নতুন ‘মিডিয়া নীতি’ চালু হয়েছে কেন্দ্রীয় শাসনাধীন জম্মু–কাশ্মীরে৷ কী আছে এই মিডিয়া নীতিতে? কোনটা ফেক নিডজ (মিথ্যা খবর), কোনটি অনৈতিক, কোনটি দেশবিরোধী, তা স্থির করে দেবে সরকার৷ সেখানেই শেষ নয়, সংবাদ যদি না–পসন্দ হয় তাহলে সাংবাদিকের অতীত সম্পর্কেও অনুসন্ধান করবে সরকার৷ সরকারি বিচারে উতরাতে না পারলে প্রকাশক, সম্পাদক, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে আইনি পদক্ষেপ৷ স্বভাবতই সরকারের গুণগান না করলে সংবাদমাধ্যম যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না৷ সরকারের ভূমিকা নিয়ে জনমনে আস্থা বাড়িয়ে তুলতে পারাই যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হবে৷ সোজা কথায়– সংবাদমাধ্যমকে সম্পূর্ণ জো–হুজুর হতে হবে, না হলে পাওয়া যাবে না সরকারি বিজ্ঞাপন৷
বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে ‘গণতন্ত্রের মন্দির’ বলে সংসদ ভবনের সিঁড়িতে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন৷ ২০১৯–এ মাথা ঠুকেছিলেন সংবিধানে৷ অথচ গণতন্ত্রের অন্যতম যে শর্ত স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং বাক স্বাধীনতা, বিজেপি রাজত্বে সে দুটিরই কোনও অস্তিত্ব নেই৷ আর কাশ্মীরে তো এর কোনও প্রশ্নই ওঠে না৷ আজ কাশ্মীরের সত্য চিত্র হিসাবে কাশ্মীরি জনগণের অবর্ণনীয় দুর্দশা তুলে ধরাই স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কর্তব্য৷ কাশ্মীরের মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে গেলে আজ সবচেয়ে বেশি দরকার তাদের মানুষ হিসাবে, নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া৷ তার জন্য সেনা, পুলিশ, সরকারি অফিসার, শাসকদলের নেতাদের করে চলা অন্যায়, বেআইনি কার্যকলাপ, মানুষের অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অধিকার সে রাজ্যের মানুষকে দিতেই হবে৷ অথচ ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা, সন্ত্রাসবাদী এবং সেনা–পুলিশের মাঝখানে পড়ে জীবন দুর্বিষহ হওয়া সাধারণ মানুষের সমস্যাকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনার দাবি তুলে হেনস্থার শিকার হয়েছেন জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা৷ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বাস্তব ছবি পরিবেশনের দায়ে মামলা করেছে পুলিশ৷ সাংবাদিকদের ফাঁসানো হচ্ছে ব্যয়বহুল মামলায়৷দমনমূলক আইন ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁদের জীবন জেরবার করা হচ্ছে৷ তাঁরা হঠাৎ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন, একের পর এক তাঁদের খুন করা হচ্ছে৷ স্মরণ করা দরকার,এই বিজেপি সরকারই বলেছিল, ৩৭০ ধারা বিলোপ করে দিলেই কাশ্মীরে শান্তি ফিরবে একটা বছর ধরে গোটা কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে রেখে, মানুষের সমস্ত অধিকারকে বুটের তলায় মাড়িয়ে এ কোন শান্তি কাশ্মীরের জনগণকে তাঁরা এনে দিলেন? এর উত্তর আজ বিজেপিকে দিতে হবে৷
অবশ্য বিজেপি বলতে পারে গণতন্ত্র হরণে, সংবাদমাধ্যমকে পকেটে পোরার চেষ্টায় বাকি ভারতের সাথে কাশ্মীরকে এক করে দিতে তাদের কোনও চেষ্টার ঘাটতি নেই বিজেপি আমলের প্রথম পাঁচ বছরে (২০১৪– ২০১৯) ভারতে অন্তত ৪০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন৷ গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২০০ জন সাংবাদিক৷ এর মধ্যে কাশ্মীরে সর্বাধিক৷ নাগরিকত্ব আইন (এনআরসি) বিরোধী আন্দোলন এবং দিল্লি গণহত্যার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তিন মাসে অন্তত ৩২ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন৷ তাদের ক্যামেরা ভেঙে, গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷বেশিদিন আগের কথা নয়, অনেকেরই হয়ত মনে আছে মধ্যপ্রদেশে ‘ব্যাপম’ কেলেঙ্কারির খবর করতে গিয়ে বহু সাংবাদিক রহস্যজনক ভাবে খুন হয়ে যান৷ আজও সেই খুনের কিনারা হয়নি৷ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদেরও কোনও শাস্তি হয়নি৷ উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার দ্য ওয়্যারের সম্পাদককে একটানা হেনস্থা করে চলেছে৷ সাংবাদিক বিনোদ দুয়া সহ একাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতাদের বিবৃতির ভিত্তিতেই রাজদ্রোহের মামলা করেছে একাধিক রাজ্যের বিজেপি সরকার৷ উত্তরপ্রদেশে মিড ডে মিলে দুর্নীতি সামনে এনেও মামলার সম্মুখীন হয়েছেন সাংবাদিক৷ এমনকি ভারতের সবচেয়ে বড় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে হুমকি দিয়েছে সরকারি সংস্থা প্রসারভারতী৷ কারণ তারা লাদাখে চীন–ভারত সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক এবং চীনের বিদেশ মন্ত্রকের কর্তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে৷
পরাধীন ভারতে ব্রিটিশের বাকস্বাধীনতা হরণের রূপ দেখে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘‘আজ এই দুর্ভাগা রাজ্যে সত্য বলিবার জো নাই, সত্য লিখিবার পথ নাই–তাহা সিডিশান৷ অথচ দেখিতে পাই, বড়লাট হইতে শুরু করিয়া কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই বলিতেছেন–সত্যকে তাঁহারা বাধা দেন না, ন্যায়–সঙ্গত সমালোচনা– এমনকি, তীব্র ও কটু হইলেও নিষেধ করেন না৷ তবে বক্তৃতা বা লেখা এমন হওয়া চাই, যাহাতে গভর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে লোকের ক্ষোভ না জন্মায়, ক্রোধের উদয় না হয়৷ চিত্তের কোনও প্রকার চাঞ্চল্যের লক্ষণ না দেখা দেয় –এমনি৷ অর্থাৎ, অত্যাচার–বিচারের কাহিনী এমন করিয়া বলা চাই, যাহাতে প্রজাপুঞ্জের চিত্ত আনন্দে আপ্লুত হইয়া উঠে, অন্যায়ের বর্ণনায় প্রেমে বিগলিত হইয়া পড়ে এবং দেশের দুঃখ দৈন্যের ঘটনা পড়িয়া দেহ–মন যেন তাহাদের একেবারে স্নিগ্ধ হইয়া যায় ঠিক এমনটি না ঘটিলেই তাহা রাজবিদ্রোহ৷’’(সত্য ও মিথ্যা)
ভারতে সংবাদমাধ্যমের গলায় বকলস পরানোর এই চেষ্টা কংগ্রেস আমলেই শুরু৷ তারাও সরকার বিরোধী বক্তব্য রুখতে বিজ্ঞাপন বন্ধের হুমকি, মামলা, সাংবাদিকের ওপর হামলা সবই করেছে৷ সিপিএমও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকাকালীন বারবার সাংবাদিকদের শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত করেছে৷ সমস্ত বুর্জোয়া–পেটি বুর্জোয়া দলই আজ গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরতে এই কাজই করে চলেছে৷ ক্ষমতায় না থাকলে তারা এগুলি নিয়ে হইচই করে, ক্ষমতায় গেলেই তাদের স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে৷ আজ বিজেপি অতি উগ্র ভাবে এই কাজ করে চলেছে৷ বুর্জোয়া ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থার আজ এটাই স্বরূপ৷ এতটুকু বিরোধী স্বর তথাকথিত গণতন্ত্রের এই ধ্বজাধারীরা আজ আর সহ্য করে না৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট যত গভীর হচ্ছে, একচেটিয়া পুঁজির নাগপাশ তত চেপে বসছে সমাজের সর্বত্র৷ গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও আজ আর রাখতে দিচ্ছে না বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কর্ণধাররা৷ সংসদীয় গণতন্ত্রের ঠাটবাট বজায় রেখেই ফ্যাসিবাদ কায়েম করাটা আজ বুর্জোয়া ব্যবস্থার সাধারণ লক্ষণ৷
ফ্যাসিবাদের আজকের রূপ বিশ্লেষণ করে মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, ‘‘…যখন প্রচলিত স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সংগঠন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনযন্ত্র পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান সংকটকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে যায়, যখন বাজারের কোনওরকম স্থায়িত্ব রক্ষা করা ও সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে, যখন সংকটের ফলে জীবনে অনিশ্চয়তার কঠিন আঘাতে জনসাধারণ বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকে– তখনএই পরিস্থিতিতে বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের মৌলিক নিয়মকে সবচেয়ে কার্যকরীভাবে বজায় রাখার জন্য, সংসদীয় গণতন্ত্রের আলখাল্লা পরিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্বকে আড়াল করার যাবতীয় প্রকরণকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷ এই সব ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদের মধ্যে কয়েকটি সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়, সেগুলিই তাকে চিনে নিতে সাহায্য করে৷ সেগুলি হ’ল প্রধানত অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বাধিক কেন্দ্রীভূত করা এবং প্রশাসনে চূড়ান্ত ক্ষতিকারক দৃঢ়তা (রিজিড ফার্মনেস) এইগুলি বেশি বেশি করে রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থের একাত্মতা গড়ে তোলে এবং সংসৃক্তির যন্ত্রীকরণ (কালচারাল রেজিমেন্টশন) সৃষ্টি করে৷ এই অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা, প্রশাসনিক কঠোরতা, সংসৃক্তির যন্ত্রীকরণ এবং রাষ্ট্র ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থের একাত্মতার চেহারা সব দেশে এক নয়৷ এটা নির্ভর করে প্রতিটি দেশে তার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উপর, স্বাভাবিকভাবেই যা দেশে দেশে ভিন্ন’’ (সময়ের আহ্বান, নির্বাচিত রচনাবলি, ২য় খণ্ড)৷ আজ ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী সব দেশেই গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, মানুষের প্রতিবাদের অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার যেন প্রতিযোগিতা চলছে শাসকদের মধ্যে৷ বিজেপি সরকার এ দেশে সেই ভূমিকাই পালন করে চলেছে৷
কাশ্মীর সহ সারা ভারতেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সহ ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার বজায় রাখতে গেলেও তীব্র গণআন্দোলন ছাড়া উপায় নেই৷ সেই আন্দোলনকে মানুষের জীবনের সমস্ত সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে মেলানো দরকার৷ একই সাথে দরকার এই অসুস্থ সমাজ বদলের প্রক্রিয়ার পরিপূরক লড়াইয়ের সাথে তাকে মেলানো৷ না হলে সাংবাদিকরা অধিকার হারিয়েই চলবেন৷