বিজেপি সরকারের নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ।’ কিন্তু ধনী-দরিদ্রে আর্থিক বৈষম্য যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে এই স্লোগান দিতে এখন বিজেপি নেতাদেরই ঢোক গিলতে হচ্ছে। তারা ভুলেও তা উচ্চারণ করছেন না।
একদিকে একচেটিয়া পুঁজি-মালিকদের সম্পদ অস্বাভাবিক হারে ফেঁপে উঠছে। অন্য দিকে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক, যাঁরা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা প্রতিদিন পরিণত হচ্ছেন হতদরিদ্রে। তাহলে দেশের কোটি কোটি শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষ কঠোর পরিশ্রমে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ তৈরি করছে, তা যাচ্ছে কোথায়?
সম্প্রতি আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়ার প্রকাশিত, ২০২১-এর ধনীদের তালিকায় আদানিরা এখন ভারত তথা এশিয়ারও দ্বিতীয় ধনীতম পরিবার। করোনার আবহেই গত এক বছরে শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং তাঁর পরিবারের প্রতিদিনের আয় ১০০২ কোটি টাকা। সম্পত্তি ১,৪০,২০০ কোটি টাকা থেকে এক লাফে ২৬১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫,০৫,৯০০ কোটি টাকা। করোনা অতিমারির আগে দেশে ১০০ কোটি টাকার উপর সম্পদের মালিক ছিল ৫৮ জন, কিন্তু অতিমারিতেই সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ জন। অর্থাৎ বিপুল সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের হাতে।
প্রশ্ন হল, দেশে এমন কোন ব্যবসা রয়েছে যেখানে ২৬১ শতাংশ মুনাফা হয়? আইনসম্মত যে কোনও ব্যবসায় ২০ শতাংশ মুনাফা হলেই তার পরিমাণ বিপুল বলে ধরা হয়। তা হলে আদানিদের এই বিপুল মুনাফা কি আইনি পথে নয়? অর্থাৎ তার সবটাই বেআইনি? অবশ্য এমন সন্দেহের গুরুতর কারণ রয়েছে। প্রথমত, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নীতির ফলে, যা কংগ্রেস সরকারের আমল থেকেই চলে আসছে, তাতে দেশের একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা অবিশ্বাস্য হারে মুনাফা করে চলেছে। এই নীতির ফল হিসাবেই দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদের মালিকানা কুক্ষিগত হয়েছে মাত্র ১ শতাংশের হাতে। করোনা অতিমারির মধ্যেও বিজেপি সরকার মালিকদের জন্য ঢালাও আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করছে, বকেয়া কর মকুব করে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে চলেছে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি সরকারের সঙ্গে আদানিদের ঘনিষ্ঠতা কারও অজানা নয়। গুজরাটে শূন্য থেকে আদানিদের উত্থান নরেন্দ্র মোদির মুখ্যমন্ত্রীর সময় থেকে। তারপর মোদিজিরও যেমন হাউই গতিতে উত্থান হয়েছে আদানিদের উত্থানও তেমনই একই গতিতে হয়েছে। ফলে আম্বানিদের মতো আদানিরাও যেমন বিজেপির পিছনে টাকা ঢেলেছে তেমনই প্রথমে গুজরাট সরকার, পরে ভারত সরকারও আইনি-বেআইনি সমস্ত পথেই আদানিদের ঢালাও লুটের সুযোগ করে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় পরিবেশবিদদের সমস্ত আপত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে আদানি যে কয়লাখনি কিনেছে তার খরচ মেটাতে প্রধানমন্ত্রী স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানকে সেখানে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ ৬ হাজার কোটি টাকার নামমাত্র সুদে খনি বরাদ্দ করে দিয়েছে। সেই কয়লা এ দেশে রপ্তানি করে লুট চালানোর জন্য কয়লার সঙ্কটের গল্প ফলাও করে প্রচার চলছে। বিজেপি সরকারি সম্পত্তি জলের দামে আদানিদের হাতে তুলে দিয়েছে। তাদের মুনাফার জন্য পুরনো আইন বদলে দিয়েছে, নতুন আইন তৈরি করেছে। বিজেপি সরকারের আনা নতুন কৃষি আইন পাশের অনেক আগেই কৃষিপণ্যের ব্যবসায় বিপুল অঙ্কের টাকা ঢেলে বসে আছে আদানি গোষ্ঠী। এর থেকে পরিষ্কার এই আইন আম্বানি আর আদানিদের জন্যই। অর্থাৎ আদানিদের এই বিপুল মুনাফা একেবারেই আইনি পথে নয়, সরকারের সাথে যোগসাজশে দেশের জনগণকে ফাঁকি দেওয়ার, প্রতারণা করার ফল।
সম্প্রতি গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার হেরোইন ধরা পড়েছে। এই হেরোইন নাকি আফগানিস্তান থেকে ইরান হয়ে মুন্দ্রা বন্দরে এসেছে। প্রশ্ন হল, এই হেরোইন আমদানিতে বন্দর মালিক আদানিদের ভূমিকা কী? তদন্তের স্বার্থে আদানিদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না কেন? এই মাদক তো সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে যুবসমাজকে আসক্ত করত। এর আগেও এ ভাবে মাদক এসেছে কি না, এলে কতবার এসেছে, তাতে বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কী, এগুলি নিয়ে অবিলম্বে তদন্ত করার দায়িত্ব কি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নয়? কেন তদন্ত করা হচ্ছে না? এই পথেই কি তা হলে আদানিদের এই ২৬১ শতাংশ মুনাফা এসেছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর দেশবাসীকে জানানো কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব। সরকার তা জানাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল বিজেপি সরকারের ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, বাস্তবে ‘কুছ কা বিকাশ’, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিকাশ।