছে। তাদের নিজেদের দেশে এখন ৫৮০০০ আক্রান্ত, ৩৬০০ মৃত।
নূরি যখন এইসব ভাবছে, তখন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ মাইগ্রেশন (আইওএম)দেখিয়েছে যে এ’বছর প্রায় দু’লাখ আফগান ইরান থেকে ফিরেছে, যার মধ্যে কেবল মার্চ মাসে ফিরেছে দেড় লাখ। যখন এই বাড়িমুখো মানুষের ঢল নেমেছিল, সে সময় একদিনে ১৫০০০ পর্যন্ত লোক সীমান্ত পেরিয়েছে। আইওএম এদের জন্যে তাঁবু খাটিয়েছে, যাদের যাওয়ার জায়গা নেই তাদের কম্বল দিয়েছে, বাকিদের যাওয়ার ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আফগান সরকার বাবেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতাই নেই এদের করোনা পরীক্ষা করার, জ্বর দেখার বা কোয়ারান্টাইনে পাঠানোর। প্রায় সবাই গণপরিবহণের সাহায্যে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে, বেশিরভাগই সীমান্ত ঘেঁষা হেরাট প্রদেশে। এদের মধ্যে সংক্রমণের বা সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা যে কতখানি, ভাবলে ভয় লাগে। নূরি দেখে এদের মধ্যে তার মতো অগুন্তি ছেলে রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত নূরি কাবুলে তার বাড়ি পৌঁছায়। অভিজ্ঞতা তাকে অনেক বড় করে দিয়েছে। তাই ১৭ মার্চ বাড়ি পৌঁছাবার পর সে দুসপ্তাহের জন্য সেল্ফ আইসোলেশন বেছে নেয়, নিজেকে আলাদা করে রাখে। বাড়ির লোকজন, বিশেষ করে ছোট ভাইবোনগুলো বুঝে উঠতে পারছিল না, কেন তারা দাদার কাছে যাবে না। তাই সাংবাদিককে নূরি শেষ কথা বলে সে যে কী অবস্থা কী বলব। আমার জীবনে সবচেয়ে খারাপ সময় গিয়েছে ওই কটা দিন। ক’বছর পরে বাড়ি ফিরলাম, অথচ বাবা, মা, দাদি, ভাইবোন সকলকে দেখতে হচ্ছে দূর থেকে। যাক শেষ পর্যন্ত সামলেছি, কিন্তু এরপর কী হবে?
প্রশ্ন করে নূরি উত্তরের আশায় সাংবাদিকেরচোখের দিকে তাকায়। তিনি চোখ নামিয়ে নেন, তারপর পেশাদারি গলায় বলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
(দ্য স্টেটসম্যান, ৭ এপ্রিল ২০২০)