৫৩ জন মানুষের মৃত্যু ও প্রায় সাড়ে পাঁচশো মানুষের আহত হওয়ার ঘটনার পর নীরবতা ভাঙলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ১১ মার্চ সংসদে দাঁড়িয়ে অমিত শাহ দিল্লি হত্যাকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে তাঁর দপ্তরের অধীন দিল্লি পুলিশকে ঢালাও সার্টিফিকেট দিলেন। বললেন, মাত্র ৩৬ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ যেভাবে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করেছে তা প্রশংসনীয়। কার্যত ঢাল-তরোয়াল নিয়ে তৈরি হয়েই সেদিন সংসদে এসেছিল শাসক পক্ষ। অমিত শাহের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে গেছেন বিজেপি সাংসদ মীনাক্ষী লেখি, তেজস্বী সূর্যরা। সকলেই এক সুরে দিল্লি হত্যাকাণ্ডের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, তারাই হামলা চালিয়েছে, সংখ্যাগুরুরা চুপচাপ মার খেয়েছে। সংসদে শাসক পক্ষ আরও যে কথাটি বলেছে সেটি হল, এই সংঘর্ষ ষড়যন্ত্র করে বাধানো হয়েছিল।
দিল্লির এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের টুকরো টুকরো ছবি প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বয়ান অনুযায়ী সাজালে এর পিছনে থাকা ষড়যন্ত্রটি একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায়। বোঝা যায়, সংসদে দাঁড়িয়ে একমাত্র এই ষড়যন্ত্রের কথাটিই সঠিক বলেছেন শাহ-কোম্পানি, তবে উল্টো দিক থেকে। বাকি পুরোটাই অসত্য ভাষণ ছাড়া অন্য কিছু নয়। ঠিক ফ্যাসিস্টদের কায়দায় গলার জোরে সেই অসত্যকে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা সেদিন চালিয়ে গেছেন তাঁরা সংসদে, যে সংসদের চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে ক্যামেরার সামনে গণতন্তে্রর প্রতি ভক্তির আতিশয্য দেখানোর নাটক করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, কয়েক বছর আগে।
রক্তাক্ত সেই দিনগুলিতে কেমন ছিল পুলিশের ভূমিকা? ইন্ডিয়া টুডে টিভির সাংবাদিকরা দিল্লির বিধ্বস্ত এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখেন। ২৭ ফেব্রুয়ারির রিপোর্টে তাঁরা জানিয়েছেন, সর্বত্রই সংঘর্ষবিধ্বস্ত আতঙ্কিত মানুষ একটিই কথা বলেছেন– সংঘর্ষ যখন চলছিল, পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয় দর্শক। মৌজপুর, জাফরাবাদ, চান্দ বাগ, যমুনা বিহার সহ সংঘর্ষবিধ্বস্ত এলাকাগুলি ঘুরে দেখছিলেন সাংবাদিকরা। সর্বত্রই পোড়া গাড়ির কঙ্কাল, ভাঙা কাচের টুকরো, পুড়ে যাওয়া দোকানপাটের ধ্বংসস্তূপ আর ভীতসন্ত্রস্ত, সব-হারানো মানুষের হতবিহ্বল মুখ। সেদিন পুলিশ আর কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের থিকথিকে ভিড় চোখে পড়েছিল সাংবাদিকদের। আর পুলিশের দিকে আঙুল তুলে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত মানুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলা শুরু হওয়ার পর কোথায় ছিলেন এইসব শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা? এই অঞ্চলে যখন বাইরে থেকে ধেয়ে আসা গুন্ডাবাহিনী পাথর ছুঁড়ছিল, রাস্তায় ফেলে নৃশংস ভাবে পিটিয়ে মারছিল নিরীহ পথচারীদের, পেট্রল বোমা ছুঁড়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল একের পর এক দোকানঘর, ভাঙচুর চালাচ্ছিল এলাকা জুড়ে, তখন পুলিশ কী করছিল? আক্রান্ত মানুষের ১৩ হাজার ২০০টি ফোন গিয়েছিল পুলিশের কাছে। একটিবারের জন্যও উত্তর মেলেনি। ভজনপুরা এলাকার একটি পেট্রল পাম্পে লুটপাট চালানোর পর আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। মালিক কোনক্রমে পালিয়ে বেঁচেছেন। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, পুলিশ সেদিন তাঁদের বলেছিল– ‘তোমাদের যা ইচ্ছে তাই করো, ওদেরও যা ইচ্ছে তাই করতে দাও। আমরা কিছু করতে পারব না, অর্ডার নেই’।
পাশের যমুনা বিহারে পুড়ে যাওয়া এক রেস্তোরাঁর মালিক শুনিয়েছেন সেই ভয়ঙ্কর দিনের কাহিনী– দুষ্কৃতীরা কীভাবে পেট্রল বোমা ছুঁড়ে তাঁর শাটার-ফেলা দোকানে আগুন লাগায়। সেইসময় উপস্থিত পুলিশের কাছে তাঁরা কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। বলেন, অন্তত শূন্যে গুলি চালাক তারা, যাতে দুষ্কৃতীরা ভয় পায়। কিন্তু অর্ডার না থাকার অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে।
আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন চান্দ বাগের সংঘর্ষবিধ্বস্ত এক মানুষ। তাঁর থাকার ঘর ও রোজগারের একমাত্র সম্বল ফলের দোকানটি পুড়িয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। তিনি জানিয়েছেন, পুলিশের সামনেই গুন্ডাবাহিনী সেদিন নাগাড়ে পাথর ছুঁড়ছিল। বাধা দেওয়া দূরে থাক, পুলিশ উল্টে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। চরম ঘৃণার সাথে ওই হতভাগ্য মন্তব্য করেছেন– ‘নেতারা নিজেদের স্বার্থে মানুষের মনে বড্ড বেশি বিষ ভরে দিয়েছে’।
বাস্তবে মুসলিম বিদ্বেষের এই বিষ ফেনিয়ে তোলার কাজ বরাবরই করে আসছেন আরএসএস-বিজেপি নেতারা। সাম্প্রতিক দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, সাংসদ প্রবেশ বর্মা, কপিল মিশ্রের মতো বিজেপি নেতারা সভায় সভায় কীভাবে সেই বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, তা অনেকেরই জানা। অথচ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নীরব থেকেছেন। পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে। এমনকি বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে সামান্য এফআইআর পর্যন্ত দায়ের করা হয়নি। পরিস্থিতি এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল যে দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি মুরলীধর নিজের অধিকার প্রয়োগ করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেন, অবিলম্বে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়ানো বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে। কিন্তু হায় রে দেশের বিচার ব্যবস্থা, নির্দেশ দানের দিনই গভীর রাতে তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়!
এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সময়ে একটিবারের জন্যও কিন্তু দেখা মেলেনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন যথারীতি নিশ্চুপ। ঘটনা শুরু হওয়ার তিন দিন পর তিনি টুইটারে শান্তি বজায় রাখার কথা বলেন। প্রশ্ন হল, শান্তি স্থাপনের দায়িত্ব কাদের ছিল? কেন্দ্রীয় সরকারেরই তো! দিল্লির পুলিশবাহিনী তো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন! অথচ সংঘর্ষের পুরো সময়টা একটি বারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেখা পেল না কেন অসহায় অত্যাচারিত মানুষজন? প্রধানমন্ত্রীর পর কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ হেন এক মন্ত্রী দিল্লির সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা সত্তে্বও কী করে দিল্লি পুলিশ নিষ্ক্রিয় দর্শকের নির্লজ্জ ভূমিকা, এমনকি কোথাও কোথাও দুষ্কৃতীদের সাহায্যকারীর ভূমিকা নিতে পারল? এ সব থেকে কি এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক নয় যে, আসলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের অঙ্গুলি হেলনেই ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হয়ে ছিল দিল্লি পুলিশ?
প্রশ্ন আরও আছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আগের দিন রাতে দুই পক্ষের অবস্থানস্থলের মাঝখানে দু’ট্রাক ভর্তি ইটপাথর ফেলে গিয়েছিল কেউ। পুলিশ তাদের আটকায়নি কেন? ঝকঝকে জাফরাবাদ মেন রোড থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব দিল্লির রাস্তাগুলিতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পাথর, ইট কোথা থেকে এল? স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকে আক্রান্ত এলাকার গা-ঘেঁষে থাকা উত্তরপ্রদেশের লোনি থেকে একের পর এক ম্যাটাডর ভর্তি লোক এসে ঢুকেছিল এলাকায়। পরিস্থিতি যে ক্রমে ঘোরালো হয়ে উঠছে, যে কোনও সময় হিংসার ঘটনা ঘটে যেতে পারে, আঁচ করতে পেরেছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। পুলিশের কাছেও অবশ্যই খবর ছিল। তা সত্তে্বও বিন্দুমাত্র সচেষ্ট হয়নি পুলিশ। কেন? কেন তারা সন্দেহজনকদের, বাইরে থেকে আসা মানুষদের ধরপাকড় শুরু করেনি? নজরদারি, পাহারাদারি বাড়ায়নি কেন? শুধু তো তাই নয়, দুষ্কৃতীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংখ্যালঘুদের দিকে পুলিশের পাথর ছোঁড়ার ভিডিও-ছবিও তো প্রকাশ্যে এসে গেছে! ফাঁস হয়ে গেছে রাস্তায় ফেলে সংখ্যালঘু যুবককে নির্মম ভাবে পেটাতে পেটাতে জোর করে ‘জনগণমন’ গাইতে বলার হিংস্র পুলিশি উল্লাসের ছবিও। সিএএ-এনআরসি বিরোধী উত্তাল বিক্ষোভে বিচলিত কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের তরফে সংখ্যালঘুদের ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য পুলিশ-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থাকে জড়িয়ে একটা জোরদার ষড়যন্ত্র যে হয়েছিল, এসব ঘটনা সামনে আসার পর তা তো আর গোপন থাকে না!
এত কিছুর পরেও সংসদে দাঁড়িয়ে বিজেপি সাংসদ মীনাক্ষী লেখি সেদিন নাম ধরে ধরে দেখানোর চেষ্টা করে গেছেন যে আক্রান্ত হয়েছে সংখ্যাগুরুরাই, যার অসত্যতা সংবাদমাধ্যমেই ফাঁস হয়ে গেছে। কপিল মিশ্রের ঘৃণা-ওগরানো ভাষণের নিন্দা করা দূরে থাক, তাঁর পক্ষে দাঁড়ানোর অপচেষ্টা চালিয়ে গেছেন লেখি। আর স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি হত্যাকাণ্ডে মৃত ও আহতদের ধর্মভিত্তিক সংখ্যা উল্লেখ করতে আপত্তি জানিয়়েছেন। সাধু সেজে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘হিংসায় মৃত-আহতদের নিয়েও ধর্মের বিভাজন করব!’ কী হাস্যকর এঁদের কৌশলী কপটতা! ধর্মের বিদ্বেষ ছড়িয়ে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে, তাদের খুন করে, সর্বস্বান্ত করে আজ তাঁরা এসেছেন ধর্মনিরপেক্ষ সাজতে! আসলে মৃতদের ধর্মভিত্তিক সংখ্যা ঘোষণা করলেই তো ধরা পড়ে যাবে তাঁদের মিথ্যাচার। কারণ, ইতিমধ্যেই সামনে এসে গেছে যে এ পর্যন্ত নিহত ৫৩ জনের মধ্যে দুই পুলিশকর্মীকে বাদ দিলে ৪০ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। অথচ যে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ঘটেছে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড, সেখানে জনসংখ্যার মাত্র ২৯ শতাংশ মুসলিম।
ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো, তাকে কেন্দ্র করে হিংস্র বর্বরতা এবং শেষে দায় মুছে ফেলতে নির্লজ্জ মিথ্যাচার– এই হল ফ্যাসিস্ট বিজেপির চরিত্রবৈশিষ্ট্য। সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তাঁর দলীয় সাংসদদের বক্তব্য থেকে এ কথা আরও একবার দেশের মানুষের সামনে এল। এখনই সচেতন ও সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। ফলে সময় এসেছে এই দুষ্টশক্তিকে চিনে নেওয়ার ও দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবন থেকে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার।
(তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২, ১৩ মার্চ ‘২০, ইন্ডিয়া টুডে ওয়েব ডেস্ক, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ‘২০)