সম্প্রতি পার্লামেন্টে শ্রম সংস্কার বিল পাশ করাল মোদি সরকার। শ্রমিক সংগঠনগুলির মতে এই সংস্কার আসলে শ্রমিক সংহারের খড়গ। দুই দশক আগে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের নীতি অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হওয়ার পর থেকেই পুঁজিপতিদের দাবি মতো এ দেশের শাসকগোষ্ঠী চেষ্টা করছিল শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘদিনের অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়ার। তাদের দাবি ছিল ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ অর্থাৎ ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার উপযোগী করে শ্রম আইনের বিধিগুলিকে সংস্কার করা। ২০০৮-এর ভয়াবহ মন্দা পরিস্থিতি যত দীর্ঘায়িত হল,ততই এ দেশের কর্পোরেটদের পক্ষ থেকে এই চাহিদা পূরণের চাপ তাদের সেবাদাস রাজনৈতিক দলগুলির উপর বৃদ্ধি পেল। কংগ্রেস পরিচালিত পূর্বতন ইউপিএ সরকারই হোক আর বিজেপি পরিচালিত বর্তমান এনডিএ সরকারই হোক– উভয়ের কারোরই উদ্যোগের ঘাটতি ছিল না শ্রম সংস্কারের বিষয়ে। এইসব সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক আন্দোলনকে ভোঁতা করে দেওয়া। তাদের শোষণের সামনে বাধা ছিল সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন। সেই লক্ষ্যেই শ্রম আইনের ৪৪টি ধারার মধ্যে পনেরোটি বর্তমানে অকার্যকরী তকমা দিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাকি ২৯টি ধারাকে চারটি বিধিতে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছিল গতবছরই। শুধু মজুরি সংক্রান্ত বিধি ছাড়া বাকিগুলি তখন পেশ করা হয়নি। এ বছর করোনার আবহে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বাকি তিনটি বিধিকেও তড়িঘড়ি পাশ করিয়ে নিল বিরোধীশূন্য পার্লামেন্টে। যেখানে পঞ্চাশ কোটি শ্রমিকের স্বার্থ জড়িত, তাদের জীবনজীবিকা রক্ষা গভীরভাবে যুক্ত, সেই বিধিগুলি দ্রুততার সাথে কোন তর্কবিতর্ক ছাড়াই কেবলমাত্র সরকার পক্ষের উপস্থিতিতে মাত্র কয়েক ঘন্টার আলোচনার নামে প্রহসনের মধ্যদিয়ে পাশ হয়ে গেল।
কী আছে এই বিধিগুলিতে? শিল্প-সম্পর্ক সংক্রান্ত বিধিতে বলা হয়েছে এখন কারখানায় স্ট্রাইক করতে হলে পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন দেখাতে হবে। নতুবা তা ‘মাস ক্যাজুয়াল লিভে’ পরিণত হবে। এমনকি স্ট্রাইক ঘোষণা করতে হলে ৬০ দিন আগে নোটিশ দিয়ে জানাতে হবে। আর যদি বিষয়টি ‘ন্যাশনাল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ট্রাইবুনাল’এ বিচারাধীন থাকে,তাহলে শুনানি শেষ হওয়ার পর থেকে ৬০ দিন সময় নিয়ে স্ট্রাইক ঘোষণা করতে হবে। অর্থাৎ আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হল। অথচ এই স্ট্রাইকই ছিল মালিকী শোষণ বঞ্চনার সামনে শ্রমিকের আত্মরক্ষার অস্ত্র। আগে সর্বাধিক ১০০ জন শ্রমিক আছে, এমন সংস্থায় মালিক ইচ্ছে মতন ছাঁটাই করতে পারত। সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হত না। নতুন বিধিতে সেটা বাড়িয়ে ৩০০ জন করা হল। অর্থাৎ ছাঁটাইয়ের আওতায় বেশি শ্রমিককে আনা হল। সকলেই জানেন বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির কারণে অল্প শ্রমিকেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কারখানা চলছে। প্রায় ৭৫ শতাংশ কারখানাই চলছে কম শ্রমিকে। বর্তমান শ্রম সংস্কারে এইসব কারখানার মালিকদের কাছে ছাঁটাই বাড়তি বিপদ সৃষ্টি হল। এমনকি এই কারখানাগুলির ক্ষেত্রে চাকরির স্থায়ী নির্দিষ্ট শর্তাবলী বলে কিছু রইল না। মালিকরা যখন যা খুশি শর্ত শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অস্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা আর থাকছে না। শুধু তাদের জন্মভিটা থেকে কাজের জায়গায় ফেরার খরচটুকু দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মাসে বেতন সর্বোচ্চ আঠারো হাজার টাকা হলে তবেই তারা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে গণ্য হবে। এর মধ্য থেকেই তাদের নিজেদের থাকা-খাওয়ার সংস্থান করতে হবে। এগুলিই হচ্ছে ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’। শ্রমিকের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মালিকদের মুনাফা লোটার খোলাখুলি ব্যবস্থা করা হল। এই শ্রম আইন সংস্কারের মধ্য দিয়ে।প্রধানমন্ত্রী এবং শ্রমমন্ত্রী খোলাখুলিই বলছেন এটা কার্যকরী হলে ভারতের অর্থনীতির ক্ষেত্রটি দেশের তথা বিশ্বের উদ্যোগপতিদের চুম্বকের মত আকর্ষণ করবে, দেশে লগ্নি বাড়বে। কিন্তু এর পরিণাম কী? বাস্তবে এর ফলে দেশের পঞ্চাশ কোটি শ্রমিকের জীবন আরও বেশি করে ধুঁকতে থাকবে। অর্থনীতিতে বাড়বে আরও মন্দা। শ্রম আইনের সংস্কার করে শ্রমিক অধিকার হরণের এই ধূর্ত চেষ্টা শ্রমিকরা মানছে না। ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি নভেম্বরে সর্বভারতীয় ধর্মঘটের কথাও ঘোষণা করেছে।
শোষণমুক্তির পথপ্রদর্শক কার্ল মার্কস দেখিয়েছিলেন শ্রমিকের ন্যায্য প্রাপ্য আত্মসাৎ করেই মালিকের মুনাফা বা উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টি হয়। ফলে মুষ্টিমেয় মালিকের মুনাফা যত বাডে, কোটি কোটি শ্রমিকের জীবনে শোষণ-বঞ্চনার পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত নিঃশেষিত হওয়ায় অর্থনীতির বাজার আরও সংকুচিত হয়। দেখা দেয় মন্দা। মালিকের মুনাফা নীতিই এই সংকটের জন্ম দেয়। শ্রম আইনকে মালিকমুখী করে শ্রমিকের শোষণ আরো বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু অর্থনীতির সংকটমুক্তির কোন দাওয়াই এটা নয়। এই শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষ ফেটে পড়বেই। এই বিক্ষোভকে পরিচালিত হতে হবে শোষণমূলক পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে। এরজন্য শ্রমিকদেরও ভোটসর্বস্ব রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সঠিক বিপ্লবী রাজনীতির ভিত্তিতে লড়াই গড়ে তুলতে হবে।
(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ৮ সংখ্যা_৫ অক্টোবর, ২০২০)