শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুগে যুগে ফুঁসে ওঠা জনরোষের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসাবে থেকে গেল শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান। গোটা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য রেখে গেল অত্যন্ত স্পষ্ট দুটি শিক্ষা। দেখিয়ে দিয়ে গেল, যতবড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, জেগে ওঠা জনতার শক্তির কাছে অত্যাচারী শাসক বন্যার জলে খড়কুটো বৈ কিছু নয়। পাশাপাশি এ শিক্ষাও রেখে গেল, নিপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে না পাল্টে শুধু শাসকের নাম বদলে জনগণের দুর্দশা ঘোচে না।
বিক্ষোভের সূচনা অনেক দিন আগে
সম্প্রতি যে জনবিক্ষোভের সাক্ষী থাকল শ্রীলঙ্কা, যার জেরে প্রাসাদ ছেড়ে মহাপরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে সস্ত্রীক দেশ ছেড়ে পালাতে হল, তার সূচনা অন্তত এক বছর আগে। এরও আগে দীর্ঘদিন ধরেই একটু একটু করে অর্থনৈতিক সঙ্কট গ্রাস করছিল এই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। মূলত আমদানি-রপ্তানি ও পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল শ্রীলঙ্কায় উৎপাদন শিল্প তেমন গড়ে ওঠেনি। ১৯৪৮-এ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার কোনও সরকারই উৎপাদন শিল্প গড়ে তোলার দিকে গুরুত্ব দেয়নি। প্রথম দিকে পরিস্থিতি অনুকূল থাকলেও ১৯৬০-এর দশক থেকে রপ্তানি-আয়ের তুলনায় বাড়তে থাকে আমদানির খরচ। ঘাটতি মেটাতে সাহায্যের অছিলায় ঋণের ঝুলি নিয়ে প্রবেশ করে সাম্রাজ্যবাদী আর্থিক সংস্থা আইএমএফ। ঋণ দেওয়ার বিনিময়ে অর্থনীতির উদারিকরণের শর্ত চাপায়। ধীরে ধীরে বিদেশি ঋণ গ্রাস করতে থাকে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে। ১৯৭৭ সালে যে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি ডলার, ২০২০ সালে পৌঁছে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে। এই ঋণের অধিকাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৮১ শতাংশের যোগানদার আমেরিকা ও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী আর্থিক সংস্থা, জাপান ও ভারত। চিনও আছে ঋণদাতার তালিকায়। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের কারণে আর্থিক সাহায্য, ঋণ ও নানা ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই সবক’টি দেশই। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ নিয়মেই ব্যবসা-বাণিজ্য, চা-কফির মতো বৃহৎ বাগিচা ফসলের চাষ ও পর্যটন শিল্পের মধ্যে দিয়ে জন্ম নিয়েছে সে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই শ্রেণির কিছু মানুষের আর্থিক রমরমা ঘটলেও আর পাঁচটা পুঁজিবাদী দেশের মতো শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষ বেকারি, গরিবির জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে। একই সঙ্গে ঋণের শর্ত মেনে ক্রমেই কমেছে সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে সরকারের অর্থ বরাদ্দ। স্বাভাবিক কারণেই সরকারবিরোধী ক্ষোভ জমা হতে থেকেছে তাদের বুকে।
স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টের জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ
এদিকে ২০১৯-এ উগ্র সিংহলী-বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী আবেগে ভর করে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। ক্ষমতায় বসেই নিজের দাদা, পূর্বতন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়েছেন তিনি। নিজের আরও দুই ভাই সহ পরিবারের অন্যান্যদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলিতে বসিয়ে দিয়ে সরকারের ওপর রাজাপক্ষে পরিবারের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছেন গোতাবায়া। স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাপক বিলাসী জীবন যাপন করার পাশাপাশি এইসব ক্ষমতাশালীরা বেআইনি ভাবে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ক্ষমতায় বসেই পুঁজিপতিদের জন্য বিপুল কর ছাড়ের ব্যবস্থা করেন। পর্যটন শিল্পের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের প্রায় ৬০ শতাংশ করছাড় দেন তিনি। ফলে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় এমনিতেই বাণিজ্য ঘাটতিতে ভোগা শ্রীলঙ্কায় সরকারি আয়ের পরিমাণ ব্যাপক ভাবে কমতে থাকে। এই অবস্থায় নেমে আসে কোভিড অতিমারির বিপর্যয়। তছনছ হয়ে যায় শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প। রাজকোষ ঘাটতি ভয়ঙ্কর আকার নেয়। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে টান পড়ে। তীব্র আর্থিক সঙ্কট মাথা তোলে। সার আমদানি ও সরকারি ভরতুকির খরচ কমাতে দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে আচমকা রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কার চাষবাস ও বিশেষ করে বাগিচা শিল্প। কিন্তু কোনও ভাবেই এই প্রবল আর্থিক সঙ্কট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি গোতাবায়া সরকার। খাদ্যশস্য সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁতে থাকে। অমিল হয় দুধ, শিশুখাদ্য সহ পেট্রল-ডিজেল-কেরোসিনের মতো অপরিহার্য জ্বালানি। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বিদ্যুৎ ছাঁটাই চলতে থাকে। চূড়ান্ত বিপর্যস্ত হয় জনজীবন। গোতাবায়া সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকে।
গতি পেল বিক্ষোভ
রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ হওয়ায় চাষবাসের ক্ষতিকে কেন্দ্র করে গত এক বছর ধরেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কার কৃষিজীবী মানুষ। শিক্ষক ও বাগিচা শ্রমিকরাও বেতন-মজুরি বৃদ্ধি সহ অন্যান্য দাবিতে বারবার রাস্তায় নামছিলেন। এবার দেশে চরম আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসায় এ বছরের মার্চ মাস থেকে ব্যাপক বিক্ষোভ আছড়ে পড়ে রাজধানী কলম্বো সহ দেশের নানা প্রান্তে-প্রত্যন্তে। হাজার হাজার খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। কোনও সংগঠিত নেতৃত্ব ছাড়াই এই গণবিক্ষোভ এমন তীব্র আকার ধারণ করে যে, আতঙ্কে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। প্রাসাদ ছেড়ে পালান তিনি। চলে যান নৌবাহিনীর আশ্রয়ে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন রনিল বিক্রমসিংঘে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের নিরস্ত করা যায়নি। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান ওঠে ‘গো গোতাবায়া গো’। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বহু জায়গায় কার্ফু জারি হয়। জরুরি অবস্থা জারি করেন রাজাপক্ষে। নামানো হয় বিশেষ টাস্ক ফোর্স ও আধা সামরিক বাহিনীকেও। কিন্তু দুর্দম জনতাকে কোনও মতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি গোতাবায়া সরকার। দিনের পর দিন জীবনের তোয়াক্কা না করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে মানুষ। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারান। আহত হন অসংখ্য। মাসের পর মাস ধরে জনবিরোধী গোতাবায়া সরকারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়তে থাকে জনতার প্রবল ক্ষোভ। পাঁচ মাস ধরে বিক্ষোভের পর অবশেষে আসে ঘটনাবহুল ৯ জুলাই। সেদিন প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ছেড়ে নৌবাহিনীর কাছে আশ্রয় নেন গোতাবায়া। এবং তাঁর পালাবার খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ও সচিবালয়ে। জাতীয় পতাকা হাতে দখল নিয়ে নেয় সেগুলির। পুলিশ ও সামরিক বাহিনী কোনও ভাবেই বাধা দিতে পারেনি এই বিপুল জনস্রোতকে। সেদিন থেকে ১৪ জুলাই অবধি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদ ও সরকারি দপ্তরগুলি ছিল কার্যত জনতার দখলে। শ্রীলঙ্কা থেকে প্রথমে মলদ্বীপে ও তারপর সেখান থেকে তাড়া খেয়ে সিঙ্গাপুরে ঘাঁটি গেড়ে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ১৪ জুলাই দেশে পদত্যাগপত্র পাঠান। এ খবর জেনে কার্ফু উপেক্ষা করে উৎসবে মাতেন বিক্ষোভকারীরা। পরদিন প্রাসাদ ও সরকারি দপ্তর ছেড়ে তাঁরা বেরিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির দখল নেয় দেশের সামরিক বাহিনী।
জনগণের জাগ্রত শক্তির কাছে অত্যাচারী শাসকের ক্ষমতা তুচ্ছ
পূর্বতন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের প্রতিরক্ষা সচিব হিসাবে ২০০৫ সালে তামিল সংখ্যালঘু নিধনে যে নৃশংস বর্বরতার পরিচয় রেখেছিলেন পলাতক সদ্যপ্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া, তা তাঁকে ঘিরে আতঙ্ক মিশ্রিত সমীহের এক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলে তামিল জনগোষ্ঠীকে বুটের তলায় পিষে দিয়ে তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী-বৌদ্ধদের সমর্থন আদায় করেছিলেন। গোতাবায়া প্রতিরক্ষা সচিব থাকাকালীন খুন করা হয়েছিল প্রায় ৭৫ হাজার সিংহলী-তামিলকে। মিলিটারিসুলভ শৃঙ্খলা অনুসরণকারী আধিপত্যবাদী গোতাবায়া বরাবরই উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগে হাওয়া দিয়ে গিয়েছেন। দুর্বল হয়ে পড়া তামিল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিষোদগার আর সেই সুফল দিচ্ছে না বুঝে ইদানীং শ্রীলঙ্কার মুসলমান সম্প্রদায়ের দিকে তিনি তাক করেছিলেন ঘৃণার তীর। পাশাপাশি সরকারি ক্ষমতার বলে বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশ নিজের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে এনে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রবল প্রতাপশালী, অপ্রতিরোধ্য শাসকের নিজস্ব এক ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন। এ হেন গোতাবায়াকে যে ভাবে প্রথমে প্রাসাদ ছেড়ে ও পরে সুযোগ বুঝে বিক্ষোভকারীদের হাত এড়িয়ে বিদেশে পালাতে হল, যে ভাবে দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের প্রবল ঘৃণার স্রোত তাঁকে দেশছাড়া করল, তাতে এ কথা আরও একবার পরিষ্কার হল যে, শাসক যত পরাক্রমশালীই হোক, জনগণের জাগ্রত শক্তির কাছে তার ক্ষমতা তুচ্ছ।
জনজীবনের মূল সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের এই সংগ্রামী মেজাজ, প্রাণের পরওয়া না করে শ্রীলঙ্কার হাজার হাজার মানুষের এই অভ্যুত্থান বিশ্ব জুড়ে গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের অভিনন্দন কুড়িয়েছে। অনেকে এই গণঅভ্যুত্থানকে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে শীতপ্রাসাদ দখলের সঙ্গে তুলনা করে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাস্তবে দুটি ঘটনায় মূলগত পার্থক্য রয়েছে। রাশিয়ার বিপ্লবী জনগণ ১৯১৭ সালে শীতপ্রাসাদ দখল করে শোষণমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে জনগণের রাজ কায়েম করেছিল। সেখানে একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, আপাতদৃষ্টিতে দাবি আদায় হয়েছে বলে মনে হলেও, বাস্তবে শ্রীলঙ্কার এই গণঅভ্যুত্থানে সেখানকার জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি সমাধানের কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার দেশ ছেড়ে পালানো ও শেষপর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে পদত্যাগের ঘটনা শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের মধ্যে খুশির হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। প্রাসাদের দখল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তাই অকাতরে মিষ্টি বিলিয়েছেন তাঁরা, বাজি পুড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। হয়তো ভেবেছেন, আধিপত্যবাদী, স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বজনপোষক প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করানোর দাবি তো আদায় হয়েছে, ফলে এবার আন্দোলনের ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ ঘটল।
কিন্তু গোতাবায়াকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর স্লোগানের পিছনে মূল দাবি ছিল বেকারি, গরিবি, মূল্যবৃদ্ধির মতো যে সমস্যাগুলি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে, সেগুলি থেকে মুক্তি। আসল চাওয়া ছিল, সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, জনগণের সম্পত্তির অবাধ লুঠতরাজ বন্ধ হোক। জনগণ চেয়েছেন পুঁজিপতি তোষণকারী নীতি থেকে সরে এসে সরকার জনস্বার্থ রক্ষায় নজর দিক। ‘রাইট টু রিকল’ অর্থাৎ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি জনবিরোধী কাজ বা দুর্নীতি করলে, তাঁদের পদ থেকে সরানোর অধিকার চেয়েছেন তাঁরা। চলতি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তথা শ্রীলঙ্কার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোটিকে অটুট রেখে শুধু প্রেসিডেন্ট বদলে এই সমস্ত গণতান্ত্রিক দাবি কী করে আদায় হওয়া সম্ভব?
সমস্যার মূলে আঘাত করতে পারেনি এই গণবিক্ষোভ
অত্যন্ত আফশোসের কথা যে, প্রাণ বাজি রাখা প্রবল এই গণআন্দোলন সত্তে্বও শ্রীলঙ্কার মানুষের কাঙ্খিত দাবি-দাওয়াগুলি আদায় হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। শোষণমূলক যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তাঁদের সকল সমস্যার মূলে রয়েছে, তার গায়ে এই বিক্ষোভ সামান্য আঁচড়টুকুও কাটতে পারেনি। বিক্ষোভের ব্যাপকতা দেখে দেশের সেনাবাহিনী তা প্রতিরোধে সক্রিয় হয়নি ঠিকই, কিন্তু প্রাসাদ ও সরকারি দপ্তরগুলি থেকে বিক্ষোভকারীরা সরে যাওয়া মাত্রই সেগুলির দখল নিয়ে নিয়েছে তারা। পার্লামেন্টের সামনে এখন পুলিশের ব্যারিকেড। মোতায়েন রয়েছে শ্রীলঙ্কা রাষ্টে্রর পাহারাদার সেনাবাহিনী। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় তারা মুড়ে রেখেছে পার্লামেন্টের ভিতরে থাকা প্রতিনিধিদের।
এই প্রতিনিধিরা কারা? এরা কি শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের রক্ষক? একেবারেই তা নয়। সেখানে রয়েছেন শাসকদল এসএলপিপি-র সদস্যরা। পার্লামেন্টে এঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ছিলেন এই এসএলপিপি-রই নেতা। এর বাইরে বিরোধী দলের সদস্যরা যাঁরা পার্লামেন্টে আছেন, তাঁরা সকলেই স্থিতাবস্থার পক্ষে, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিরই সক্রিয় সমর্থক। আন্দোলনকারীদের প্রতি তাঁদের কারওরই সুনজর নেই। এঁরা সকলেই চেয়েছেন, জনসাধারণের মধ্যে বিদ্রোহের যে আগুন জ্বলে উঠেছে, যে কোনও প্রকারে তা নিভিয়ে কত দ্রুত আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের ওপর সংখ্যালঘু ধনী ও প্রভাবশালীদের শোষণের জোয়াল চাপিয়ে দেওয়া যায়। সে কাজে সফলও হয়েছেন তাঁরা। তাই গোতাবায়ার পদত্যাগের পরে পরবর্তী নির্বাচনের আগে পর্যন্ত অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁরা সৎ, নিরপেক্ষ, সংগ্রামী, জনস্বার্থের রক্ষক কাউকে নয়, বেছে নিয়েছেন রনিল বিক্রমসিংঘেকে। এই রনিল শুধু এসএলপিপি-রই একজন নেতা তাই নয়, ইনি হলেন স্বয়ং গোতাবায়া মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। তাঁর বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতির বহু অভিযোগ।
গোতাবায়াকে পদত্যাগ করিয়ে দেশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো গণবিদ্রোহের বাঘটিকে যেই এই নেতারা একবার খাঁচায় পুরতে সক্ষম হয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে তাঁদের জনস্বার্থবিরোধী স্বরূপ। বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর পার্লামেন্টের ভিতরে শান্তিতে বসে এবার তাঁরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করেছেন, দলীয় প্রার্থীদের নাম মনোনীত করেছেন। এবং বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে জনগণের অংশগ্রহণ সম্পূর্ণ ছেঁটে ফেলে দিয়েছেন তাঁরা। কেড়ে নিয়েছেন মানুষের ভোটদানের অধিকার। ঠিক হয়েছে, এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন জনপ্রতিনিধিদের গোপন ভোটে। ১৯৭৮ সালের পর এই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকে।
এখানেই শেষ নয়। সাধারণ মানুষ সম্পর্কে তাঁদের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে রনিলের আরও একটি মন্তব্যে। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেই তিনি বলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বলেছেন, ‘বিক্ষোভকারী ও দাঙ্গাকারীদের মধ্যে পার্থক্য আছে’। জনসাধারণের যে বিক্ষোভে মাত্র ক’দিন আগে তাঁদের ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব উঠেছিল, বিক্ষোভের উত্তাপ ঠাণ্ডা হতে না হতেই তাকে দাঙ্গা বলে দাগিয়ে দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন না তিনি!
প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ লাগাতার আন্দোলন
এই সাহস রাষ্ট্রনায়করা পাচ্ছেন কোথা থেকে? এখানেই রয়েছে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক এই গণবিক্ষোভের দুর্বলতা। দখল করা প্রাসাদ ও সরকারি দপ্তর খালি করে দেওয়ার আগে যদি আন্দোলনকারীরা পার্লামেন্টের কাছ থেকে দাবি মানার নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারতেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনসাধারণের ভোট দানের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা রুখে দিয়ে নির্বাচনকেও আন্দোলনের অংশে পরিণত করতে পারতেন এবং নিজেদের দাবিগুলি একে একে পূরণ হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রেখে, প্রয়োজনে আবার তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলার মতো করে সংগঠিত হতে পারতেন, তাহলে এই অসামান্য গণবিক্ষোভের এমন পরিণতি হত না।
কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন ছিল সঠিক মা’র্বাদী বিপ্লবী নেতৃত্বে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন, যার একান্ত অভাব দেখা গেল শ্রীলঙ্কায়। প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত নেতৃত্বে আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক হাতিয়ার ‘গণকমিটি’ গঠনের। আন্দোলন একটা পর্যায়ে থেমে গেলেও এই কমিটিগুলি সরকারের কার্যকলাপের দিকে তীক্ষ® নজর রাখতে পারত। সরকার প্রতিশ্রুতি পূরণ না করলে এই গণকমিটিগুলি আবার দেশজোড়া আন্দোলনের ডাক দিতে পারত। সরকারকে বাধ্য করতে পারত দাবি মানতে। এইভাবে একটার পর একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে তুলতে সমস্ত সমস্যার মূল, দেশে কায়েম থাকা শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকেই উচ্ছেদের সংগ্রামে দেশবাসীকে সামিল করতে পারত। যতদিন গণবিক্ষোভগুলি এই অভিমুখে, সঠিক পদ্ধতি ও নেতৃত্বে সংগঠিত হতে না পারবে, ততদিন সেগুলির এমন পরিণতিই হবে, অত্যন্ত দুঃখের হলেও যা ঘটারই সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অসমসাহসী, বীরত্বপূর্ণ অসাধারণ গণবিক্ষোভ বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে এই শিক্ষাই রেখে গেল।