আগামী ২৪ এপ্রিল দেশ জুড়ে সাম্যবাদের স্বপ্নদর্শী বামপন্থী মানুষ গভীর মর্যাদার সঙ্গে পালন করবেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস।
দিনে দিনে দুঃসহ পরিস্থিতির ভার আরও বেশি করে চেপে বসছে জনগণের ওপর। পেট্রল-ডিজেল-জ্বালানী গ্যাস-খাদ্যশস্য-ভোজ্য তেল-শাকসবজি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্য অগ্নিমূল্য। সংসার খরচ এক ধাক্কায় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। বাড়তি পরিশ্রম করেও সে খরচ জোগাড় করার সুযোগ নেই। দেশের কর্মক্ষম কোটি কোটি মানুষ ভয়াবহ বেকার সমস্যায় জেরবার। অতিমারির প্রকোপ শুরু হওয়ার আগেই বেকারত্বের হার গত ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙেছিল। এরপর গত দু’বছরে কোভিড ও লকডাউনের ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেছে আরও লক্ষ লক্ষ ছোট-বড়-মাঝারি কলকারখানা, ব্যবসাপত্র। কাজ চলে গেছে কোটি কোটি মানুষের। আরও কয়েক কোটি মানুষ অর্ধেক বা তারও কম বেতনে কোনওক্রমে চাকরি টিকিয়ে রেখেছেন। দোকান-বাজারে কেনা-বেচায় মন্দা। ফসলের দাম পাচ্ছেন না চাষি। ছোট কৃষক ও কৃষি-মজুররা আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছেন ঋণের জালে। দারিদ্র ভয়াবহ আকার নিয়েছে। সমাজে নারী নিরাপত্তা চূড়ান্ত বিপন্ন।
এই অবস্থায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক,কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি তাদের ওপর একের পর এক সঙ্কটের বোঝা চাপিয়ে চলেছে। এই দুর্দিনে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে গ্যাসের ভর্তুকি। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গেলেও সরকারি দপ্তরের শূন্যপদগুলিতে নিয়োগ করা হচ্ছে না। বিদ্যুতের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসার মতো জরুরি পরিষেবাগুলিকে বাজারের পণ্য করে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিনামূল্যের ওষুধের সংখ্যা ক্রমাগত কমিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলিকে অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে, ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মালিকদের কব্জায়। মেহনতি মানুষের করের টাকায় গড়ে তোলা রেল, বিমানবন্দর, নদীবন্দর, খনির মতো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মুনাফা লুটের জন্য। সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি দু-পায়ে মাড়িয়ে পাশ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে একের পর এক কালা আইন। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে রক্ত ঝরানো আন্দোলনে অর্জিত শ্রমিকের অধিকারগুলি। পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে এইসব সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের ওপর শোষণের জোয়াল ক্রমে আরও শক্ত করছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে পুঁজিপতিদের আশীর্বাদ পেতে সরকারগুলি শ্রমিক শ্রেণির ঘাম-রক্তের বিনিময়়ে মালিকদের সিন্দুক ভরিয়ে তোলার অবাধ ব্যবস্থা করে চলেছে। পরিণামে, দেশের মানুষের এই চরম দুরবস্থার মধ্যেও ভারতে বিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়ন অর্থাৎ ১০০ কোটি) সম্পদের মালিকের সংখ্যা ৩৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪২। বৈষম্য আজ এমনই মাত্রাছাড়া যে, দেশের সবচেয়ে ধনী ৯৮ জন ধনকুবেরের হাতে জমা হয়েছে সবচেয়ে দরিদ্র ৫৫ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের সম্পদের সম-পরিমাণ অর্থ। আর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা যাতে গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য সমস্ত সরকারই অপসংস্কৃতি ও মদ-মাদকের ঢালাও প্রসারে মদত দিচ্ছে। যুবসমাজের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে সমাজ জুড়ে বইয়ে দিচ্ছে নোংরা যৌনতার স্রোত। শোষিত-অত্যাচারিত মানুষ যাতে এই অন্যায়ের মোকাবিলায় জোট বাঁধতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে নানা কৌশলে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে জাত-পাতের ভেদাভেদ, সাম্প্রদায়িকতার বিষ। ইতিহাস বিকৃত করে, অবাধে অসত্য, অর্ধসত্য প্রচার করে, সংখ্যালঘু মানুষকে গায়ের জোরে দমন করে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সংস্কার বাড়ছে। বাড়ছে আতঙ্ক ও অনৈক্যের মানসিকতা।
সাধারণ মানুষ যখন এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন, তখন কোনও সংসদীয় দলকেই কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে পথে নেমে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে দেখা যাচ্ছে না। ভোটের স্বার্থেও সংসদীয় দলগুলি আগে যেটুকু প্রতিবাদী আন্দোলন করত, এখন তাও করছে না। যে বামপন্থী দলগুলির কর্তব্য ছিল শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রাস্তায় জনগণকে টেনে আনা, কমিউনিস্ট নামধারী সেই বড় দলগুলিও সংসদীয় রাজনীতির জাবর কেটে চলেছে। তাদের যাবতীয় উৎসাহ ও কর্মকাণ্ড শুধু ভোটকে কেন্দ্র করে। যে কোনও উপায়ে ভোটে জিতে ক্ষমতা ভোগ করতে সামান্যতম নীতি-নৈতিকতার ধারও আজ ধারছে না তারা।
এই অবস্থায় সংকটগ্রস্ত সাধারণ মানুষের শোষণমুক্তির সংগ্রামের একমাত্র সাথী এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। গণমুক্তির স্বপ্ন বুকে নিয়ে আজ থেকে ৭৪ বছর আগে এই দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ যুগের অন্যতম প্রধান মা’র্বাদী দার্শনিক সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ। তিনি বুঝেছিলেন, শত শহিদের রক্তের বিনিময়ে এদেশে স্বাধীনতা এলেও গণমুক্তি অর্জিত হয়নি। দেশের মেহনতি মানুষের ওপর শোষণের জোয়াল চাপিয়ে মুনাফা লুটের লক্ষে্য ব্রিটিশের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি। মা’র্বাদের শিক্ষা সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে না পেরে কমিউনিস্ট নামধারী এ দেশের বড় বামপন্থী দলটি পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করার পরিবর্তে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে আপসকামী শক্তি হিসাবে কাজ করছে। এই অবস্থায় দেশে একটি প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে মাত্র কয়েকজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত কঠিন ও দৃঢ়পণ এক সংগ্রাম শুরু করেন কমরেড শিবদাস ঘোষ। জন্ম নেয় এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট), ১৯৪৮ সালের ২৪ এপ্রিল। সেই থেকে এই দলটি শাসক শোষক শ্রেণির সমস্ত আক্রমণ উপেক্ষা করে সংগ্রামী বামপন্থার ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শোষিত মেহনতি মানুষের প্রতিটি লড়াইয়ে সামিল রয়েছে।
শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি ও তার তল্পিবাহক সরকারগুলি খুব ভালো করেই জানে, এস ইউ সি আই (সি)-ই দলটির মধ্যেই রয়েছে তাদের মৃত্যুবাণ। তারা জানে, একমাত্র এই দলটিই অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে একের পর এক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে তুলতে এই শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। তাই এই দলটির কার্যকলাপ কোনও মতেই যাতে প্রচারের আলোয় না আসে, সে বিষয়ে অত্যন্ত যত্নবান পুঁজিপতিদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদমাধ্যম। এস ইউ সি আই (সি)-র আহ্বানে জনগণের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলিতে প্রায়শই তাই চলে নির্মম পুলিশি অত্যাচার। শাসক দলের অনুগত দুষ্কৃতীবাহিনী ও দলদাস পুলিশের হামলায় প্রাণ যায়, রক্ত ঝরে, জেলবন্দি হতে হয় এ দলের বিপ্লবী নেতা-কর্মীদের।
এই সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা কর়ে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা বুকে নিয়ে সংগ্রামী বামপন্থার পথ ধরে অক্লান্ত হাঁটছে এস ইউ সি আই (সি)। এই পথেই এই সংগ্রামী বামপন্থী দলটি ক্রমাগত জায়গা করে নিচ্ছে জনগণের বুকের মধ্যে। মানুষ উত্তরোত্তর বুঝতে পারছে, এই দলটিই তার দাবি আদায়ের, অধিকার রক্ষার লড়াই-আন্দোলনের একমাত্র বিশ্বস্ত সাথী। তাই এস ইউ সি আই (সি)-র ডাকে প্রতিটি আন্দোলনে আজ দলে দলে সামিল হচ্ছেন ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। লড়াই চলছে। কিছু কিছু দাবি আদায় হচ্ছে। আবার অপূরিতও থাকছে কিছু দাবি, যেগুলি অর্জন করতে গেলে এই দলটির শক্তিবৃদ্ধি ঘটিয়ে আন্দোলন আরও জোরদার করতে হবে। এস ইউ সি আই (সি)-র নেতৃত্বে দেশের প্রান্তে প্রান্তে শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে অত্যাচারিত মানুষের দল। তৈরি হচ্ছে জনসাধারণের আন্দোলনের নিজস্ব হাতিয়ার–গণকমিটি। সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে এই গণকমিটিগুলি একের পর এক গড়ে তুলতে থাকবে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিপূরক গণআন্দোলন। সংগ্রামের এই পথ ধরে হেঁটেই একদিন অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই শোষণমূলক ব্যবস্থাটিকে উচ্ছেদের লগ্ন উপস্থিত হবে। বিপ্লবের সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে দ্রুত এগিয়ে আনার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী গণআন্দোলনগুলিকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানাচ্ছে মহান ২৪ এপ্রিল।