পরাধীন ভারতে রাজনৈতিক নেতাদের দেশবাসী ‘সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী’র মতো মনে করত৷ স্বাধীনতার পরও জনগণ ‘নেতা’ বলতে বুঝত স্বার্থহীন, দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির একজন মানুষ, যার কাছে গরিব–নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্ত মানুষের কল্যাণ করাটাই জীবনের ব্রত৷ একেবারে সাধারণ স্তর থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের জন্য আন্দোলনে নিয়োজিত এই সমস্ত নেতারাই ভোটে জিতে সাংসদ, বিধায়ক হতেন৷ আজও হয়ত অনেক সাংসদ–বিধায়ক খাদির পাজামা–পাঞ্জাবি পরেন কিন্তু চরিত্রের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিও তাঁদের যেমন নেই তেমনই তাঁদের অধিকাংশই আজ বিপুল অর্থের মালিক৷ তাই আজ বিশ্বের ১১৯টি ক্ষুধার্ত দেশের মধ্যে ১০৩ তম স্থানে থাকা আমাদের দেশের আইনসভা আলোকিত করে রয়েছে শুধুমাত্র কোটিপতি সাংসদ–বিধায়করাই নন, অনেক শিল্পপতি–কর্পোরেট পুঁজির মালিকরাও৷
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের পর ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস’ (এডিআর) প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, বিজেপি ও কংগ্রেসের ৮৩ শতাংশ, বিএসপির ৩৩ শতাংশ, সিপিএমের ৩৬ শতাংশ, আপের ৬০ শতাংশ, টিআরএসের ১০০ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি৷ এর মধ্যে বিজেপির ২৬৫ জন, কংগ্রেসের ৪৩ জন, তৃণমূল কংগ্রেসের ২০ জন সাংসদ কোটিপতি৷ এবারের লোকসভার সদস্যদের গড় সম্পদ ২০ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা৷ ৫ কোটি টাকার বেশি সম্পত্তি রয়েছে ২৬৬ জন সাংসদের৷ ১৫টি রাজ্য এমন যেখান থেকে শুধুমাত্র কোটিপতিরাই সাংসদ হয়েছেন৷ নতুন মন্ত্রীসভার ৫৮ জনের মধ্যে ৫১ জন কোটিপতি৷ মন্ত্রীদের গড় সম্পত্তি ১৪.১২ কোটি টাকা৷ মন্ত্রী হরসিমরত কাউর বাদলের সম্পত্তির পরিমাণ ২১৭ কোটি টাকা৷ সবচেয়ে ধনী সাংসদ মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথের পুত্র নকুল নাথ৷ সম্পত্তির পরিমাণ ৬৬০ কোটি টাকা৷ দেশের গরিব মানুষের কথা বাদ দিন, একজন সাধারণ করদাতাকে সাংসদের সমান সম্পত্তির মালিক হতে গেলে ৩৪৬ বছর সময় লাগবে৷ ২০১৪ সালে এটাই ছিল ২৯৯ বছর৷ অর্থাৎ গত ৫ বছরে ৪৭ বছরের ব্যবধান বেড়ে গেছে৷ তা হলে কার ‘সুদিন’ নরেন্দ্র মোদি নিয়ে এসেছেন সহজেই অনুমান করা যায়৷
সাল কোটিপতি সাংসদ শতকরা হার
২০০৯ ৩১৫ জন ৫৮ শতাংশ
২০১৪ ৪৪৩ জন ৮৩ শতাংশ
২০১৯ ৪৭৫ জন ৮৮ শতাংশ
শুধু তাই নয়, রিপোর্টে আরও দেখা যাচ্ছে, নবনির্বাচিত ৫৪২ জন সাংসদের মধ্যে ২৩৩ জনের এবং মন্ত্রীসভার ২২ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ ঝুলছে৷ এই ২৩৩ জনের মধ্যে বিজেপির ১৬৬ জন, কংগ্রেসের ২৯ জন, তৃণমূল কংগ্রেসের ৯ জন৷ এদের মধ্যে ১৫৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, ধর্ষণ, কিডন্যাপ, নারীপাচার, অস্ত্র ব্যবসার মতো মারাত্মক অভিযোগে মামলা পর্যন্ত চলছে৷ শুধু সাংসদ নয় দেশের বিধানসভাগুলির হালও একই রকম এবং তা ক্রমবর্ধমান৷
সাল অভিযুক্ত সাংসদ মারাত্মক ধারায় অভিযুক্ত
২০০৪ ১২৯ জন ৫৮ জন
২০০৯ ১৬২ জন ৭৬ জন
২০১৪ ১৮৫ জন ১১২ জন
২০১৯ ২৩৩ জন ১৫৯ জন
সংসদে ‘জনস্বার্থে’ যাঁরা শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করছেন তাঁরা কারা, সমাজের কোন অংশের প্রতিনিধি, ২০০৪ সালের আগে তা জানার উপায় ছিল না৷ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলিও চায়নি জনগণ তা জানুক৷ ১৯৯৯ সালে এডিআর দিল্লি হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলায় দাবি জানায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ফৌজদারি অভিযোগ–মামলা এবং তার সম্পত্তির পরিমাণ জানাতে হবে৷ কোর্ট এই আবেদন মেনে নিলে সেই সময় বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায়৷ সমস্ত সংসদীয় দল সরকারের পক্ষে দাঁড়ায়৷ সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্টের রায়কে বহাল রাখলে দেশের ২২টি রাজনৈতিক দল সর্বদলীয় বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় এই রায়কে চালু করতে দেওয়া যাবে না৷ গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী দলগুলি সংগঠিতভাবে ‘আইনকে আইনের পথে’ চলতে না দিয়ে ‘রিপ্রেজেন্টেশন অফ পিপলস অ্যাক্ট’ বদলে দেয়৷ এডিআর এর বিরুদ্ধে আবার সুপ্রিম কোর্টে যায় এবং ১৩ মার্চ ২০১৩ দেশের সর্বোচ্চ আদালত আগের রায় বহাল রাখে৷ এরপর থেকে প্রতিটি প্রার্থীর দুটি এফিডেবিট দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়, একটা তার অপরাধ সম্বন্ধে অপরটি ধন–সম্পত্তি বিষয়ে৷
সংসদ যদি কোটিপতি–শিল্পপতি দিয়েই ভরে যায় তো দেশের গরিব শ্রমিক–কৃষক–মেহনতি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে কারা? সংসদে দুই শ্রেণির স্বার্থের লড়াইয়ে তাদের স্বার্থে লড়বে কারা? সংসদে বর্তমান বিজেপি সরকার শ্রম আইন সংস্কারের জন্য বিল আনতে চলেছে৷ এই সব কোটিপতি–শিল্পপতি সাংসদরা এই বিল বিতর্কে তাঁদের নিজেদের স্বার্থে লড়বেন, না শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থে লড়বেন? কিংবা জমি অধিগ্রহণ বিল এলে শিল্পের নামে নির্বিচারে কৃষকের জমি দখলের প্রশ্নে তাঁরা শিল্পপতিদের পক্ষ নেবেন, নাকি কৃষকদের পক্ষ নেবেন? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তাঁরা নিজেদের এবং নিজেদের শ্রেণির স্বার্থই দেখবেন৷ স্বাভাবিক ভাবেই দেশের ৯৯ ভাগ শোষিত–বঞ্চিত শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষের স্বার্থে লড়াই করার জন্য সংসদে কেউ রইল না৷ এখন, যে দলগুলি থেকে এই সব কোটিপতি–শিল্পপতিরা নির্বাচিত হচ্ছেন, তারা এঁদের নির্বাচনে প্রার্থীপদ দেয় কেন? দেয়, কারণ নির্বাচনটা এখন জনমতের রায় নেওয়া নয়, জনমত তৈরি করা এবং তা কেনার বিষয়৷ এর জন্য এই দলগুলি স্রোতের মতো টাকা খরচ করে৷ কিন্তু এত টাকা আসে কোথা থেকে? তা কি তারা জনগণের থেকে সংগ্রহ করে? না, সে টাকা জোগায় এই সব পুঁজিপতি–শিল্পপতির, যার বেশিরভাগটাই ‘কালো টাকা’৷ এবারের লোকসভা নির্বাচনে খরচ হয়েছে একটা মোটা হিসেবে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা৷ বিজেপি খরচ করেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা, কংগ্রেস ৯ হাজার কোটি টাকা৷ ভোট কিনতে, ভোটের প্রচারে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে এই টাকা খরচ করা হয়েছে৷ এখন ভোট মানেই এই কালো টাকার খেলা৷ স্বাভাবিক ভাবেই এই দলগুলিও দেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বের কথা বলে বাস্তবে পুঁজিপতি শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করে৷
নির্বাচিত এই সব কোটিপতি–শিল্পপতিরা সাংসদ হিসাবে, মন্ত্রী হিসাবে যে আইন কিংবা নীতি প্রণয়ন করবেন তা কি তাঁদের নিজেদের বিরুদ্ধে গিয়ে, নিজেদের শ্রেণির বিরুদ্ধে গিয়ে দেশের কোটি কোটি শোষিত–বঞ্চিত শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে? পারে না৷ পারে না বলেই, স্বাধীনতার পর থেকে ১৭ বার লোকসভা নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও, অনেক সরকার বদলানো সত্ত্বেও, শাসক দলের রঙ বদলানো সত্ত্বেও কংগ্রেসের ‘গরিবি হঠাও’ কিংবা বিজেপির ‘আচ্ছে দিন’ কোনও কিছুই বাস্তবায়িত হল না৷ বরং গরিবিও বেড়ে চলেছে, মানুষের দুর্দশাও বেড়ে চলেছে৷
একটা সময় ছিল যখন শিল্পপতিরা তাদের পছন্দের বা অনুগত রাজনৈতিক দলগুলিকে অর্থ সাহায্য দিত কিন্তু নিজেরা রাজনীতিতে প্রবেশ করত না, থাকত পর্দার আড়ালে৷ পুঁজির যত বিকাশ হতে থাকল, সম্পদ তত মুষ্টিমেয়ের হাতে কুক্ষিগত হতে থাকল৷ মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর ‘গরিবের উন্নয়ন’, ‘জনগণের উন্নয়নের’ ঠাটটুকুও আর থাকল না৷ এখন উন্নয়নের মানে শুধুমাত্র দেশি–বিদেশি কর্পোরেটের স্বার্থ রক্ষা৷ জল–জমি–জঙ্গল–জী থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে উৎখাত করে প্রাকৃতিক সম্পদ যা দেশের সাধারণ মানুষের সম্পত্তি তাকে মুষ্টিমেয় দেশি–বিদেশি কর্পোরেটের লুটের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করা৷ স্বাভাবিক ভাবেই ‘জনগণের প্রতিনিধি’– এই ঠাটটুকু রাখারও আর প্রয়োজন হচ্ছে না৷ শিল্পপতিরা নিজেরাই কিংবা নিজেদের ঘনিষ্ঠ কাউকে সাংসদ হিসাবে জিতিয়ে আনছে৷ তৈরি হচ্ছে ব্যবসায়ী রাজনৈতিকদের এক নতুন গোষ্ঠী তথা চক্র৷
তাই রাজ্যসভায়, লোকসভায় কোটিপতি, শিল্পপতি, কর্পোরেটদের ভিড় বাড়ছে৷ শুধু সাংসদ হিসাবেই নয়, তাঁরা মন্ত্রী হয়ে, সংসদীয় বিভিন্ন কমিটিতে স্থান পাচ্ছেন৷ এইভাবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা কর্পোরেটরা নিজেদের প্রয়োজনে আইন বদলে নিচ্ছে, নিয়ম–নীতি–পরিকল্পনা ঠিক করছে৷ চলছে দেশজুড়ে অবাধ লুঠ আর এই সব চলছে সংবিধান, আইনের শাসন–গণতন্ত্রের নামে৷ এই অবাধ লুঠের সাথেই কোটিপতি সাংসদদের স্বার্থ জড়িত৷ সেই স্বার্থ বজায় রেখে দেশের ভুখা মানুষের কথা কী করে ভাববেন তাঁরা৷
শোষিত জনগণকে বুঝতে হবে, যত দিন যাবে ততই পুঁজির দাপট বাড়তে থাকবে, ততই সংসদে কোটিপতি–শিল্পপতি সাংসদ আরও বাড়বে৷ আর তত বেশি করে সংসদ পুঁজিপতি শ্রেণির লেজুড় হয়ে উঠবে৷ এই সংসদীয় ব্যবস্থাকে অটুট রেখে কেবল ভোট দিয়ে সরকার বদলে জনগণের দুরবস্থা বদলানো বা কোনও কল্যাণ কোনও ভাবেই সম্ভব নয়৷ সংসদীয় ব্যবস্থা আর কোনও ভাবেই জনস্বার্থকে রক্ষা করবে না৷ আজ ন্যূনতম পরিমাণ জনস্বার্থ রক্ষা করতে হলেও দরকার শ্রমিক–কৃষক–শোষিত সাধারণ মানুষের ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন৷ এ নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি শাসক শ্রেণিরই সুবিধা করে দেবে৷