এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনায় শিক্ষা ও সমাজ পরিচালনার দাবিতে লড়াই করছে এ আই ডি এস ও৷ ২৭ জুলাই তাদের এক প্রতিনিধিদল রাজ্য সহ সভাপতি কমরেডস শামসুল আলম ও মনিশঙ্কর পট্টনায়কের নেতৃত্বে আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম জনাব ইমদাদুল্লা রসিদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ কয়েক মাস আগে সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহত সন্তানের শবযাত্রীদের উদ্দেশে যিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের দ্বারা যদি একজন মানুষকেও আমার মতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, আমি এই মসজিদ ছেড়ে চলে যাবো৷’
সারা দেশ সেদিন অতি সাধারণ এক মসজিদের অনামী এক ধর্মীয় ব্যক্তির এই ভূমিকাকে কুর্নিশ জানিয়েছিল৷ ধর্মীয় অন্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই সম্পর্কে তাঁর চিন্তা চেতনার সাথে আরও গভীরে পরিচিত হওয়া এবং মত বিনিময়ের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেদিন৷ ওই দিন ভোর সাড়ে চারটায় ইমাম ফোন করে বললেন, আসানসোল জলে ভাসছে, আপনারা কী করে আসবেন? কিন্তু যে দুর্যোগ ইমাম ইমদাদুল্লা সাহেব সামলেছেন, বিক্ষুব্ধ প্রতিহিংসার তোড়কে যে দৃঢ়তায় তিনি রোধ করেছেন, তার তুলনায় জলের এই স্রোত এমন কী? প্রতিনিধি দল পৌঁছে গেল আসানসোল৷
ইমাম সাহেব দরজা থেকেই স্বাগত জানালেন পাঁচ প্রতিনিধিকে৷ অত্যন্ত সাধারণ অপরিসর একটি কামরা, কিছু ধর্মীয় বইপত্র আর কিছু বিছানা সামগ্রী৷ ঘরে কোনও আসবাব নেই, মেঝেতে পাতা বিছানায় বসালেন সবাইকে, নিজেও বসলেন৷ প্রতিনিধিরা এআইডিএসও–র সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালেন৷ পুষ্পস্তবক, সংগঠনের প্রকাশনা, নবজাগরণের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক প্রেমচন্দের সাহিত্য এবং সংগঠনের একটি স্মারক তাঁর হাতে তুলে দেন৷ ইমাম সাহেবের ভূমিকার প্রশংসা করতেই, তিনি বলে ওঠেন, ‘দেখুন অনেকে বলছেন আমি অসাধারণ কাজ করেছি, কিন্তু আমি মনে করি একটা বোধের পরিচয় দিয়েছি আমি৷ অন্য যে কোনও মানুষ আমার জায়গায় থাকলে তাই করত৷ ধর্মীয় শিক্ষার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশকে আমার জীবনে জীবন্ত করে তুলেছি মাত্র৷ আমি যে যন্ত্রণা ভোগ করছি তা অন্য কাউকে সহ্য করতে দিতে পারি না৷ রাস্তায় চলতে গিয়ে যে কাঁটা আমাদের রক্তাক্ত করে, তাকে পথ থেকে সরিয়ে দিই, যে পাথরে আহত হই, তাকে সরিয়ে দিই যাতে পরবর্তী যাত্রীকে সমান অসুবিধা ভোগ করতে না হয়– এ তো সাধারণ মানবিক বোধ৷ প্রতিটি ধর্মের প্রাণ হল মানবিকতা৷ তা হারিয়ে গেলে ধর্ম বিশ্বাসের আর থাকে কী? আমি খুবই আনন্দিত যে আমার ধর্মীয় শিক্ষা থেকে যে বার্তা দিতে চেয়েছিলাম তা আজ সারা দেশে পৌঁছেছে৷ মানবিকতাই আমাকে আজ এত মানুষের ভালোবাসা গ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছে৷ আমি চাই সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ অতীতের মতোই শান্তির দুর্গ হয়ে থাক৷ এই দাঙ্গার ছকও অত্যন্ত পূর্ব পরিকল্পিত৷ চেষ্টা হয়েছিল সন্ত্রাসের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ায় হিংসার পরিবেশ সারা বাংলায় ছডিয়ে পডুক’৷
এলাকার উভয় ধর্মের কিছু মানুষ বার বার তাঁর কাছে এসেছেন, আবেদন করেছেন তিনি যাতে অভিযোগ দায়ের করেন৷ এমন সম্ভাবনাময় সন্তান তাঁর, মৃত্যুর পর মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে, ভালো ফল করেছে, তাঁর হত্যাকারীদের শাস্তি হওয়া উচিত৷ তিনি বলেছেন, ‘এই পরিকল্পিত হামলার দুষ্কৃতীরা অতি স্বাভাবিক ভাবেই এলাকাতে নেই, তাছাড়া আমি প্রত্যক্ষদর্শীও নই৷ এমন অবস্থায় আমি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনলে, শুধু ভিন্ন ধর্মাচরণ করে বলেই কিছু ব্যক্তির জীবনে অশান্তি নামবে৷ আমি চাই না আমার কোনও ভাইয়ের সাথে এমন হোক’৷ তারপর বললেন অসাধারণ একটি কথা, ‘এখানকার কয়েকজন উত্তেজিত যুবক দু’জন হিন্দু যুবককে ধরে আনল, বলল আমার সন্তান সিবঘাতুল্লাকে ফেরত পেলে তবেই এদের ছাড়া হবে৷ আমি বললাম, তোমরা আমাকে যদি ভালবাস, এদের ছেড়ে দাও৷ এদের সাথে কোনও অন্যায় আমি বরদাস্ত করব না’৷
তারপর আত্মমগ্ন ভাব কাটিয়ে প্রতিনিধিদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘আপনারা সবাই যুবক, এত উদ্যোগ নিয়ে আপনারা এসেছেন, সামাজিক কাজের মন থেকে এসেছেন৷ আপনারা যেভাবে দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবছেন, ফ্রি কোচিং, ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প করছেন, অন্যান্য বহু বিষয় নিয়ে লড়াই সংগ্রাম করছেন, আমি আপনাদের প্রতি শুভ কামনা ব্যক্ত করছি৷ মনে রাখবেন, মহৎ কাজের সামনে অনেক বাধা আসে, অপপ্রচার হয়, কিন্তু সত্যের পথে অটল থাকবেন, চূড়ান্ত জয় সত্যেরই’৷
বিদায় পর্বে ইমাম দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন এআইডিএসও প্রতিনিধিদের৷ পাশের ঘর থেকে পড়ুয়াদের কোলাহল খুব জোর হয়ে উঠেছিল৷ ইমাম বছর ১৭–এর এক কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অনেক সন্তানের পিতা আমি, আমার এক সন্তানকে হারিয়েছি, এরা আছে৷ পাশেই মাদ্রাসা নিয়মিত পড়াই ওদের’৷ ডি এস ও–র প্রতিনিধিদের একজন অস্ফূট স্বরে বলে উঠল, ‘যতদিন ধর্মীয় পরিবেশের এই বাস্তবতা আছে, যতদিন ধর্মের চেয়ে উন্নত নৈতিকতার প্রকৃত রূপটা আমরা সাম্যবাদীরা জনগণের সামনে দৃশ্যমান করতে না পারছি ততদিন এই অসংখ্য কিশোর যেন এক এক জন ইমদাদুল্লা হয়ে ওঠে’৷
(৭১ বর্ষ ২ সংখ্যা ১০ আগস্ট, ২০১৮)