শ্রমিকের প্রাণের মূল্য

দুর্ঘটনা। আপাত অর্থে যাকে দুর্ঘটনা বলে মনে হয়, তার সবই কি তা? হ্যাঁ কিছু নিশ্চয়ই থাকে যা শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির বিচারে দুর্ঘটনাই। কিন্তু যেসব ঘটনাগুলিকে সাধারণভাবে আমরা দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করি তার বেশির ভাগই শেষ বিচারে অন্য কথা বলে।

কেন এমন বলছি? মনে করুন, কুয়েতের ওই জতুগৃহের কথা। বাইরে থেকে দেখলে ঝাঁ চকচকে বহুতল মনে হয়। আসলে তা লেবার ক্যাম্প। ভিনদেশি প্রায় ২০০ জন শ্রমিক নির্মাণকর্মী হিসেবে দক্ষিণ কুয়েতের ম্যানগ্রাফ শহরের ছ’তলা ওই বিল্ডিং-এ থাকত। অগ্নিকাণ্ডে এদের মধ্যে অন্তত ৪৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে, এর মধ্যে প্রায় ৪০ জন ভারতীয়। কেন ওই স্বল্প পরিসরে গাদাগাদি করে তারা থাকত? ইচ্ছে করে নিশ্চয়ই নয়। সরকারি বিবৃতিতে কুয়েত প্রশাসন জানিয়েছে এ দিন যা ঘটেছে, তা রিয়েল এস্টেট মালিকের অতিরিক্ত লোভের ফল। বাড়তি মুনাফার লোভে এমন গাদাগাদি করে নিজের সংস্থার কর্মচারীদের রাখার ফলেই এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছে।

কেউ বলবেন অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কি অন্যত্র কোথাও ঘটে না? হ্যাঁ ঘটে। কিন্তু গাদাগাদি করে থাকার ফলে সময়মতো নিরাপদ স্থানে বেরিয়ে পড়ার সুযোগ ছিল না ওই শ্রমিকদের। অভিযোগ, এক একটি ঘরকে বহুজনের ব্যবহার উপযোগী করতে যে পার্টিশন দেওয়া হয়েছিল, তাও দহনের সহায়ক বস্তু হিসেবে কাজ করেছে। এতগুলি মানুষের এমন বেঘোরে প্রাণহানি ঘটতই না যদি মানুষগুলো মানুষের মতো সুষ্ঠুভাবে থাকার সুযোগ পেত। ওই মালিকের বাড়িতে এমন দুর্ঘটনার কথা কেউ কখনও শুনেছে নাকি? সেখানে নিশ্চিদ্রনিরাপত্তা, সদা সতর্কতা। আসলে ধনতন্ত্রে প্রাণের মূল্যও নির্ধারিত হয় অর্থ ধন সম্পত্তির মালিকানার উপর ভিত্তি করে। সমাজিই উৎপাদনে সত্যিকার অর্থে কোনও ভূমিকাই যাদের নেই, শুধু অর্থ প্রতিপত্তির মালিক বলে তাদের প্রাণ মহামূল্যবান। বহু যত্নে সাজানো গোছানো তাদের জীবন। আর হাড়ভাঙা খাটুনিতে প্রতিদিন যারা তিলে তিলে গড়ে তুলছে এ সভ্যতাকে, তাদের প্রাণের দাম কানাকড়িও নয়। এই যে নিয়মিত রেল দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে, প্রতিটি ঘটনার পর শোনা যায় নাকি তার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে, তাতে কী লাভ হয়? যে প্রযুক্তি (কবচ) ব্যবহার করে দুর্ঘটনাকে কমিয়ে ফেলা বহু অংশে সম্ভব সেই প্রযুক্তির ব্যবহার অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে দিনের পর দিন। নিরাপত্তার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজও পরিচালিত হচ্ছে কায়িক শ্রমে। তাই কার ভুলে কী হল– দোষারোপ চলছে। সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকার প্রতিবার তার দায় এড়াচ্ছে। আর কর্মী সংকোচন ঘটিয়ে যত কম সম্ভব কর্মী দিয়ে রেল চালাচ্ছে। লোকো পাইলট না স্টেশন মাস্টার কার ত্রুটি– এ আলোচনায় সত্যি কি সমস্যার সমাধান হবে? মানুষের প্রতি যে হীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই ব্যবস্থাটা চলছে তার দিকে আঙুল উঠবে কবে?

এ পৃথিবীতে যত মিনার সৌধ সড়ক রেলপথ শহর বন্দর গড়ে উঠেছে ও নিয়ত পরিচালিত হচ্ছে, তার ভিত্তিমূলে রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকের অমূল্য প্রাণ। সে কথা কে-ই বা মনে রাখে। যে মালগাড়ির সাথে মেল ট্রেনের ধাক্কা লেগে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল, সেই মালগাড়ির চালককে টানা চার রাত ডিউটির পর ঘুম থেকে তুলে আবার ডিউটি করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এই চূড়ান্ত অমানবিক অব্যবস্থার মাশুল দিলেন নিজের প্রাণ দিয়ে, সাথে ঝরে গেল আরও কত অমূল্য প্রাণ। কলকাতার ধাপার ঢিপির উপরে নতুন পল্লীর বাসিন্দা শ্যামাপদ মণ্ডল তেমনই আর একজন শ্রমিক। মেট্রো প্রকল্পের নিরাপত্তা কর্মীর দায়িত্বে থাকা ৫৫ বছরের শ্যামাপদর রোজগারের ওপরই মূলত নির্ভর করে ছিল তাঁর অনেক সদস্যের সংসার। সারা রাত ডিউটির শেষ পর্যায়ে ভোর রাতে চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে চোখটা সবে একটু বুজে আসছিল, তখনই আচমকা হুড়মুড়িয়ে তাকে ধাক্কা মারে একটি ক্রেন। মুহূর্তেই সব শেষ। দায় কার, দোষ কার–বিশ্লেষণ চলবে। সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণে হয়তো মুখবন্ধ হয়ে যাবে হতদরিদ্র পরিবারের। কিন্তু আমি আপনি, যারা নিজেদের সচেতন বিবেকবান মানুষ বলে মনে করি, এ সব ঘটনাগুলি দেখে কাগজের পাতা উল্টে চলে যাব নিত্যনৈমিত্যিক সাধারণ ঘটনা বলে? যে সমাজব্যবস্থা মানুষের প্রাণের মূল্য এ ভাবে কানাকড়িতে বিকিয়ে দিতে পারে, মানুষকে মানুষ জ্ঞান না করে পশু স্তরে নামিয়ে আনতে পারে, সে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের সমস্ত হৃদয় কি গর্জে উঠবে না? মরমি কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হৃদয় এই হতদরিদ্র মানুষগুলির দুর্দশায় একসময় কেঁদেছিল। লিখেছিলেন– ‘আধুনিক সভ্যতার বাহন তোরা, তোরা মর। কিন্তু যে সভ্যতা তোদের এমন ধারা করিয়াছে, বইতেই যদি হয় তো সেই সভ্যতাকে রসাতলের পানে বহিয়া নিয়া যা।’ কথাশিল্পীর এ আর্তিকে বাস্তবায়িত করার সময় কি আজও আসেনি? আমি আপনি কি নীরব দর্শকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ধনতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থাকে রসাতলে নিয়ে যাওয়ার পথে পা মেলাতে পারি না? যে ব্যবস্থায় অনাহারে অপুষ্টিতে বিনা চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যুমিছিল বাড়ে, অর্থনৈতিক সামাজিক চাপে ক্লিষ্ট পিষ্ট হতে হতে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা বাড়ে, সাধারণ জীবনের মূল্য যেখানে শূন্য হয়ে যায়, সে ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা ছাড়া পথ আর কীই বা থাকতে পারে?

আমরা কি নতুন সেই সমাজ সৃষ্টির স্বপ্ন দেখতে পারি না যে সমাজটা মেহনতি মানুষেরই? সমাজের চোখে যেখানে প্রতিটি মানুষই অনন্ত সম্ভাবনার উৎস? হ্যাঁ, এমন সমাজেরও উদাহরণ আছে এ পৃথিবীতে। ৭০ বছরের সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া স্থাপন করেছে সে ইতিহাস। তারা দেশের মাটি থেকে নির্মূল করেছিল বেকারসমস্যা, শোষণ, লোভ, পতিতাবৃত্তি। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার শ্রমিক কৃষকদের দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু স্বক্ষেত্রে শ্রমদানই নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আঙিনাতেও এই শ্রমিক-কৃষকদের গড়ে উঠেছিল স্বচ্ছন্দ বিচরণ। সামাজিক ধারণাটা ছিল এরকম– মানুষ তার নিজ ক্ষেত্রে যথাসাধ্য শ্রমদান করে রাষ্ট্রকে নির্মাণ করবে, আর রাষ্ট্র তার সাধ্য অনুযায়ী মানুষের সুস্থ সবল সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনগুলি পূরণ করবে। মুছে গিয়েছিল হাজার হাজার বছরের বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার ইতিহাস। এ তো কোনও কল্পকাহিনী নয়। মার্ক্সবাদকে ভিত্তি করে দুনিয়ার সবহারা মানুষের মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতা কমরেড লেনিন ও কমরেড স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষই রক্তে ঘামে ভিজে নির্মাণ করেছিল এ ইতিহাস, কায়েম করেছিল শ্রমিক শ্রেণির রাজ। বাঁচার আনন্দে বাঁচতে হলে, মানুষের মতো বাঁচতে গেলে আজ ধনতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের পথে সামিল হওয়া ছাড়া আমাদের সামনে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা আছে কি?