পরিবারকে আর্থিক সঙ্কট থেকে বাঁচাতে হবে৷ বাবা–মাকে দেখতে হবে৷ ভাইবোনেদের দায়িত্ব নিতে হবে৷ তাই যে করেই হোক একটা চাকরি চাই৷ এই জেদ নিয়েই দিনরাত এক করে ফেলেছিল রাম ভগত৷ গ্র্যাজুয়েশনের পর পেশাদারি প্রশিক্ষণ সেন্টারে ভর্তি হয়ে দক্ষতার সাথে সে ভাল রেজাল্টও করেছিল৷ অনেক চেষ্টার পর অবশেষে নিয়োগপত্র মেলে গুজরাটের একটি বেসরকারি কারখানায়৷ সেদিন রাম ভগতের পরিবারে খুশির জোয়ার৷
কিন্তু এ আনন্দ বেশিদিন টিকল না৷ মাস ছয়েক পরে বাড়িতে খবর এল কারখানাতেই দুর্ঘটনা, মারা গেছেন রাম ভগত৷ শোকে পাথর বাবা–মাকে কেউ কেউ বোঝাতে চাইলেন, কপালে নেই, তাই এত সুখের চাকরিটা করতে পারল না কিন্তু রাম ভগত তো একা নন, প্রতি বছর এমন শিল্প দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে হাজারে হাজারে শ্রমিকের৷ সব মৃত্যুই কি ‘কপালদোষে’–র ঘাড়ে চাপাবেন শিল্প মালিক আর সরকারি কর্তারা?
শিল্পাঞ্চলের যাঁরা খোঁজ–খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, মালিকদের কাছে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টা একেবারেই অকিঞ্চিৎকর৷ এর জন্য টাকা খরচে তাদের প্রবল অনীহা৷এই খাতে যতদূর সম্ভব কম অর্থ বরাদ্দ করাটাই ভারতের শিল্প কর্তাদের দস্তুর৷ সম্প্রতি একটি সমীক্ষাও দেখিয়েছে, ভারতে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ভীষণ দুর্বল৷ বিভিন্ন কারখানায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে৷ তাতে বহু শ্রমিক মারাও যাচ্ছেন, আহতদের সংখ্যাও বিপুল৷ অথচ দুর্ঘটনা বন্ধ রাখার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সে ক্ষেত্রে শিল্প–মালিকদের নজরদারি তলানিতে৷
কেন এই উদাসীনতা? শ্রমিকই তো উৎপাদনের মূল কারিগর৷ শ্রমিকের শ্রম যুক্ত না হলে কারখানা অচল৷ বলতে গেলে শ্রমশক্তিই উৎপাদনের জীবন্ত উপাদান৷ এর ব্যবহার ছাড়া উৎপাদনের বাকি সব উপাদান নিষ্ক্রিয়৷ শ্রমিকের শ্রমশক্তির ব্যবহার করেই মালিকরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে৷ অথচ তাদের দেয় না বাঁচার মতো মজুরি, ন্যায্য মজুরি তো দূরস্থান৷ শ্রমিকের নিরাপত্তাটুকুরও গুরুত্ব মালিকের কাছে নেই৷ এ কি মালিকের খেয়াল? দায়িত্ববোধের অভাব? নিষ্ঠুর মনোবৃত্তির বাড়বৃদ্ধি? না কি শ্রমিকদের প্রতি এই অবহেলার অন্য কোনও উৎস আছে?
ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফ্যাক্টরি অ্যাডভাইস সার্ভিস অ্যান্ড লেবার ইনস্টিটিউট (ডিজিএফএএসএলআই)–২০২১–এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে ভারতে বিভিন্ন শিল্পে ৩২ হাজার ৪১৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ এতে ১০৫০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮৮২ জন৷ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ জানে, সরকারি রিপোর্টে দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহতদের যে সংখ্যা দেখানো হয়, তা বাস্তবের একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র৷ এর কারণ তিনটি৷ প্রথমত, তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা যথাযথ নয়৷ তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব লোকাল ইন্সপেক্টরের, তিনি সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তদন্ত করবেন৷ এমনটাই নিয়ম৷ কিন্তু নিয়মের অন্তরালে রয়েছে বহু অব্যবস্থা৷
তথ্য বলছে, প্রতি ৫০০ কারখানার জন্য রয়েছেন মাত্র এক জন ইন্সপেক্টর৷ এতেই বোঝা যায়, তথ্য কেমন সংগ্রহ করা হয়৷ এটা যে একটা গুরুতর বিষয়, তা মালিকদের আচরণে যেমন বোঝাই যায় না, তেমনই রাজ্যের বা কেন্দ্রের শ্রমদপ্তরও শ্রমিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত এই বিষয়টিতে কোনও গুরুত্ব যে দেয় না, তথ্যই তা বলছে৷
দ্বিতীয় কারণটি হল, ইন্সপেক্টর পদগুলিতে প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও নিয়োগই হয়নি৷ সেফটি ইন্সপেক্টর, মেডিকেল ইন্সপেক্টর, হাইজিন ইন্সপেক্টরের অর্ধেক পদই ফাঁকা৷ তা হলে দুর্ঘটনা হলে কে তথ্য সংগ্রহ করতে যাবেন? কে পরিদর্শন করবেন?
তৃতীয় কারণটি হল, আইনের কারসাজিতে সরকার সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে বাদ দিয়ে বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে অসংগঠিত তকমা দিয়ে দিয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক স্বার্থে শ্রম আইন মেনে চলার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই৷ ফলে রেজিস্টার্ড ফ্যাক্টরিগুলির মধ্যে ৭৮ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও তদন্তই হয় না৷ ঝুঁকিবহুল ফ্যাক্টরিগুলির মধ্যে ৬৫ শতাংশ তদন্তের বাইরে৷ বিশাল সংখ্যক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প যারা জিডিপিতে ৩৩ শতাংশ অবদান রাখে, সেখানে শ্রমিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনই নেই৷ তা হলে পার্লামেন্টে বা বিভিন্ন বিধানসভায় এমপি, এমএলএ হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন যাঁরা, তাঁরা শ্রমিক স্বার্থে কী করছেন? এ বিষয়ে শ্রমিক স্বার্থে কোনও আইন কি তাঁরা করতে পারেন না?
বাস্তব বলছে, শ্রমিক স্বার্থে ইতিপূর্বে যতটুকু আইন ছিল, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার শ্রম আইন সংশোধনের নামে তা এমনভাবে পাল্টে দিয়েছে যে, সেখানে শ্রমিক–স্বার্থ বলে কিছু নেই৷ নতুন শ্রমকোড পুরোটাই মালিকের স্বার্থবাহী৷ কোন রাজ্যগুলিতে শিল্প দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক মৃত্যু বেশি করে ঘটছে? গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে৷ অন্য রাজ্যগুলিও খুব ভাল অবস্থায়, তা নয়৷ বোঝাই যায় শ্রমিকের জীবনের দাম মন্ত্রী–আমলাদের কাছে নেই বললেই চলে৷
শিল্পের জন্য শ্রমিক অপরিহার্য হলেও পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কই শ্রমিককে এমন দুঃসহ অবস্থায় ঠেলেছে৷ সর্বোচ্চ মুনাফা করার জন্য মালিকরা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকেই শুধু বঞ্চিত করছে তাই নয়, এঁদের নিরাপত্তার পিছনে খরচটুকুও করছে না৷ ফলে একের পর এক শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ শ্রমিক শ্রেণির মহান শিক্ষক ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাঁর ‘সাম্যবাদের মূলনীতি’ লেখায় দেখিয়েছিলেন, ‘‘ (দাসব্যবস্থায়) একজন বিশেষ দাস একজন বিশেষ প্রভুর সম্পত্তি হওয়ায়, যত করুণ অবস্থার মধ্যেই তাকে বাস করতে হোক না কেন, তার জীবনধারণের একপ্রকার নিশ্চয়তা ছিল৷ কারণ, এক্ষেত্রে দাসপ্রভুর স্বার্থ নিহিত ছিল৷ অন্যদিকে, একজন বিশেষ সর্বহারা কার্যত সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণির সম্পত্তি৷ এই বুর্জোয়া শ্রেণির যে কেউ তার নিজস্ব প্রয়োজনে ওই সর্বহারার শ্রম ক্রয় করতে পারে৷ তাই তার ব্যক্তিগত অস্তিত্ব রক্ষিত হওয়ার কোনও নিরাপত্তা নেই, যা আছে তা হল শ্রেণি হিসাবে তার সামগ্রিক অস্তিত্বের নিশ্চয়তা৷’’
মালিক জানে একজন শ্রমিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেও তার কোনও ক্ষতি নেই, শত শত শ্রমিক জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ওই কাজটি পেতে তীর্থের কাকের মতো কারখানার গেটে লাইন দিতে প্রস্তুত৷ তাই শ্রমিকের মৃত্যু কিংবা অঙ্গহানিতে মালিক বা তাদের সেবাদাস সরকারের কিছুই আসে যায় না৷ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাই শ্রমিককে এই দুঃসহ অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে৷ আইন মেনে শ্রমিকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে মালিকদের বলার কথা কার? সরকারেরই তো। কিন্তু এই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের এমনই মহিমা যে, যারা মালিকের সেবায় যত এগিয়ে থাকে সেই দলই ভোটে জিতে সরকার গড়তে পারে৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা সময় যারা সরকারের গদিতে বসে, সেই দলগুলি মূলত চলেও মালিকের টাকায়৷ তাই শ্রমিকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কিংবা তার বাঁচার মতো মজুরি দেওয়ার দায় সরকারেরও নেই, মালিকেরও নেই৷