চলতি শিক্ষাবর্ষে কলেজগুলিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরও প্রায় ৪০ হাজার আসন ফাঁকা বলে জানিয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩১টি কলেজে অনার্স সহ বর্তমান আসন সংখ্যা ১ লক্ষ ৩০ হাজার৷ এর মধ্যে ৬০ হাজার সংরক্ষিত আসন৷ সংরক্ষিত আসনের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার আসনই ফাঁকা৷ এর সাথে ৫ হাজার অসংরক্ষিত ফাঁকা আসন যুক্ত হয়ে ৪০ হাজার আসনে কোনও ছাত্র ভর্তি হয়নি৷
এ চিত্র শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়৷ রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ সহ মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে প্রচুর সংরক্ষিত আসন ফাঁকা থেকে যাচ্ছে ফি বছর৷ কেন বিপুল পরিমাণ আসন ফাঁকা থাকছে? রাজ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক ছাত্রের সংখ্যা কমছে? না, তা নয়৷ একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, এ রাজ্যে বিভিন্ন কলেজগুলিতে সংরক্ষিত আসনের সিংহভাগই এসসি–এসটি সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য৷ এছাড়াও ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্রছাত্রী ও কিছু গেমস কোটার জন্য সংরক্ষিত রয়েছে৷
অন্যান্য রাজ্যের মতোই, এ রাজ্যেও এসসি–এসটি সম্প্রদায়ভুক্ত কয়েক কোটি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়৷ স্বাধীন ভারতে এই মানুষগুলিকে শিক্ষা ও চাকরিতে সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষণের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল যাতে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটিয়ে এদের মূল স্রোতে নিয়ে আসা যায়৷ এই উদ্দেশ্যেই কেন্দ্রে ও রাজ্যগুলিতে পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নয়ন বিষয়ক আলাদা মন্ত্রক রয়েছে৷ কিছু সুবিধা এই মন্ত্রকগুলি থেকে দেওয়াও হয়৷ কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? প্রচারের ঢক্কানিনাদ ও উন্নয়নের হাজারো ফিরিস্তির মধ্যেই এদের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত নিম্নগামী হচ্ছে৷ রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলির দিকে তাকালেই চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যায়৷ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, বর্ধমান প্রভৃতি জেলাগুলিতে উন্নয়নের ঢাক বাজাতে বাজাতে রাজ্যের সরকারি নেতা–মন্ত্রীরা বার বার হাজির হচ্ছেন৷ বিজেপি তো আবার প্রধানমন্ত্রীকে এনে সভাও করেছে৷ কিন্তু এসব কোনও কিছুই আদিবাসী পরিবারের দুর্দশা ঘোচাতে পারেনি৷
জীবন–জীবিকার কোনও সুনির্দিষ্ট সংস্থান এঁদের সামনে নেই৷ উদয়াস্ত বনে–জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে অথবা নিজেদের শ্রম যে কোনও মূল্যে অন্যের কাছে বিক্রি করে, দিন মজুরি খেটে যে অর্থ এঁরা উপার্জন করেন তা দিয়ে দু’বেলা ভাল করে খাওয়ার সংস্থানও হয় না৷ বছরে সব দিন কাজও থাকে না৷ রুটি–রুজির স্থায়ী সংস্থানের মধ্য দিয়ে এই পরিবারগুলিকে বাঁচানোর কোনও তাগিদ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেই দেখা যাচ্ছে না৷ নুন আনতে পান্তা ফুরানো এই মানুষগুলির কাছে ছেলেমেয়েদের সুক্লে কলেজে পাঠানো নিছক বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়৷ এই জেলাগুলির শিক্ষার পরিকাঠামোও অত্যন্ত অনুন্নত৷ নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক বা ক্লাসরুম৷ ফলে মেধা থাকা সত্ত্বেও বহু ছাত্রছাত্রী সরকারি শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত৷ অধিকাংশেরই বই, খাতা, শিক্ষা সামগ্রী কেনা বা টিউশন পড়ার সামর্থ্য নেই৷ সর্বোপরি ছেলেমেয়েরা একটু কর্মক্ষম হলেই সংকটগ্রস্ত পরিবারগুলি তাদের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করে দেওয়ার কথা ভাবতে থাকে৷ অথচ এদের জন্যই কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস চাকরির পরীক্ষা ও মেডিকেল–ইঞ্জিনিয়ারি কোর্সে সরকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে৷ এই মানুষগুলিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে তুলে আনা বা এঁদের জীবনে মানোন্নয়নের যে প্রয়োজন ছিল তা না করে সরকারগুলি উপরতলায় এঁদের জন্য কিছু সংরক্ষণ করে রেখেছে৷
কিন্তু ওই জায়গায় পৌঁছবার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনই করতে পারছে না তারা তীব্র দারিদ্রের কারণে৷ সংরক্ষণের যতটুকু সুবিধা তা লুটে নিচ্ছে ধনীরা, সাধারণ মানুষ যে তিমিরে সে তিমিরেই৷ ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ৩৫ হাজার সংরক্ষিত আসন ফাঁকা থেকে গেল৷
এর সাথে যুক্ত হয়েছে কলেজে কলেজে ব্যাপক তোলাবাজি৷ শাসকদলের ছাত্রসংগঠন টিএমসিপি–র নেতারা ভর্তি হতে আসা ছাত্রছাত্রীদের মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার টাকা দিতে বাধ্য করছে৷ তোলা আদায়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একই দলের দু’পক্ষের মধ্যে চলছে ব্যাপক মারপিট৷ কলেজে কলেজে সন্ত্রাসের পরিবেশ বিরাজ করছে রাজ্য জুড়ে৷ এমতাবস্থায়, যোগ্য বহু ছাত্রছাত্রী ভর্তি হতে পারেনি৷ ফলে অসংরক্ষিত প্রায় ৫ হাজার আসনও ফাঁকা থেকে গেল৷
(৭১ বর্ষ ১ সংখ্যা ৩ আগস্ট, ২০১৮)