৭ নভেম্বর ‘২২ সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারকের সাংবিধানিক বেঞ্চ ৩-২ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ১০৩তম সংবিধান সংশোধনীতে সায় দিয়েছে। ফলে ছাড়পত্র পেয়ে গেছে সরকারি চাকরি ও সরকারি- বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন করে ইডব্লুএস (ইকনমিক্যালি উইকার সেকশন) কোটার নামে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কেন্দ্রীয় আইন। যারা এতদিন চালু থাকা এসসি,এসটি, ওবিসি সংরক্ষণে অন্তর্ভুক্ত নন, তাদের ‘অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল’ (ইডব্লুএস) অংশ এই ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন। এটা পুরনো এসটি, এসসি, ওবিসিদের জন্য সংরক্ষিত ৪৯.৫ শতাংশ আসনের অতিরিক্ত। অর্থাৎ এই সংশোধনীর বলে চাকরি এবং শিক্ষার নানা স্তরে ৫৯.৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণের আওতায় এসে গেল।
এসসি, এসটি, ওবিসিদের মধ্যে আর্থিকভাবে দুর্বল অংশ এই নতুন সংরক্ষণের আওতায় আসবেন না। যে কারণে এই সংরক্ষণকে অনেকেই তথাকথিত উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ বলেও চিহ্নিত করছেন। যে কোনও সংরক্ষণ নীতি চালু হওয়ার পরেই তার পক্ষে বিপক্ষে নানা তর্ক বিতর্ক হতে থাকে। এবারের সংরক্ষণেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একদল বলছেন, জাতপাত ভিত্তিক সংরক্ষণই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর এক দলের মতে জাতপাত ভিত্তিতে নয়, আর্থিক মাপকাঠির ভিত্তিতে সংরক্ষণ হলেই তা সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে। অতীতে সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখেছে দেশ। সংরক্ষণের পক্ষে বিপক্ষে বহু যুবকের আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনার নজিরও আছে। এই পরিস্থিতিতে বিষয়টিকে যুক্তির ভিত্তিতে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ধরা যাক, চাকরি এবং শিক্ষায় ১০০ শতাংশ আসনই সংরক্ষণের আওতায় এল–তা হলেও কি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীগুলির সকলে শিক্ষা এবং চাকরি পাবেন? অথবা যদি সংরক্ষণ তুলে দিয়ে একেবারে শূন্য করা হয় তা হলেও কি শিক্ষা এবং চাকরির দরজা সকলের না হোক অন্তত বেশিরভাগ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হবে? উত্তরটা জানা– আজকের দিনে তা অসম্ভব। যে কারণে এ দেশে সংরক্ষণ নীতি বরাবরই ভোটের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। শাসক এবং বিরোধী উভয় পক্ষেই ভোটবাজ দলগুলি এই সরল সত্যটাকে আড়াল করে সংরক্ষণের পক্ষে বিপক্ষে গলা ফটানোর সময় এক একটি গোষ্ঠীর স্বার্থের চ্যাম্পিয়ান সেজেছে। আর ভোটের সময় সেই সব গোষ্ঠীর মানুষের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে রাজা-উজির হয়েছেন। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আর্থিকভাবে দুর্বল বা ইডব্লুএস গোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরি ও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের প্রস্তাব সহ ১০৩তম সংবিধান সংশোধনী বিল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রায় কোনও আলোচনা ছাড়াই পাশ করায়। রাষ্ট্রপতিও যেন কলম তুলে বসেই ছিলেন, তিনিও একদিনের মধ্যে এর প্রয়োজনীয় অনুমোদন দিয়ে দেন। এতবড় একটি সিদ্ধান্ত, যা কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে সংসদে কার্যত আলোচনার কোনও সুযোগই না রাখার জন্যই সরকার বিলটি অধিবেশনের একেবারে শেষে পেশ করেছিল। যাতে লোকসভা ভোটে বিজেপির মূল ভোটব্যাঙ্ক তথাকথিত উচ্চবর্ণের মধ্যে জমা হওয়া ক্ষোভকে চাকরি ও উচ্চশিক্ষার খোয়াব দেখিয়ে চাপা দেওয়া যায়। কিন্তু এই আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল। এতদিন পরে সে মামলার রায় দেওয়া হল। উল্লেখ্য বিল আনার সময়টা যেমন ছিল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, তেমনই এবারের রায়টি এসেছে বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনের একেবারে মুখে। দুটি ক্ষেত্রেই বিজেপি নির্বাচনী আসরে এ নিয়ে ফয়দা তোলার জন্য ঝাঁপিয়েছে।
আর্থিক দুর্বলতার মাপকাঠি কী?
ইডব্লুএস সংরক্ষণের মাপকাঠি অনুযায়ী পরিবারের বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ টাকার নিচে হলেই এই সংরক্ষণের সুবিধা নেওয়া যাবে। অর্থাৎ ৬৬ হাজার টাকার বেশি মাসিক আয় সম্পন্ন পরিবারও এই সংরক্ষণের আওতায় আসবে। সরকার যদি সত্যিই আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণি বলতে এই পরিমাণ আয়ের পরিবারকে বোঝে, তা হলে তাদের তো উচিত ছিল এখনই নূ্যনতম মজুরির হার এই পরিমাণে বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া! এতদিন শ্রমিক কর্মচারীরা দাবি তুলছিলেন ন্যূনতম মাসিক বেতন ২১ হাজার টাকা করতে হবে। কিন্তু সে দাবি কোনও সরকারই মানেনি। এখন ৬৬ হাজার টাকা মাসিক আয়কে আর্থিক দুর্বলতার প্রমাণ হিসাবে মেনে নিয়ে বিজেপি সরকার নিজেই দেখিয়ে দিল দেশের মানুষের প্রকৃত হাল কী! নূ্যুনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা চাকরিতে ইডব্লুএস কোটায় স্থান পেতে প্রতিযোগিতা হবে মাসে ৬৬ হাজার টাকা রোজগেরে পরিবারের সন্তানের? কারা এ ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি? যথার্থই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের সাথে এটা প্রতারণা নয় কি?
যা নেই তার সংরক্ষণ!
যে চাকরির জন্য এমন সংরক্ষণের ব্যবস্থা, সে চাকরিটাই কি আছে? প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। সরকারি পরিসংখ্যানই দেখিয়েছে কোভিডের আগেই ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের হার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের লেবার ব্যুরোর সমীক্ষা দেখাচ্ছে দেশের কর্মক্ষম মানুষের মাত্র ৪৭.৫ শতাংশ কিছু কাজ পান। বহু মানুষ, বিশেষত বিরাট সংখ্যক মহিলা ঘরে প্রবল অভাব সত্ত্বেও কাজ খোঁজার চেষ্টাই ছেড়ে দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে নানা রাজ্যে ডোমের চাকরি, পিয়নের চাকরির জন্য একটা পদ পিছু কয়েক হাজার বেকার যুবক-যুবতী দরখাস্ত করছেন। তাদের অনেকেই পিএইচডি বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান কিছুদিন আগে জানিয়েছেন, ম্যানেজমেন্ট পাশ করার পর ৪৫ শতাংশ এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ৪৮ শতাংশ পাশ করা ছাত্র বেকার থাকছে (দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এ’প্রেস, ২১.০১.২০২২)। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলির দপ্তরে চাকরির সুযোগ বাড়া দূরে থাক, পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন উদারিকরণের নীতি অনুযায়ী তথাকথিত সংস্কারের নামে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার পদ বিলুপ্তি ঘটাচ্ছে, পুরনো কর্মচারীদের ভিআরএস দিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে। বিগত দুই বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে নিয়োগ কমেছে ২৭ শতাংশ , রাজ্য সরকারগুলির নিয়োগ কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। ২০২০-র আগস্টে কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ৯ লক্ষ ৭৯ হাজার পদ খালি পড়ে আছে (বিজনেস কানেক্ট ম্যাগাজিন ব্লগ এবং ইকনমিক টাইমস, ৩.০৮.২০২২)। রেল, বিএসএনএল সহ নানা সরকারি সংস্থায় বিশাল সংখ্যক কর্মচারী সরকারের চাপে স্বেচ্ছাঅবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন। এয়ার ইন্ডিয়া সরকার বেচে দিয়েছে। ভারত পেট্রোলিয়াম, প্রতিরক্ষা কারখানা, খনি, বিমা কোম্পানি, ব্যাঙ্ক সহ বহু সরকারি সংস্থাই বেসরকারি মালিকদের কাছে বেচার কাজ চলছে। ফলে সরকারি সংস্থার অস্তিত্ব নিয়েই যেখানে সংশয়, তখন চাকরিতে নতুন করে সংরক্ষণ আদৌ কতজনের উপকারে আসবে?
আরও ভাবা দরকার, স্বাধীনতার পর থেকে ৭৫ বছর সংরক্ষণ চালু থাকলেও সংরক্ষিত অংশের অধিকাংশ মানুষই কর্মহীন কেন? এক দিকে সংরক্ষণের আওতায় যাঁরা নেই তাঁদের অনেকে ভাবেন, অন্যদের জন্য সংরক্ষণ আছে বলেই আমরা কাজ পাচ্ছি না। অন্য দিকে সংরক্ষিত অংশের মানুষ ভাবেন, সংরক্ষণ আছে বলে সামান্য কিছু পাচ্ছি, না থাকলে একেবারে কিছুই পাব না। অথচ দুই পক্ষেই বেকার সমস্যা তীব্র। আসলে সংরক্ষণ যেমন বেকার সমস্যা বৃদ্ধির কারণ নয়, একই সাথে বলা যায়–সংরক্ষণ বেকার সমস্যার সমাধানও নয়।
শিক্ষায় আসন সংরক্ষণ হলেও ফি কে যোগাবে?
সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক দুর্বলতার ভিত্তিতে আসন সংরক্ষণ করা হলেও তাতে আর্থিক ক্ষমতা না থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হবেন কী করে? সরকার তো শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্রমাগত বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে। স্কুল স্তরে নানাভাবে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে সারা ভারতেই বেসরকারি স্কুলের দিকে ছাত্রদের ঠেলছে সরকার নিজে। এসসি, এসটি, ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় থাকা বিরাট অংশের ছেলেমেয়েরা কোনও রকমে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে নাম লেখাতে যদি পারেও তাদের একটা বড় অংশই প্রাথমিকের গণ্ডিটা পার করার আগেই দারিদ্রের জন্য পড়া ছেড়ে দেয়। তথাকথিত উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। জাত-বর্ণ যাই হোক সব দরিদ্র ঘরের দুঃখের কাহিনি এক। বেসরকারি হাতে শিক্ষাকে তুলে দেওয়ার জন্য সরকারি স্কুলে লেখাপড়ার মান ক্রমাগত কমানোর জন্য সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার সচেষ্ট। এই পরিস্থিতিতে এসসি, এসটি, ওবিসি কিংবা নতুন করে ইডব্লুইএস কোটায় যারা সংরক্ষিতও হবে তারা বিপুল হারে ডোনেশন এবং ফি দিয়ে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হতে পারবে তো! কলেজ স্তরের অবস্থাও অলাদা কিছু নয়। সরকারি কলেজের প্রতি আস্থা কমানোর ব্যবস্থা পরিকল্পিত ভাবেই চলছে। পাশাপাশি প্রচুর বেসরকারি কলেজ চারিদিকে গজিয়ে উঠছে। সরকারি সাধারণ কলেজগুলিতেও বিপুল ফি বাড়ছে, বাড়ছে সেলফ ফাইনান্সিং কোর্সের বহর। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি স্নাতক থেকে পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে দিচ্ছে কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে। আইআইটি, আইআইএম থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিপুল ফি বাড়ছে। হরিয়ানার বিজেপি সরকার সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার জন্য বছরে ১০ লক্ষ টাকা ফি ধার্য করছে। দেশের নামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার খরচ শুনলে যেকোনও সাধারণ ঘরের ছাত্র-ছাত্রী আঁতকে ওঠেন। সংরক্ষণের ফলে ভর্তির তালিকায় কারও কারও নাম উঠলেও দারিদ্রের জন্য এই বিপুল ফি কতজন মেটাতে পারবে? না পারলে তা মেটানোর দায় কি সরকার নেবে? বিজেপি সরকার সে বিষয়ে নীরব।
৭৫ বছরেও সামাজিক পশ্চাদপদতা দূর হল না
এতদিন চালু থাকা সামাজিক ভাবে পশ্চাদপদ শ্রেণির জন্য চাকরি এবং শিক্ষার সংরক্ষণ সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত বৈষম্য এবং বিভেদ দূর করতে পেরেছে কি? দারিদ্রের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া থেকে তা আদিবাসী, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে রক্ষা করতে পেরেছে?
ভারত সরকারের সর্বশেষ হাউসহোল্ড সার্ভে জানাচ্ছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৪০.৬ শতাংশ দারিদ্র সীমার নিচে। ৪২ শতাংশ আদিবাসী শিশু অপুষ্টির শিকার, শিশুমৃত্যুতে সমস্ত সম্প্রদায়ের তুলনায় আদিবাসীদের হার বেশি। মেঘালয়ের মতো রাজ্যে ৭৬ শতাংশ আদিবাসী শিশু অপুষ্ট। টিবি, ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সর্বাধিক। বিগত ১০ বছরে মোট আদিবাসী জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই তাঁদের স্বাভাবিক বসবাসের স্থান থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থা কেমন? কেন্দ্রীয় সরকারের ৭৫তম রাউন্ডের স্যাম্পেল সার্ভে অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ স্নাতক বা তার বেশি উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেয়েছে। সবচেয়ে কম আয়ের স্তরে আছে যে পরিবারগুলি (যে সব পরিবারে মাথাপিছু মাসিক ব্যয়ের ক্ষমতা ৮৩ থেকে ১২৫০ টাকা) তাদের মধ্যে কত শতাংশ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে? দেখা যাচ্ছে আয়ের এই সীমায় এসটি-০.৯২, এসসি-১.৯, ওবিসি-২.৮, মুসলিম-১.৯ এবং উচ্চবর্ণ হিন্দু-৬.৮ শতাংশ উচ্চশিক্ষায় যেতে পেরেছেন। আয়ের একেবারে উচ্চস্তরে যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে বর্ণ-জাতি ভিত্তিক ভাগে বিচার করলেও পার্থক্য অনেক কম। অর্থাৎ উচ্চ আয়ের পরিবারগুলিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেশি থাকার ফলে বর্ণ, ধর্ম জাতি ভিত্তিতে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্য কম।
কর্ম ক্ষেত্রের পরিস্থিতি কী? মোট শ্রমিক কর্মচারীর মাত্র ২৩ শতাংশ নিয়মিত কর্মচারী। এসটি সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মচারীদের মাত্র ১৩.৪ শতাংশ, এসসি এবং ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মচারীদের মাত্র ২০ শতাংশ নিয়মিত। সরকারি কাজে এক বছরের বেশি সময় ধরে নিযুক্ত এসটি সম্প্রদায়ভুক্ত ঠিকাকর্মীদের ৭৩ শতাংশের কোনও লিখিত চুক্তি নেই, ওবিসি এবং এসসিদের ক্ষেত্রে তা ৭৭ শতাংশ। সরকারি ক্ষেত্রে সাফাই কর্মী, দারোয়ান, পিয়ন ইত্যাদি নিম্ন বেতনের কাজে এসটি, এসসি, ওবিসিদের অনুপাত বেশি হলেও উচ্চ বেতনের সরকারি পদে তাদের উপস্থিতি খুবই কম (দ্য ওয়্যার, ১৮.১১.২০২২)। বোঝা যাচ্ছে সংরক্ষণ ব্যবস্থা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকাংশকেই চাকরি কিংবা উচ্চশিক্ষার় দোরগোড়া পর্যন্তও পৌঁছে দিতে পারেনি। দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে চালু থাকা সংরক্ষণ ব্যবস্থা কার্যত সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ইত্যাদি কোনও ক্ষেত্রেই বৈষম্য দূর করতে পারেনি। নতুন করে আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণও কি আদৌ কোনও সুরাহা এনে দেবে?
স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বের আপসমুখিতার পরিণাম
ভারতে সহস্রাধিক বছরের সামন্তী ব্যবস্থার মধ্যে বর্ণাশ্রম প্রথায় তথাকথিত নিম্নবর্ণ বলে চিহ্নিত শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষ আর্থিক, সামাজিক শিক্ষাগত সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে সামন্তী ব্যবস্থার মধ্যে এই জাতপাতের বিভেদ সৃষ্টি তা আজ আর নেই। তার জায়গা নিয়েছে পুঁজিবাদ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত ফলকে আত্মসাৎ করে পুঁজিপতি শ্রেণি গড়ে তুলেছে পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থা। তার অমোঘ ফল হিসাবে জন্ম নিয়েছে নতুন বৈষম্য। এই ব্যবস্থায় জাতপাতের দমন পীড়ন আগের রূপ নিয়ে টিকে থাকতে পারে না। আজকের সমাজের বৈষম্যের রূপ হল সর্বহারা শ্রেণির উপর পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণের রূপ। তার ভিত্তিতেই বৈষম্য, খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশার সৃষ্টি। অথচ সামন্তী ব্যবস্থার অবলুপ্তির পরেও সেই জাতপাত-বর্ণ-ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব ও বিভেদ আজও টিকে আছে কী করে? এ কথা ঠিক যে, আজকের দিনে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমাজের সম্পূর্ণ গণতন্ত্রীকরণের কাজ সম্পূর্ণ করতে পারে না। কিন্তু বুর্জোয়া অর্থেও যতটুকু গণতন্ত্রীকরণ ভারতীয় সমাজে হতে পারত, যতটুকু জাতীয় সংহতি গড়ে উঠতে পারত, তাও হতে পারেনি কেন? মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, ভারতবর্ষের জাতি গঠনের প্রক্রিয়া উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি যখন শুরু হয়েছিল সে সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদ তার বিপ্লবী চরিত্র খুইয়ে বিপ্লব বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে বিদেশি লগ্নিপুঁজির ছত্রছায়ায় এবং সামন্তী-সম্পর্কে আবৃত থেকে। ফলে তার স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। পুঁজিপতি শ্রেণির জাতীয়তাবাদী অংশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল ব্রিটিশের বদলে নিজেদের শ্রেণি শাসন-শোষণ কায়েমের উদ্দেশ্যে। আবার সর্বহারা বিপ্লবের ভয়ে ভীত হয়ে তারা সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংস্কারপন্থী বিরুদ্ধতাবাদী (রিফর্মিস্ট অপোজিশনাল) ভূমিকা পালন করেছে। তাদের ভয় ছিল বিপ্লবী গণঅভূ্যত্থানকে । এই ভয় থেকে সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্ততন্ত্র উভয়ের সাথেই আপসের পথ গ্রহণ করেছে। যে কারণে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-জাতনিয়ে চলা ভারতবাসী রাজনৈতিকভাবে একটি জাতিতে পরিণত হলেও সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পৃথক সম্প্রদায় হিসাবেই থেকে গেছে।
এ দেশের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে মূলত তথাকথিত উচ্চবর্ণজাত নেতারাই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই আপসকামী নেতারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে মেশাতে ভয় পেয়েছেন। মাঝে মাঝে অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের বিভেদের বিরুদ্ধে তাঁরা কিছু কর্মসূচি নিয়েছেন, কিন্তু সে কর্মসূচির রেশ তাঁদের নিজেদের অন্তঃপুরেও প্রবেশ করেনি। তাঁদের অনেকেই হিন্দু ধর্মের উচ্চবর্ণের সংস্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন থেকেই স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করতে দেশবাসীকে ডাক দিয়েছেন। কিন্তু তথাকথিত নিম্নবর্ণ, দলিত, মুসলিমরা মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন, এই নেতাদের ডাকের মধ্যেও ফাঁক আছে। সেই ফাঁক সামাজিক ক্ষেত্রেও থেকেই গেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিংদের মতো আপসহীন বিপ্লবীধারার প্রতিনিধিরা ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার অনুশীলন, জাতপাতের বেড়া ভাঙার কথা বললেও তা সমাজে প্রধান ধারা হয়ে উঠতে পারেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা ডিভাইড অ্যান্ড রুলের মাধ্যমে ভারতবাসীকে শাসন করার জন্য জাতপাত এবং ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদে উস্কানি দিয়েছে। আপসমুখী নেতৃত্ব বারবার সেই ফাঁদেই নিজেরাও পা দিয়েছেন, ভারতবাসীকেও তাতে ঠেলে দিতে কার্যত সাহায্য করেছেন। এর পরিণামে আজও জাতপাতের বিষময় বিভেদের বোঝা ভারতবাসীকে বইতে হচ্ছে।
সংরক্ষণের পরিধি বেড়েছে বেড়েছে বিভেদ-বৈষম্যও
ভারতের স্বাধীনতার পর দেশের মানুষ আশা করেছিল, বহু কাল ধরে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার আদিবাসী, হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিচুজাত, দলিত সম্প্রদায় এর থেকে মুক্তি পাবে। সংবিধানেও সরকারি চাকরি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। বলা হয় ১০ বছর পর পর বিচার করে দেখা হবে এর মধ্য দিয়ে কতটা সামাজিক ন্যায়বিচার অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়া গেছে। সরকারি চাকরি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সঠিক প্রতিনিধিত্ব যাতে নিশ্চিত করা যায় তা সরকার দেখবে। তার ভিত্তিতেই ঠিক হবে আর কতদিন সংরক্ষণ রাখার প্রয়োজন আছে। দেখতে দেখতে স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার বদলে তার ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে এসে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া অংশ বা ওবিসি সংরক্ষণ। জাতপাতের বিভেদ-বৈষম্য কমার বদলে ক্রমাগত তা আরও পোক্ত রূপ নিচ্ছে। স্বাধীনতার এতদিন পরেও এসসি, এসটি, ওবিসি তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের পরিস্থিতি কী? সামাজিক ক্ষেত্র ধরা যাক–প্রধানমন্ত্রী কথিত স্বাধীনতার অমৃতকালের ভোর হওয়ার আগেই গত ১৪ আগস্ট রাজস্থানের স্কুল ছাত্র তথাকথিত ‘নিচু’ জাতের ছেলে ৯ বছরের ইন্দ্র মেঘওয়াল স্কুলে ‘উঁচু’ জাতের জন্য রাখা জলের কলসি ছুঁয়ে ফেলার অপরাধে ‘উচ্চবর্ণের’ শিক্ষকের মারে প্রাণ দিয়েছে। ১৬ আগস্টে উত্তরপ্রদেশে স্কুলের ২৫০ টাকা ফি দিতে না পারায় ‘উচ্চবর্ণের’ শিক্ষকের মারে প্রাণ হারিয়েছে তথাকথিত ‘নিচু’ জাতভুক্ত ১৩ বছরের ব্রিজেশ কুমার। সারা দেশেই হরদম ক্ষমতাশালীদের হাতে নিগৃহীত, ধর্ষিত এমনকি নিহত হচ্ছেন দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সব ঘটনা কি সংরক্ষণের মাধ্যমে নির্মূল হবে? আজকের দিনে পুঁজিবাদী শাসকরা জাতপাত-ধর্ম-বর্ণের বিভেদকে দূর করার বদলে তা শুধু জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে তাই নয়, তাকে উস্কানি দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ঐক্যকে ভাঙার চেষ্টা করছে। সারা দুনিয়াতেই দেখা যাচ্ছে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি মৌলবাদ, বর্ণবৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয়দাতা। তাদের উস্কানি ও মদতে মানুষে মানুষে হানাহানি বাড়ছে। খেটে খাওয়া শোষিত মানুষ যাতে তাদের দুঃখ দুর্দশার প্রকৃত কারণকে চিনতে না পারে। যাতে তারা শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে সচেতন সংঘবদ্ধতা গড়ে তুলতে না পারে। তার জন্য শোষিত মানুষের এক অংশকে অপর অংশের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয় শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি। সাম্প্রদায়িকতার মতোই সংরক্ষণকেও একদিকে ভোটব্যাঙ্ক গড়ে তোলার হাতিয়ার অন্য দিকে শোষিত মানুষের ঐক্য ভাঙার হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাতে চায় পুঁজিপতি শ্রেণি।
বৈষম্যের কারণ আড়াল করতে জাতপাতই হাতিয়ার শাসক শ্রেণির
পুঁজিবাদী শোষণের কারণেই চাকরি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সমস্ত সুযোগ এবং বিকাশের রাস্তা অধিকাংশ মানুষের সামনে বন্ধবলে সংরক্ষণের টোপ ঝুলিয়ে অসহায় মানুষকে ভুল বোঝাতে পারছে শাসক শ্রেণি। আজ কোনও পুঁজিবাদী শাসক মানুষের নূ্যনতম চাহিদাও মেটাতে অক্ষম। দেশের মানুষের প্রকৃত আয় ক্রমাগত কমছে, বাড়ছে প্রতিটি জিনিসের মূল্য। পুঁজিপতিদের লাভ বাড়ছে, কমছে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার মান। এই পরিস্থিতিতে সরকার যদি কোনও সামাজিক গোষ্ঠীর পশ্চাদপদতার কথা বলে তাদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণ করেও রাখে, সেই গোষ্ঠীর অধিকাংশের পক্ষে এই সুযোগ পর্যন্ত পৌঁছানোই অসম্ভব হয়ে পড়ে। দেখা যায় এর সুযোগ নেয় ওই সংরক্ষিত অংশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। অধিকাংশই যে অন্ধকারে ছিল তাতেই ডুবে থাকে। সুযোগসন্ধানী মুষ্টিমেয় মানুষ পিছিয়ে পড়া, দলিত ইত্যাদি শব্দবন্ধকে ব্যবহার করে দেশের শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির দোসর হয়ে সত্যিকারের পিছিয়ে পড়া, দলিত, আদিবাসীদের শোষিত জনগণের উপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে, তারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। ‘ক্রিমি লেয়ার’ বা সুবিধাভোগী অংশ হিসাবে তারাই মূলত সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করে। এ দেশে জাতপাত ভিত্তিক অধিকারের দাবি তোলা দলগুলির চরম সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতানেত্রীরা এই সুবিধাভোগীদের জ্বলন্ত উদাহরণ। মায়াবতী, লালুপ্রসাদ যাদব, গুজরাটের হার্দিক প্যাটেল প্রভৃতি নেতাদের কার্যকলাপ দেখলে এ কথা অস্বীকার করা যায় কি? মায়াবতী, লালুপ্রসাদরা চরম দুর্নীতি করে নিজেদের সব ধরনের আখের গুছিয়েছেন। পাশাপাশি দলিত, নিম্নবর্ণের মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাদের সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে ভোটে জিতে সরকারি গদি ভোগ করেছেন। আবার নিজেদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত ঢাকতে এরা কেন্দ্রীয় শাসকদলকে তোয়াজ করে চলে যাতে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি হাত গুটিয়ে থাকে। তাতে দলিত-নিম্নবর্ণের অধিকাংশ মানুষের কোনও উপকার হয়েছে? গুজরাটের হার্দিক প্যাটেল পাটিদার গোষ্ঠীর মানুষের দাবি নিয়ে একসময় বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জনপ্রিয় হয়েছেন। কিন্তু যখনই বুঝেছেন গুজরাটে বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসছে সঙ্গে সঙ্গে ভোল বদলে নিজের গোষ্ঠীর সব দাবি জলে ফেলে দিয়ে বিজেপির এমএলএ হয়ে গেছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জাত-বর্ণ-ভাষা সম্প্রদায়গত ভাবে যাঁরা অধিক ক্ষমতাশালী তারা দুর্বলদের উপর যে দাপট দেখায় তা আসলে পুঁজিবাদী আধিপত্যবাদেরই অংশ। এটাকে না বুঝে বা বুঝেও বহু বামপন্থী দলও জাত-বর্ণগত বৈষম্যকেই শ্রেণিভিত্তি হিসাবে দেখিয়ে জাত-ভিত্তিক রাজনীতিকে শক্তি বাড়ায়। এর ফলে তারা অনেকে এমপি-এমএলএ-ও হয়ে যায়। কিন্তু জাত-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে শোষিত মানুষের ঐক্য নষ্ট হয়। এখন ভোটবাজ রাজনীতিবিদ থেকে সংবাদমাধ্যম সাধারণ মানুষের পরিচয় দেয় ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে। যেন সাধারণ মানুষ এক একটি দল বা নেতার সম্পত্তি! নেতারা জাতপাত-বর্ণ ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করেন, সেই দৃষ্টিতেই তাদের দেখেন। ভোটবাজ শাসক এবং বিরোধী উভয় দলই নিজের নিজের মতো হিসাব কষে এক এক গোষ্ঠীর স্বার্থের মেকি চ্যাম্পিয়ান সেজে অসহায় মানুষের সমর্থন কেনার চেষ্টা করে। কিন্তু এরা যখন শাসকের আসনে বসে, শিল্প মালিক হয়, তারা কি নিম্নবর্ণ কিংবা দলিত জনসাধারণকে শোষণ করতে পিছপা হয়? নিজের জাত-বর্ণ-ধর্মের শ্রমিককে কি সেই জাত ধর্মের মালিক বেশি মজুরি দেয়! না একই ভাবে শোষণ করে! এ দেশেই ‘দলিত শিল্পপতি’দের নিয়ে ২০০৫ সালে গড়ে উঠেছে ‘দলিত চেম্বারস অফ কমার্স’। তারা অন্যান্য চেম্বারস অফ কমার্সের সাথে বোঝাপড়া করে বড় বড় কোম্পানির অংশীদারও হয়। তাতে অধিকাংশ আদিবাসী-দলিত জনগণের কি চাকরির সুযোগ, শিক্ষার সুযোগ বাড়ে?
মানুষের অপ্রাপ্তিকে ব্যবহার করছে সুযোগসন্ধানীরা
চাকরি, শিক্ষা ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের চরম অপ্রাপ্তিকে শাসক শ্রেণি ব্যবহার করেছে খেটে খাওয়া মানুষের নানা গোষ্ঠীর পরস্পরের মধ্যে বৈরিতা তৈরির কাজে। আদিবাসী, দলিত এবং তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে কায়েমি স্বার্থবাহীরা বুঝিয়ে থাকে উচ্চবর্ণ সব দখল করে বসে আছে তাই তোমাদের কিচ্ছু নেই। একদল ধুরন্ধর আবার তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষকে বোঝান, তোমাদের না-পাওয়ার কারণ আদিবাসী, তথাকথিত নিম্নবর্ণের জন্য সংরক্ষণ। শাসক শ্রেণির তাঁবেদার পণ্ডিতরা এই কাজে সুবিধামতো নানা পরিসংখ্যান জোগাড় করে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকেন। যেন সংরক্ষণ না থাকলে উচ্চবর্ণের সবাই চাকরি এবং উচ্চশিক্ষা পেয়ে যেত, আর পুরোটা সংরক্ষিত হলেই আদিবাসী এবং নিম্নবর্ণের সবাই এই সুযোগগুলি পেত। দুটোই ভ্রান্ত ধারণা।
আসলে সংরক্ষণ থাকুক আর নাই থাকুক, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিয়মেই অতি অল্প সংখ্যকই সুযোগ পাবে। এটা বুঝেই একদল ধুরন্ধর রাজনীতি-ব্যবসায়ী নানা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে এসটি, এসসি তালিকাভুক্তিকে একটা বিশেষ সুবিধা হিসাবে দেখিয়ে তাদের দারিদ্রের যন্ত্রণাকেনিজেদের ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। সাম্প্রতিক কালে দেখা গেছে রাজ্যে রাজ্যে নানা গোষ্ঠীর জন্য এসটি বা এসসি তকমা চেয়ে তীব্র আন্দোলন ফেটে পড়ছে। অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের অসংরক্ষিত একটি অংশ একটানা কয়েকদিন ধরে রেল অবরোধ চালিয়েছে। এর ফলে আবার আগে থেকেই এসটি তালিকাভুক্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে, তাঁরা তাঁদের সুযোগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। অতীতে গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র সহ নানা স্থানে একই ধরনের আন্দোলন দেখা গেছে। তার ফলে পরস্পর বিরোধী দাবি তোলা দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে বহু রক্তও ঝরেছে। বিজেপি সরকার যে নতুন করে আর্থিক ভিত্তিতে উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ চালুর কথা বলেছে, তাতেও অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে একই ধরনের অনিশ্চয়তা, চাকরি-শিক্ষার সুযোগ হারানোর ভয়, তাকে ঘিরে বৈরিতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল।
তা হলে দেখা যাচ্ছে, যত ধরনের সংরক্ষণই হোক না কেন, তা না দূর করবে সামাজিক বৈষম্য, না দূর করতে পারবে অর্থনৈতিক বৈষম্য। বরং জাতপাতের বিভেদ, সাম্প্রদায়িক বৈরিতা এসব এর মধ্য দিয়ে বেড়েই যাবে। এ থেকে মুক্তির একটাই পথ, তা হল জাত-বর্ণ-ভাষা-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত খেটে-খাওয়া মানুষের সমান সুযোগের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা। এর মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে সর্বপ্রকার শোষণ-বঞ্চনা, পশ্চাদপদতার মূল কারণ পুঁজিবাদ-উচ্ছেদের রাজপথ। গড়ে উঠবে সকলের জন্য শিক্ষা ও চাকরির গ্যারান্টির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।