নির্বাচনে জিতে ২০ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার মসনদে বসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার ৪ দিনের মধ্যেই ২৪ ফেব্রুয়ারি আমেরিকায় ব্যাপক শ্রমিক কর্মচারী ছাঁটাই শুরু হল। ওপিএম এবং ডিওজিই নামের দুটি নবগঠিত সরকারি দফতর থেকে কর্মচারীদের কাছে একটি ই-মেল যায়। তাতে বলা হয়েছিল, দু’দিনের মধ্যে সাপ্তাহিক কাজের রিপোর্ট দিতে না পারলে চাকরি থেকে তাদের ছাঁটাই করে দেওয়া হবে। সরকারের খরচ কমাতেই গণহারে কর্মী ছাঁটাই বলে জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ছাঁটাইয়ের আতঙ্কে সরকারি কর্মচারীরা দিশেহারা। এই ছাঁটাই কর্মসূচিতে যোগ্য সঙ্গত দিতে মাঠে নেমে পড়েছেন সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে নিযুক্ত ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম পরামর্শদাতা, মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক।
সরকারি ওই দুটি সংস্থা ইতিমধ্যেই মার্কিন গোয়েন্দা দফতর এফবিআই সহ অন্যান্য দফতরের কর্মীদের ব্যাপক হারে বরখাস্ত করেছে। কিছু কর্মীকে স্বেচ্ছাবসরের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, অনেক শিক্ষানবিশ কর্মীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ইস্তফাপত্র। প্রায় ৩০ হাজার ‘প্রবেশনার’ সরকারি কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এ ছাড়াও প্রায় ৭৫ হাজার কর্মী সরকারের দেওয়া স্বেচ্ছাবসরের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি, গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রায় ২৮০০ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের ৪৩০০ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪০০ জন ন্যাশনাল ফরেস্ট সার্ভিসেসের দায়িত্বে ছিলেন, যারা আমেরিকার প্রায় ২৯ কোটি একর জমির দেখভাল করতেন। এ ছাড়া ডিপার্টমেন্ট অব হাউসিং অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্টের ৫০ শতাংশ কর্মীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চাকরি গিয়েছে ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টিরিয়র থেকে ২৩০০ জনের। ন্যাশনাল ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিসেসের প্রায় সব কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগে রাতারাতি বরখাস্ত করা হয়েছে ৮০০ কর্মীকে।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বলে পরিচিত আমেরিকার এ অবস্থা কেন? ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বারে বারে ‘বন্ধু’ বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গলা জড়িয়ে ধরছেন, সে দেশের অর্থনীতিকে ‘মডেল’ করে ভারতকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দেশের মানুষকে, তখন সেখানেই লক্ষ লক্ষ কর্মীকে রাতারাতি ছাঁটাই হতে হচ্ছে কেন? আমেরিকায় রয়েছে কাজের নিরাপত্তা, ভাল বেতন ও নানা সুযোগ-সুবিধা– এক কথায় নিশ্চিত জীবনের হাতছানি, এ দেশের মানুষ এমন শুনতেই অভ্যস্ত। আমেরিকায় বেকার সমস্যা নেই বলে দেশ-বিদেশের় সংবাদমাধ্যমগুলিও দিনরাত কোরাস গেয়ে চলে। সেই আমেরিকার এই হাঁড়ির হাল কেন?
বাস্তবে আমেরিকাও আভ্যন্তরীণ বাজার সংকটে জর্জরিত। পুঁজিবাদী তীব্র শোষণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত নামছে। আমেরিকার সাধারণ মানুষের ভয়াবহ অবস্থাটা করোনা পরিস্থিতি গোটা বিশ্বের সামনে বেআব্রু করে দিয়েছে। চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন হাজারে হাজারে। আভ্যন্তরীণ বাজার সংকট আমেরিকান অর্থনীতিকে সামরিক অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। এখন বিশ্ববাজারেও তার একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাটা পড়ছে। রাশিয়া, চিন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিগুলি বিশ্ববাজারে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। তা ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকার বিপুল ব্যয় ও ইজরায়েলকে অস্ত্র সাহায্য দেশের আভ্যন্তরীণ আর্থিক সঙ্কটকে বাড়িয়ে তুলেছে। মার্কিন অস্ত্র কোম্পানিগুলি এর দ্বারা বিপুল মুনাফা করলেও রাজকোষ ফাঁকা হয়ে গেছে। আর তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে সাধারণ মার্কিন জনগণকে।
সরকারের ব্যয়সঙ্কোচ নীতিতে প্রথম কোপ পড়েছে সরকারি কর্মীদের ঘাড়ে। এই কর্মীরা কি কখনও ভেবেছিল তাঁদের এ ভাবে ছাঁটাই হতে হবে? স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে? তারা সরকারি নিয়ম-নীতি মেনেই শ্রম দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মেই আজ তারা বেকার, ছাঁটাই শ্রমিক। কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা যত ক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে, তত সামরিক শক্তির উপর তার নির্ভরশীলতা বাড়ছে, তত সে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, তত সে মারমুখী হচ্ছে, তত সে নিষ্ঠুর হচ্ছে, তত সে বর্বর হচ্ছে। এ ভাবেই সে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থের পায়ে জনগণের স্বার্থকে বলি দিচ্ছে। এই শ্রমিক-কর্মচারীদের সামনে এখন করণীয় কী? দুটি পথ খোলা। জরুরিভিত্তিক প্রয়োজন হল আইনের দ্বারস্থ হওয়া। বেশ কয়েকটি শ্রমিক ইউনিয়ন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সানফ্রান্সিসকোর আদালতে মামলা করলে বিচারক বলেছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও আইনই ওপিএম-কে সরকারি দপ্তরের কর্মী ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা দেয়নি। যদিও ইতিমধ্যেই ছাঁটাই হয়ে যাওয়া কর্মীরা কী করবেন সে বিষয়ে আদালত কিছু বলেনি। পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপরিকাঠামো হিসাবে আদালত এর বেশি কিছু বলতে পারে না। এখানেই তার সীমাবদ্ধতা। তা হলে ছাঁটাই শ্রমিকদের সামনে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন করা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা থাকল না।
আমেরিকায় ব্যাপক হারে ছাঁটাই দেখিয়ে দিল পুঁজিবাদী সংকট এত তীব্র যে, ভারত তো দূরের কথা, বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ আমেরিকারও তার হাত থেকে রেহাই নেই।