কলকাতার পঞ্চাশ জন বিশিষ্ট মুসলিম নাগরিক গত ১৮ জুন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে এক পত্রে আবেদন করেছেন, রাজ্যে সংঘটিত কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই প্রশাসন যেন ধর্মবিচার না করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে৷
এই পত্রের প্রেক্ষিতটা ছিল এন আর এস হাসপাতালে ডাক্তারদের উপর হামলা এবং জনৈক অভিনেত্রীর ট্যাক্সি ঘিরে কিছু দুষ্কৃতীর অভব্য আচরণ৷ উভয়ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা ছিল ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম৷ এই সুযোগ বিজেপি হাতছাড়া করতে চায়নি৷ তাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক ঘটনা দু’টিতে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে বলতে থাকেন, মুসলিম বলেই অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না৷
নির্বাচনে ফায়দা তোলার জন্য ধর্মীয় মেরুকরণ সৃষ্টির কাজে বিজেপি এগিয়ে থাকলেও দেশের অন্যান্য বুর্জোয়া দলগুলিও এই কৌশল কমবেশি ব্যবহার করে থাকে৷ আর তাদের এই সাম্প্রদায়িক দুষ্ট রাজনীতির ফলে সমাজ–জীবনে অবিশ্বাস ও বিভাজনের এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়ে চলেছে, বিষাক্ত হয়ে উঠছে সমাজমনন৷ এই প্রেক্ষিতেই ওই বিশিষ্ট মুসলিম নাগরিকদের এই চিঠি৷
তাঁরা বলেছেন অপরাধীকে আইনি পথেই বিচার করে শাস্তি দিতে হবে৷ এক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনও যুবক যদি জড়িত থাকে, তাকেও যেন রেয়াত করা না হয়৷ তাঁরা মনে করছেন, একে ব্যবহার করে কায়েমী স্বার্থবাদীরা মুসলিম তোষণের অভিযোগ তোলার সুযোগ পেয়ে যাবে৷ এতে ধর্মীয় বিভাজন বাড়বে এবং তার ফলে মুসলিম সমাজেরই ক্ষতি হবে৷ নেট দুনিয়া সহ নানা প্রচারের মধ্য দিয়েও একের বিরুদ্ধে অপরের ঘৃণা উগরে দেওয়া বাড়বে৷ তাঁদের সম্প্রদায়ের হাজারো মানুষকে সমাজের চোখে অভিযুক্ত হিসাবে দাঁড় করানোর বিষয়টি আরও বাড়বে৷ এই সব ‘নীরব অভিযুক্ত’দের হয়েই তাঁদের এই চিঠি৷
ভোট রাজনীতির কী করুণ পরিণতি জাতীয়–জীবনের বিরাট পরিসরে ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষ নিজেকে সাবলীলভাবে মেলে ধরতে পারবে– এর নামই তো গণতন্ত্র৷ অথচ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আরও বেশি করে অবিশ্বাসের পাত্র করে তোলা হচ্ছে৷ বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের জিগির আজ এমনভাবেই সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে৷ মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যা মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, খাদ্যাভাব, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতার মূল কারণকে আড়াল করে সম্প্রদায়গত বিভেদকেই তারা সামনে নিয়ে আসছে৷ নইলে এন আর এসের ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনার কারণ যেখানে হাসপাতালের উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব ও নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা, অভিনেত্রীর ট্যাক্সিতে দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের পিছনের কারণ যেখানে আইন–শৃঙ্খলার খামতি, যেখানে বিজেপি সাম্প্রদায়িক রঙ চড়াতে গেল কেন? সমাজের আর্থ–সামাজিক পটভূমিতে যারা খাদ্য, শিক্ষা, চাকরি সহ সবরকমের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যথার্থ শিক্ষার অভাবে তাদের একটা অংশ অন্ধকার পথের শিকার হয়ে উঠে৷ এর সাথে ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায় কোনও যোগ নেই৷ সমাজের সর্বাঙ্গীন বিকাশের অবাধ সুযোগ সৃষ্টির পরিবেশই এদের আবার আলোর পথে টেনে আনতে পারে৷ বিজেপি এই সত্যটাকেই আড়াল করতে চাইছে৷
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের অনেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন, ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষের বৈচিত্র্যকে নিয়েই ভারতীয় জাতিসত্তা গড়ে উঠবে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহনশীলতার মধ্য দিয়ে৷ আজ স্বাধীন ভারতের শাসকেরা সেই বিশ্বাস ও সহনশীলতার পরিবর্তে অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে চলেছে মানুষের ঐক্যকে বিনষ্ট করতে৷ যাতে সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ একজোট হয়ে লড়তে না পারে, যেমনটি ব্রিটিশরা চেয়েছিল৷ ধর্মগত, বর্ণগত, প্রদেশগত বিভেদকে দূর করে ‘মানুষ’ পরিচয়ে সকলকে মেলানোর যে মানবিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনটি রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল, সেদিন গান্ধীবাদী নেতৃত্ব তা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেননি৷ সেদিন হিন্দু মহাসভা, আরএসএস বা মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ভারতীয়দের মধ্যে বিরোধ বাড়াতেই কাজ করে গেছে৷ সেকুলার মানবতাবাদের আদর্শকে গ্রহণ না করা এবং ধর্ম–বর্ণ–জাতপাতে সাথে আপস করার ফলে একটা অখণ্ড জাতি হিসাবে ভারতের গড়ে উঠা সম্ভব হয়নি৷ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় নবজাগরণের বলিষ্ঠ চিন্তাকে পাথেয় করে যে সামাজিক আন্দোলনের ধারা গড়ে উঠেছিল, পরবর্তীকালে সেই ধারাটি গৌণ হয়ে পড়ে৷ ফলে ভারতবর্ষ রাজনৈতিকভাবে একটা সার্বভৌম জাতি হিসাবে গড়ে উঠলেও, সামাজিক মননে, সংস্কৃতিতে এক হয়ে উঠতে পারেনি৷ পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের মতো স্বাধীন ভারতের শাসকরাও জনসাধারণের ঐক্য ভাঙতে এই সুযোগকেই গ্রহণ করেছে৷ তার জের ভোগ করতে হচ্ছে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে৷
এর প্রতিকার কী? ভোটসর্বস্ব এই দলগুলির হীন রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রকৃত সেকুলার শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে এবং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল অংশের শ্রমজীবী মানুষের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই বিভেদ দূর হবে, ঐক্য গড়ে উঠবে৷ এ ছাড়া কোনও সহজ রাস্তা নেই৷