‘অনেকে বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক আখ্যা দিয়েছেন’’, এর উত্তরে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ‘‘নাস্তিক হলে কি চিঠির উপর নিয়মিত লিখতে পারতেন ‘শ্রীশ্রীহরিঃশরণম?’’ (‘বড় কাজ একাই করতে হয়’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬–৯) শিক্ষাপ্রসার ও সমাজসংস্কারের মধ্য দিয়ে মানুষকে সামন্তযুগীয় কূপমণ্ডূকতা ও অন্ধতা থেকে মুক্ত করে আধুনিক মানুষে পরিণত করাই ছিল বিদ্যাসাগরের জীবনের লক্ষ্য৷ এ কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন, সমাজে এই অন্ধকারের শক্তি কত গভীর৷ তাই তাঁকে প্রতিটি পদক্ষেপ করতে হয়েছে অতি সাবধানে৷ এমন কোনও হঠকারিতা করেননি, যাতে হিন্দু সমাজপতিরা বৃহত্তর সমাজ থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে৷
ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিনিধিরা ধর্মীয় এবং সামন্তী বন্ধন ভেঙে ফেলা সত্ত্বেও, উগ্রতার জন্য কী ভাবে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তা তিনি দেখেছিলেন৷ তাই সামাজিক আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক৷ সমাজে মিশে থাকার প্রয়োজনে অহেতুক উগ্রতা পরিহার করেছেন৷ এই জন্যই তিনি পৈতা রেখেছেন, চিঠির উপর শ্রীশ্রীহরিঃশরণম লিখেছেন৷
কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে, প্রতিটি আচার–আচরণে তিনি পুরোপুরি খাঁটি হিউম্যানিস্ট হিসাবেই থেকেছেন৷ কোনও ধর্মীয় আচার পালনের দিকে যাননি৷ এমনকি কাশীতে গিয়ে বিশ্বেশ্বর মন্দিরেও যাননি৷ বিদ্যাসাগর দেখালেন, ধর্মকে বাদ দিয়েও উন্নত সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে উঠতে পারে এবং সমাজে আজ এই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন৷ একজন বলিষ্ঠ সেকুলার হিউম্যানিস্ট হিসাবে বিদ্যাসাগর মনে করতেন, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় এবং ধর্মবিশ্বাসীর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর আঘাত করা উচিত নয়৷ কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে, সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক মূল্যবোধের আর কোনও প্রয়োজন নেই৷ বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস প্রসঙ্গে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য বলেছিলেন, বিদ্যাসাগর ‘নাস্তিক’ ছিলেন৷ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ওই এক রকমের নাস্তিক ছিলেন, যাকে বলে অজ্ঞেয়বাদী৷ নিজে বলেছেন, ‘‘ধর্ম যে কী, তাহা মনুষ্যের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোনও প্রয়োজন নাই৷’’
বিদ্যাসাগর নিজে ধর্মবিশ্বাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন কিন্তু তাঁর মধ্যে ধর্মবিদ্বেষ ছিল না৷ ব্রাহ্ম, খ্রিস্টান, মুসলমান নির্বিশেষে সকলকেই মানুষ হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদা তিনি দিতেন৷ সেকুলার মানবতাবাদীদের এইটিই নীতি৷ শিবনাথ শাস্ত্রী ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম হয়ে গেলেও বিদ্যাসাগরের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি৷ মাইকেল খ্রিস্টান হয়ে গেলেও তা–ই৷ রামমোহন ধর্ম সংস্কারের মধ্য দিয়েই সংস্কারমুক্ত একটা জীবনচর্যা প্রতিষ্ঠা করার, ধর্মের কাঠামোর মধ্যেই যত দূর সম্ভব বিচারমূলক যুক্তিবাদ ও মানবকেন্দ্রিক মূল্যবোধ আনার চেষ্টা করেছিলেন৷ রামমোহন বেদান্তের শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করে তার ভিত্তিতেই ধর্মসংস্কার করতে চেষ্টা করেছেন৷ ধর্মীয় মূল্যবোধকে বাদ দেননি৷
বিদ্যাসাগর চিন্তাক্ষেত্রে এই জায়গায় ছেদ ঘটালেন৷ তিনি বললেন, সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শন হিসাবে ভ্রান্ত৷ এইখানেই রেনেসাঁসের পরিমণ্ডলের মধ্যে একটা গুণগত পরিবর্তন আনলেন বিদ্যাসাগর৷ সত্য সম্পর্কে যুক্তিবাদী ধারণা প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল৷ তাই তিনি জন স্টুয়ার্ট মিল এর লজিক পড়াতে বলেছিলেন৷ মিল ছিলেন মূলত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী৷ সংস্কৃত কলেজে ছাত্রদের মিলের লজিক পড়ানো এবং পাশ্চাত্যের অধ্যাত্মবাদী বিশপ বার্কলের দর্শন না পড়ানোর জন্য সুপারিশ করার মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগর নিজের চিন্তা ও ভাবধারার একটি বিশেষ পরিচয় রেখেছেন৷ দ্বিশতজন্মবর্ষে স্মরণ করার সময় বিদ্যাসাগর চরিত্রের এই মহামূল্যবান বৈশিষ্ট্যটি যেন আমরা ভুলে না যাই৷ সুতরাং বলতেই হচ্ছে, কবি শঙ্খ ঘোষের উপলব্ধি সঠিক নয়৷
সমরেন্দ্র প্রতিহার, কলকাতা – ৪
(৯ অক্টোবর আনন্দবাজার ই–পেপারে এই চিঠিটি প্রকাশিত হয়৷ সময়োপযোগী ও মূল্যবান মনে করে তা প্রকাশ করা হল৷)