প্রধানমন্ত্রী গত ১১ মে, দীর্ঘ ৪৮ দিনের লকডাউনে বিধবস্ত জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার মন্ত্র শোনানোর সাথে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের গল্প শুনিয়ে নিজে তার হিসাব দাখিলের ‘লোভ সংবরণ’ করে তা দাখিলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর অর্থমন্ত্রীকে। আর এত বড় হিসাব একদিনে দেওয়া অসম্ভব বলেই হয়ত বা অর্থমন্ত্রী ‘সাময়িক পত্রে বৃহৎ উপন্যাসের ধারাবাহিক প্রকাশ’-এর মতো বেশ ক’দিন ধরে লাগাতার সাংবাদিক সম্মেলনে নানা ক্ষেত্রের হিসাব দেওয়ার পর চতুর্থ দিনে ধরলেন কৃষিক্ষেত্রকে।
করোনার এই সংকটকালে সংস্কার ও সাহায্যের নামে অর্থমন্ত্রী চাষিদের জন্য যা ঘোষণা করলেন তা প্রহসন বললেও কম বলা হয়।
করোনা-সংকটে কোনও রকম আগাম সরকারি ব্যবস্থা না করে, সাধারণ জনগণকে কোনও রকম প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ চার ঘন্টার নোটিশে প্রধানমন্ত্রীর লকডাউন ঘোষণা করায় চমক থাকলেও তার জন্য অন্যান্য গরিব খেটে খাওয়া মানুষের মতোই কঠিন মূল্য চোকাতে হয়েছে চাষিকেও। ফুল, পান, টমাটো, লঙ্কা, অন্যান্য সবজি এবং ফল চাষিরা লকডাউন ঘোষণার সময়ে তাদের তোলা ফসল এবং খেতের তোলার যোগ্য ফসল বিক্রি করতে না পেরে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তার ওপর এই লকডাউন কালেই ঝড়বৃষ্টিতে ধান এবং অন্যান্য ফসলও নষ্ট হয়েছে। হাট বাজার বন্ধ থাকায় ধান বিক্রিও অনেকে করতে পারেননি। ফসলের দাম না পেলে অন্যান্য বছর নায্য দামের দাবিতে আন্দোলন যতটুকু হয়, আর তার ফলে সরকারও যতটুকু নড়েচড়ে বসে, এবার করোনা-আবহে সে দাবি তোলার সুযোগও ছিল না ।
চাষির জীবনের এমন একটি কঠিন সময়ে আপাতত বাঁচার জন্য নগদ টাকা সাহায্য এবং পরবর্তী ফসল চাষের জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল বিনামূল্যে বীজ-সার-সেচের সরকারি ব্যবস্থা– যা যে কোনও সভ্য সরকারেরই দায়িত্ব এবং একান্ত কর্তব্য।
অথচ কেন্দ্রীয় সরকার আপতকালীন সুরাহার এসব তো কিছু করলই না, উপরন্তু কৃষিক্ষেত্রে সাহায্যের নাম করে কর্পোরেট পুঁজিকে চাষির উপর লুন্ঠন চালানোর নতুন নতুন ছাড়পত্র দিল।
এতদিন চাষি যে ফসলের খুব ভাল দাম পেত, তা নয়। ফসলের নায্য দাম পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলি তাদের নূ্যনতম দায়িত্বও কোনওদিন পালন করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষিপণ্য বাজার কমিটি আইনে কর্পোরেট হাউস বা বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কৃষিপণ্যের বাজারের উপর একচেটিয়া দখলদারি থেকে আটকানোর ব্যবস্থা ছিল। কৃষিপণ্য বাজার কমিটি নিজেরা ফসলের ক্রেতা ছিল না, ছিল চাষির ফসল বিক্রি এবং ব্যবসায়ীর ক্রয়ে সমন্বয়কারী। সেখানে চাষি সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের চাষির স্বার্থ তুলে ধরার সুযোগ ছিল। নতুন ব্যবস্থায় সেই স্বার্থরক্ষার দাবি তোলার সুযোগ চাষির কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দেওয়া হবে ক্রেতা ব্যবসায়ীদের।
নতুন ব্যবস্থায় ফসল ক্রয়ে কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় যারা বিপুল পুঁজি নিয়ে আসরে নামবে, তারা সহজেই অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের ব্যবসার তল্পি গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য করবে। মাণ্ডির সাথেই ক্রেতা-ব্যবসায়ীর জন্য ব্যবস্থা থাকবে গুদাম ও হিমঘরের। অথচ এমন নিয়ম তো থাকবে না যে চাষি মাণ্ডিতে ফসল আনলে তা কিনতে বাধ্য থাকবে ব্যবসায়ীরা। তাহলে চাষির স্বার্থ কিভাবে রক্ষিত হবে? তার কোনও উত্তর নেই। অথচ নতুন আইনের পক্ষে গালভরা কথায় বলা হচ্ছে ‘চাষির স্বাধীনতা থাকবে যেখানে ভাল দাম পাবে সেখানে বেচবার’।
কৃষিক্ষেত্রে এ দিনের ঘোষিত সংস্কারে অর্থমন্ত্রী আরও ঘোষণা করেছেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করা হবে। কি ছিল সেই আইনে? অত্যাবশ্যক পণ্যের মধ্যে কৃষিজ পণ্য চাল, ডাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল, তৈলবীজ প্রভৃতি যত ইচ্ছে মজুত করা যাবে না। মজুতদারি করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টিও করা যাবে না। এতে শুধু চাষিরা নন, সমস্ত সাধারণ মানুষও উপকৃত হত। কালোবাজারি মজুতদারি ঠেকাতে এই আইনটি ছিল খুবই কার্যকরী। কিন্তু বহুদিন ধরেই এই আইনটির প্রতি সরকারের প্রবল অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছিল। এবার লকডাউনের সুযোগটি নিয়ে আইনটিকেই লোপাট করার কাজে ব্যবহার করা হল। আইনটি সংশোধন করা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা ও রপ্তানিকারী সংস্থাগুলিকে একসঙ্গে অনেক খাদ্যশস্য মজুত করতে হয়। নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা বাড়বে, আরও লগ্নি আসবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হল, এতে চাষির কোন স্বার্থটি রক্ষা হবে? মজুতদারি কালোবাজারিকেই কি এর দ্বারা মদত দেওয়া হবে না?
চাষিকে তার গোলা বা মাঠ থেকে ফসল বাজারে আনার জন্য পরিবহণে কোনও সুবিধা না দিলেও অর্থমন্ত্রী ‘অপারেশন গ্রিন’ নামে আরেকটি প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। তাতে বলেছেন, আলু পেঁয়াজ টমেটোর মতো খাদ্যশস্য সরবরাহ ও সংরক্ষণে ৫০ শতাংশ ভরতুকি দেবে সরকার এবং এর জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দও করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ-ও যে সেই কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ীদের জন্যই মোদী সরকারের আরেকটি উপহার!
চাষির চাষে কোনও রকম সাহায্যের ঘোষণা অর্থমন্ত্রী না করলেও কৃষি পরিকাঠামো নির্মাণে তিনি এক লক্ষ কোটি টাকার ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছেন। এই টাকা ঋণ হিসাবে দেবে নাবার্ড। সহজেই অনুমেয়, পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য এই ঋণও কোনওভাবেই চাষির জন্য নয়। অর্থাৎ২০ লক্ষ কোটি টাকার করোনা-আর্থিক প্যাকেজে চাষির জন্য বরাদ্দ শূন্য!
তাহলে এখন খেয়ে বাঁচতে এবং আগামী চাষের জন্য চাষির হাতে টাকা আসবে কোথা থেকে? সাংবাদিক সম্মেলনে এর উত্তরে মোদীজির একান্ত অনুগত অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা হাতে টাকা পাইয়ে দেওয়ার বদলে ক্ষমতায়নের উপর জোর দিচ্ছি, যাতে গরিব চাষিরা নিজেদের রোজগার বাড়াতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্র মেনে আত্মনির্ভর হতে পারেন।’ অর্থাৎ মোদীজির রাজত্বে কর্পোরেট হাউসের জন্য লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মকুব হবে, তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার ট্যাক্সে ছাড় মিলবে, তাদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে বিপুল টাকা সরকারি অনুদান মিলবে। তাদের শিল্প ও ব্যবসার পরিকাঠামোও পাবে সরকারের কাছ থেকে। শুধু ‘আত্মনির্ভর’ হতে হবে হতদরিদ্র চাষিদের! এই হল মোদী সরকারের নীতি!
এমন প্রতারক ও দুর্বৃত্তের সরকারকে কি চাষিরা ক্ষমা করতে পারে?