সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন শ্রম অধিকার সম্পর্কে যে আন্তর্জাতিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে বিশ্বের ১৫১টি দেশের মধ্যে ভারত সব থেকে পিছিয়ে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষের ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। মোদি সরকার ২৯টি শ্রম আইন পাল্টে দিয়ে যে চারটি শ্রমকোড এনেছে তাতে হরণ করা হয়েছে ইউনিয়ন করার অধিকার। আমাদের দেশের একদল মানুষ শ্রমিক ইউনিয়নের কথা শুনলেই বলে ওঠেন, সরকার ঠিক করেছে ইউনিয়ন করার অধিকার হরণ করে। কিন্তু তাঁরা ভেবে দেখেন না, ইউনিয়ন গড়ে শ্রমিকরা যদি তাঁদের ন্যায্য দাবিগুলি তুলে ধরতে না পারেন এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেগুলি আদায় করতে না পারেন তবে তাঁরা মালিকদের একতরফা শোষণ-লুণ্ঠনের শিকার হতেই থাকবেন। মনে রাখা দরকার, মালিকদের এমন একতরফা অধিকার দিয়ে দিলে সমাজের বাকি অংশও তাদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাবে না।
কেন্দ্রের মোদি সরকার বিকশিত ভারতের মন্ত্র জপ করে চলেছে। তাঁর রাজত্বে কাদের বিকাশ ঘটছে? সম্প্রতি ‘গণদাবী”তে আমরা দেখিয়েছি ভারত যে অর্থনীতিতে চতুর্থ হওয়ার দাবি করছে, জনজীবনে তার কোনও সুফলই ফলবে না। সাধারণ মানুষের জীবনে তার কোনও ছোঁয়া নেই। এই সমৃদ্ধি ভারতের একচেটে পুঁজিপতি শ্রেণির। বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যার নিচের দিকের ৫০ শতাংশের গড় মাসিক আয় ৫৯৩০ টাকা, মাঝের ৪০ শতাংশের গড় আয় ১৩,৭৫০ টাকা। সব মিলিয়ে ৯০ শতাংশের আয় যা, তাতে সুস্থভাবে পরিবার প্রতিপালন করাই কঠিন। আর উপরের ১ শতাংশের গড় আয় মাসে সাড়ে ৪ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। সর্বোচ্চ ০.১ শতাংশের গড় আয় মাসে প্রায় ১৯ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। এই তথ্য দেখিয়ে দেয়, মোদি সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত বিকশিত ভারতে বাস্তবে কাদের বিকাশ ঘটেছে। এই যে ধনকুবেরদের বিপুল সমৃদ্ধি, এটাই বিজেপি সরকারের বিকশিত ভারতের মডেল।
এই ভারতে শ্রমিক, চাষির স্থান কোথায়? ভারতের শ্রমশক্তির কমবেশি ৯৫ শতাংশই অসংগঠিত। এই ক্ষেত্রের বেশিরভাগ শ্রমিক শ্রম আইনের আওতার বাইরে। এদের কোনও আইনি সুরক্ষা নেই। এদের একটা বিশাল অংশের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি, নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো, পিএফ-পেনশনের ব্যবস্থা ইত্যাদি কোনও সুবিধা নেই, মালিক যেমন খুশি কম বেতন দিতে পারে, যখন খুশি ছাঁটাই করতে পারে। বর্তমানে ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে সম কাজে সম বেতনের নীতি। কাজের সুযোগও ক্রমাগত কমছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনই মালিকদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়ায়, উৎপাদন ব্যয় সর্বনিম্ন করার চেষ্টা মালিকরা করে চলেছে। সেই লক্ষ্যেই উন্নত প্রযুক্তি বসছে। তাতে ছাঁটাই হচ্ছে শ্রমিক। কাজের স্থায়ীপদগুলিকেও অস্থায়ী করে দেওয়া হচ্ছে। পদ বিলোপ ঘটছে। বেতন কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকরা এতদিন ধরে যে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধাগুলি পেতেন, সেগুলিও ছাঁটাই বা বন্ধ হচ্ছে। বেতন হ্রাস এবং কাজের সময় বৃদ্ধি পুঁজিপতিদের মুনাফার বিপুল উৎস।
মোদি বিজ্ঞাপিত বিকশিত ভারত বা শ্রম অধিকারে পিছিয়ে ভারত– দুটো চিত্রই আজ বাস্তব। ৫ শতাংশ ধনীর বিকাশকে যদি বলা হয় ফল, তা হলে ৯৫ শতাংশের পিছিয়ে পড়া অবস্থাকে বলা যেতে পারে তার কারণ। এক শ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁরা সমাজে থাকা শ্রেণিবিভাগ মানতে চান না, দেশটা যে ধনী-গরিবে, মালিক-মজুরে বিভক্ত তা মানতে চান না– উপরের আলোচ্য তথ্য কি তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন? আর দেশটা যদি শ্রেণিবিভক্ত হয় তা হলে সরকার কোন শ্রেণির স্বার্থে শাসন করছে, এটা ভেবে দেখা কি জরুরি নয়?
শ্রমিক মালিকের স্বার্থ যে পরস্পরবিরোধী, এটা স্বীকার করে না বিজেপির শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ। এ ছাড়া রয়েছে, আরও কিছু দল, যারা শিল্পে শান্তি রক্ষার কুম্ভীরাশ্রু ফেলে শ্রমিক আন্দোলনের রাশ টেনে ধরে। শিল্পে অশান্তির কারণ যে শ্রমিকরা নন, মালিকি বঞ্চনাই যে শ্রমিকদের অশান্ত করে তোলে, বিক্ষুব্ধ করে তোলে, এ সব মানতে তারা চায় না। এই প্রতিবেদন তৈরির সময় ডুয়ার্সের ৭টি চা বাগান বন্ধ। পাহাড়ে বন্ধ ৮টি। মালিকরাই বন্ধ করে দিয়েছে। গত ১০ বছরে তুরতুরি চা বাগান ৫ বার বন্ধ হল। বাগানের শ্রমিক দুর্গা খেড়িয়ার কথায় ‘শ্রমিকদের মজুরি থেকে বোনাস কোনওটাই ঠিকমতো মিলত না। প্রায় ১২০ দিনের মজুরি বকেয়া রয়েছে শ্রমিকদের। প্রাপ্য না দিয়ে মালিক পালিয়ে গেল”। আজ শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে পথে বসেছে। খাবে কী? কোথাও কোনও নিশ্চয়তা নেই। ফলে মালিকি বঞ্চনার তীব্রতা বৃদ্ধি শ্রমিকদের আন্দোলনের দিকে ঠেলছে। সমস্ত কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা মালিকি বঞ্চনার শিকার। এর বিরুদ্ধে শ্রমিকরা আন্দোলনে ফেটে পড়ছে। শ্রমিকরা অধিকার রক্ষার দাবিতে সংগঠিত হচ্ছে। আগামী ৯ জুলাই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ভারতের এআইইউটিইউসি সহ ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যুক্ত মঞ্চ। তার সমর্থনে দাঁড়িয়েছে কর্মচারীদের নানা সংগঠন। এস ইউ সি আই (সি) এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে।
শ্রমিক এবং মালিকের এই লড়াইয়ে জিতবে শ্রমিক শ্রেণি। কারণ সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছে। শ্রমের ন্যায্য দাবিতে লড়ছে। তার লড়াই প্রগতির লড়াই। লড়াইয়ের প্রগতিশীল চরিত্রের জন্যই শ্রমিক জিতবে। দ্বিতীয় কারণটি হল– শ্রমিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাঁদের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। পুঁজিবাদ তার অর্থনৈতিক নিয়মেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরোধী শক্তি হিসাবে শ্রমিক সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই শ্রমিক আন্দোলনের প্রাবল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। ভারত তার বাইরে নয়। ভারতেও শ্রমিক বিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে। শ্রম অধিকারের নিরিখে যে ভারত পিছিয়ে, সেখানে ধর্মঘট তো অবশ্যই তার স্বাভাবিক পরিণাম। এই ধর্মঘটের পাশে সাধারণ মানুষকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ২৭ জুন – ৩ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত