শাসকের বুকে কাঁপন ধরানো সুবিশাল শ্রমিক বিক্ষোভ এবং ধর্মঘটের সাক্ষী থাকল পশ্চিম ইউরোপের বেলজিয়াম। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি প্রতিদিনের বেঁচে থাকাকে ক্রমশ কঠিন করে তুলছে, অথচ তার সাথে সঙ্গতি রেখে আদৌ বাড়ছে না বেতন। এর প্রতিবাদে গত ২০ জুন আশি হাজারেরও বেশি শ্রমজীবী মানুষ সমবেত হয়ে বিক্ষোভ দেখালেন রাজধানী ব্রাসেলস-এর রাজপথে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, বামপন্থী দল এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। ছিলেন বিভিন্ন ছাত্র ও যুব সংগঠনের সদস্যরাও।
বেলজিয়ামের শ্রমিকরা তাঁদের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো নিয়ে লড়ছেন বহুদিন ধরে। এক বছর আগে শুরু হওয়া শ্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই এদিনের বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশে সামিল হয়েছিলেন তারা। দিনের পর দিন শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে, একের পর এক অগণতান্ত্রিক শ্রমিক-বিরোধী নীতি চালু করে তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে চাপা দিতে চেয়েছে সরকার। ২০১৪তে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ শ্রমিক বিক্ষোভে উত্তাল হয় গোটা দেশ। সেই সময় থেকেই সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর সরকারি দমন-পীড়ন আরও মারাত্মক চেহারা নেয়। বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অপরাধে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বহু কর্মী-সংগঠককে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করা হয়। এই সমস্ত অমানবিক, স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ অগ্নিসংযোগ করেছে জনগণের ক্ষোভের বারুদে, যা বোমার মতো ফেটে পড়ল ২০ জুন। হাজার হাজার মানুষ সোচ্চারে শাসক-বিরোধী স্লোগানে গলা মিলিয়েছেন, হাতে হাতে তুলে ধরেছেন সংগ্রামী ব্যানার। দাবি জানিয়েছেন, বেতন বাড়াতে হবে, হাসপাতাল এবং স্কুলের জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে হবে, জনগণের বেতন লুঠ করা চলবে না। সেদিনের শ্রমিক ধর্মঘট কার্যত স্তব্ধ করে দিয়েছে জনজীবন, দেশ জুড়ে বাস পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে, ব্রাসেলস এয়ারপোর্ট বাধ্য হয়েছে সমস্ত উড়ান বাতিল করতে।
বেলজিয়াম সহ ইউরোপের নানা দেশের শ্রমিকরা জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো নিয়ে আরও জোরদার আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, গোটা পৃথিবী জুড়েই বারবার জ্বলে উঠছে শ্রমিক বিক্ষোভের আগুন। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বাজার সংকট যত বাড়ছে, তার অনিবার্য পরিণতিতে আরও তীব্র হচ্ছে শ্রমিক শোষণ, বাড়ছে দারিদ্র-বেকারি-বৈষম্য। আর পৃথিবী জুড়ে ততই তীব্র হচ্ছে এই অন্যায় ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার আকুতি, অনিবার্যভাবে উঠে আসছে কার্ল মার্কস এর নাম, প্রস্ফুটিত হচ্ছে মার্কস-এঙ্গেলস প্রদর্শিত শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন। পুঁজির স্বর্গরাজ্য খোদ আমেরিকার বুকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে উঠে এসেছে মার্কস এর নাম, ২০২০ র অস্কারমঞ্চে ‘আমেরিকান ফ্যাক্ট্রি’ তথ্যচিত্রের নির্মাতা জুলি রেইচার্ট কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সারা দুনিয়ার শ্রমিক যখন একজোট হবে, তখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে’।
যত দিন যাবে, শোষিত মানুষের বিক্ষোভ স্ফুলিঙ্গের মতো ফেটে পড়বে কখনও ওয়াল স্ট্রিট, কখনও দিল্লির সিংঘু সীমান্তে কিংবা কলকাতার এসপ্ল্যানেডে, কখনও ব্রাসেলস এর রাজপথে, মুক্তিকামী মানুষের চিন্তায় চেতনায় আরও উজ্জ্বল, আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দেবেন মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন। সঠিক নেতৃত্বে শ্রমজীবী জনগণ খুঁজে নেবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাস নির্দেশিত পথ। মরণোন্মুখ পুঁজিবাদ খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো নানা দাওয়াই টোটকা দিয়ে যতই বাজার অর্থনীতিকে অক্সিজেন জোগাতে চাক, লাঠি-গুলি-কামান দিয়ে যতই পিষে মারতে চাক গণআন্দোলনকে, ঘুণ ধরা এই ব্যবস্থার পতন অনিবার্য।