শীতের কুয়াশা মাখা সকালে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড় লাগোয়া প্রত্যন্ত গ্রাম। কান পেতে শুনছে মানুষ লেনিনের কথা। মৃত্যুশতবর্ষে দাঁড়িয়ে তাঁর শিক্ষার কথা। মার্কিন কবি ল্যাংস্টন হিউজের কবিতার অনুবাদ, ‘লেনিন যাবে আটকে পথে, কোথায় তেমন সীমান্ত’?
কবিতার ভাষায়, ‘যাদের ভাষা যায় না বোঝা, তারাও বোঝে লেনিনকে…।’ ওই প্রত্যন্ত গ্রামে বসে লিখতে ইচ্ছে করছিল, যাদের কথা কেউ শোনে না– শোনায় তারা লেনিনকে! না হলে তাঁদের ব্যথা-যন্ত্রণা দীর্ণ জীবনের কথা বলতে তাঁরা এগিয়ে এলেন কেন? লেনিনের পথ অনুসারী যে রাজনীতি তাঁদের জীবনের কথা বলে, বেঁচে থাকার দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলনের কথা বলে, লড়াইয়ের পথ দেখায় তার প্রচারকদের বুকে জড়িয়ে ধরেন কেন? বিগত কয়েকটি মাস ধরে এই বিশাল ভারতের প্রান্তে প্রান্তে নানা ভাষা, নানা জাত-ধর্ম-বর্ণে বিভক্ত মানুষের কাছে লেনিনের কথা আবারও নতুন করে যাঁরা নিয়ে গেলেন, কী বলছে তাঁদের অভিজ্ঞতা?
এস ইউ সি আই (সি) দল ডাক দিয়েছিল, বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপকার, মহান দার্শনিক ও বিপ্লবী নেতা লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষের তাৎপর্য এ দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে দিতে। রাজনৈতিক আলোচকদের কেউ কেউ বলেছিলেন, সামনে লোকসভা ভোট, রাজনৈতিক দলগুলো যে যার হিসাব কষতে নেমে গেছে, তথাকথিত বৃহৎ সংসদীয় বামপন্থীদেরও এই নিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই। আর আপনারা লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ নিয়ে ব্যস্ত! এই রাজনীতি কি মানুষ বুঝবে, গ্রহণ করবে?
দেখা গেল সন্দেহটা কত অমূলক। ভ্লাদিমির শব্দটা বানান করে পড়তেও পারবেন না হয়ত যাঁরা, দেখা গেল তাঁরাও মন দিয়ে শুনেছেন লেনিনের জীবনসংগ্রামের কথা। এ ব্যাপারে মিল আছে পুরুলিয়ার বাগমুণ্ডি কিংবা বরাবাজার, আড়শার একেবারে প্রান্তিক কৃষিজীবী, বাঁকুড়ার আইসিডিএস, আশাকর্মী, ছোট দোকানদার থেকে শুরু করে সুন্দরবনের নদীতে চিংড়ির মীন ধরে সংসার চালানো গৃহবধূ, উত্তরবঙ্গের চা বাগানের ঠিকা শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক থেকে শুরু করে একেবারে অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, সরকারি কর্মচারী, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী সহ সকল শ্রমজীবী মানুষের।
এস ইউ সি আই (সি) দলের এই আহ্বান আলোড়ন তুলেছে সর্বত্র। অন্য একটি বামপন্থী দলের সমর্থক, বারুইপুরের এক শিক্ষকের আক্ষেপ, আমার দলের নেতাদের এই দিনটার কথা মনেও আছে কি না সন্দেহ। সেদিন এস ইউ সি আই (সি)-র পক্ষ থেকে মহান লেনিন মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষে সেমিনারে বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান করা হয়েছিল নানা বামপন্থী দলের নেতৃবৃন্দকে। তাঁদের অনেকেই বক্তব্য রাখার পর বলে গেলেন প্রায় একই আক্ষেপের কথা।
বামপন্থী আন্দোলনের আজও পীঠস্থান এই পশ্চিমবঙ্গ। নানা সময়ে সুবিধাবাদের কানাগলিতে বামপন্থা তার মর্যাদা হারিয়েছে। এই সুবিধাবাদের একটি চরিত্র উদঘাটন করে লেনিন তুলে ধরেছেন এঙ্গেলস-এর কথা– ‘‘আশু সুবিধার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ মূল দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুলে যাওয়া, পরবর্তীকালে ফল কী হবে তা বিবেচনায় না রেখে, ক্ষণিকের সাফল্যের জন্য চেষ্টা ও লড়াই করা, বর্তমানের জন্য ভবিষ্যতের সংগ্রামকে জলাঞ্জলি দেওয়ার সত্যিকারের অর্থ হল সুবিধাবাদের মধ্যে ডুবে যাওয়া।’’ ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনায় মহান লেনিন স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সমাজতন্ত্রের অন্যতম শিক্ষক মহান এঙ্গেলসের এই মূল্যবান শিক্ষাটিকে। আজ গভীরে গিয়ে লেনিনের শিক্ষা শুধু নয়, লেনিনের পূর্বসূরি মার্ক্স-এঙ্গেলস আর তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি স্ট্যালিন, মাও সে-তুঙ, শিবদাস ঘোষের রেখে যাওয়া শিক্ষার অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি শোষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে।
একদল স্বার্থান্বেষী প্রচার করে, কেন আমরা রাশিয়ার নেতা লেনিনকে স্মরণ করব? কেউ কেউ বলেন, এই সব বড় বড় চিন্তা হল পণ্ডিতদের আলোচনার বিষয়, সাধারণ মানুষ তা বুঝবেও না, তাই শুনে তাদের লাভও নেই। যদিও লেনিন মৃত্যুশতবর্ষের কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যেতে গিয়ে অভিজ্ঞতা হল এই সব পণ্ডিতদের ঠিক বিপরীত। লেনিনের কথা যত একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে তত তাঁরা অনুভব করেছেন, লেনিনের চিন্তাকে কার্যকরী রূপ দেওয়ার সাথে জড়িয়ে আছে শোষিত মানুষের স্বপ্ন পূরণের কথা। জড়িয়ে আছে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বাস্তব সত্য। তাঁদের জীবনের সমস্যা, চাকরি না পাওয়া, চাষের ফসলের দাম না পাওয়া, নারীর মর্যাদাহানির সমস্যা, অভাবী সংসারের নানা সমস্যা সমাধানের রাস্তা যেমন এর মধ্যে আছে, তেমনই এতে আছে বিজ্ঞান, যুক্তি, উন্নত মন, সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথনির্দেশ।
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের আদর্শ বিশ্বজনীন। কিন্তু তার প্রয়োগ স্থান-কাল বিচারে বিশেষ এবং সুনির্দিষ্ট। বর্তমান সময় ও ভারতের বিশেষ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বিশেষীকৃত করে মানুষের জীবনের সমস্যার সাথে মিলিয়ে সুনির্দিষ্ট রূপে সৃজনশীল ভাবে হাজির করতে পারলে একেবারে সাধারণ মানুষও তার মর্মবস্তু ধরতে পারে সহজেই। বাস্তবে এই আদর্শকে নাড়ি দিয়ে বোঝে একমাত্র শোষিত সর্বহারা শ্রেণি। লেনিনের সুযোগ্য ছাত্র বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের নেতৃত্বে ভারতে ঠিক এই কাজটাই করতে পেরেছে এসইউসিআই(সি)। তাঁর জীবনাবসানের পর তাঁর শিক্ষার আলোকে এই কাজটাও করে চলেছেন দলের পরবর্তী নেতৃত্ব।
কসবা এলাকার এক টোটো চালক, শহিদ মিনারে লেনিন মৃত্যুশতবার্ষিকীর সমাবেশে তিনি নিজে যেমন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তেমনই দলের কর্মীদের বলেছেন, আপনারা কিছুজন আমার গাড়িতে করে ময়দানে চলুন। তাঁর টোটো ভাড়া করেই বেশ কয়েক দিন ধরে ২১ জানুয়ারি শহিদ মিনার ময়দানে সমাবেশের প্রচার চালিয়েছেন দলের কর্মীরা। লেনিনের বিপ্লবী সংগ্রামের কথা শুনতে শুনতে তিনি ভেবেছেন, নিয়েছেন সিদ্ধান্ত।
বিগত কয়েক মাস ধরে সারা ভারত জুড়ে একটানা লেনিন চর্চার বিশেষ কর্মসূচি চালিয়ে গেছে দল। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলায় একেবারে স্থানীয় স্তরে সমস্ত বামপন্থী, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে একত্রিত করে লেনিন মৃত্যুশতবর্ষ কমিটি গঠন, তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, সেমিনার, লেনিনের উদ্ধৃতি প্রদর্শনী, লেনিনের শিক্ষা নিয়ে একত্রিত হয়ে চর্চা এরকম নানা কিছুর আয়োজন হয়েছে। দলের কর্মীরা দেওয়াল লিখন, ব্যানার, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার করেছেন। ভ্যান রিক্সা, অটো, টোটো সাজিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে চলেছে একটানা প্রচার। তাতে শামিল হয়েছেন শ্রমিক কৃষকের ঘর থেকে আসা কর্মীরা, আবার হাত লাগিয়েছেন সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসকরাও।
দলের বাইরের মানুষকে নিয়ে আঞ্চলিক স্তরে গড়ে ওঠা লেনিন মৃত্যুশতবর্ষ উদযাপন কমিটিগুলিতে দলের বাইরের বহু বামপন্থী গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। কলকাতার বরানগরে এমন এক কমিটিতে শামিল একজন প্রাক্তন বিচারপতি, শিক্ষক সহ বিশিষ্টরা উদ্যোগ নিয়েছেন লেনিন চর্চার। তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছেন, লেনিনের শিক্ষাকে শ্রমিক মহল্লায় পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি নিতে। সাধারণ মানুষকে ডাক দিয়েছেন সংগঠিত হওয়ার জন্য সঠিক আদর্শের খোঁজ করতে। বহু জেলায় এই উপলক্ষে হয়েছে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মুর্শিদাবাদের ‘ঝড়’ পত্রিকার উদ্যোগে বহরমপুরে হয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান সেমিনার। এ আই ডিএসও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করেছে নানা অলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। কলকাতায় মেডিকেল ইউনিটের উদ্যোগে গড়ে ওঠা শিবদাস ঘোষ জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটিই উদ্যোগ নিয়েছিল লেনিনের মৃত্যু শতবর্ষ পালনের। তাদের ডাকে বহু বিশিষ্ট চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক, নার্স স্বাস্থ্যকর্মী, গ্রামীণ চিকিৎসকরা সেমিনারে এসেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও দিল্লি, রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ডে নানা কর্মসূচি হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের সমস্ত রাজ্য, পূর্বের আসাম, ত্রিপুরা, ওড়িশা সহ দেশের বহু রাজ্যে সভা হয়েছে।
মহান লেনিনের এই মৃত্যুশতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচি যে বামপন্থী আন্দোলনের একটা বৃহত্তর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়ে গেল, বামপন্থার নামে ভোটসর্বস্বতার দেউলিয়াপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল, সামনে এনে দিয়ে গেল এই মূল্যবান শিক্ষাকে যে, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থায় ভোট দিয়ে শুধু সরকারেরই পরিবর্তন হয়, শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রটির পরিবর্তন হয় না। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের দুরবস্থারও কোনও পরিবর্তন হয় না। একই সঙ্গে তা সংগ্রামী বামপন্থার পথে চলার রাস্তাতে স্থাপন করে গেল নতুন নতুন অলোকস্তম্ভ যা এই পথকে আরও উজ্জ্বল করবে, আকর্ষণ করবে সমাজের সর্বস্তরের খেটেখাওয়া মানুষকে।