৫ আগস্ট মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪৯তম স্মরণদিবস। এই উপলক্ষে তাঁর অমূল্য শিক্ষা থেকে একটি অংশ প্রকাশ করা হল।
আমাদের বর্তমান যে সমাজ, এ সমাজ পুঁজিপতিদের তাঁবেদার সমাজ, তাদের পৃষ্ঠপোষক সমাজ। এর সমস্ত কিছু তাদের সেবা করতে বাধ্য, না করলে কারওর চলবার উপায় নেই। হয় এই ব্যবস্থার সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে, সাহসের সাথে লড়তে হবে, নয় যেভাবেই হোক এর দাসত্ব করে চলতে হবে। ধরুন, যারা সংবাদপত্র চালায় তাদের সমস্যা হচ্ছে যে, মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতা না করলে কাগজ চলবে না। কারণ অ্যাডভার্টাইজমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তাকে ফলাও করে মালিকের কথা বলতে হবে। আর যারা সংবাদপত্রে কাজ করে, চাকরির স্বার্থে প্রতিদিন তাদের মালিকের স্বার্থের পায়ে নিজেদের বিকিয়ে দিতে হচ্ছে। এমনকি ইলেকশনের মধ্য দিয়ে সরকারের গদিতে যাঁরা বসেন তাঁদের মধ্যেও অনেকে এই ভাবে ভেবে থাকেন যে, যদি মালিকের পৃষ্ঠপোষকতা তাঁরা না করেন তা হলে সরকারি গদিতে তাঁদের থাকবার উপায় নেই, তাঁরা বেশি দিন থাকতে পারবেন না। ফলে দেখা যায়, এতদিন পর্যন্ত কংগ্রেসি সরকার তার আচরণ, তার কর্ম, তার ব্যবহার, তার চিন্তা, সমস্ত কিছুর দ্বারা এই পুঁজিবাদী সমাজটাকেই সেবা করে এসেছে। আর এই পুঁজিপতিশ্রেণির সেবার নাম দেশসেবা দিয়েছে, পুঁজিপতিশ্রেণির স্বার্থে রচিত পরিকল্পনাগুলোকে দেশের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা বলেছে, পুঁজিপতিশ্রেণির স্বার্থের পায়ে মজুরের স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়ার নাম দিয়েছে দেশের স্বার্থে মজুরের স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া, ব্যক্তির স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া। আমি মনে করি, এই মিথ্যাচারটি সর্বপ্রথমে দূর হওয়া দরকার।
এখন দেশের এই যে বর্তমান অবস্থা তার মধ্যে আপনাদের আন্দোলনের, লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য কী হবে? আপনারা কার বিরুদ্ধে লড়বেন, কেন লড়বেন এবং কী ভাবে লড়বেন? সে লড়াইয়ের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কী হবে? আপনাদের স্পষ্ট করে বুঝতে হবে, কী আপনারা চান যাতে শেষ পর্যন্ত আপনাদের মৌলিক অবস্থার, মূল সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে? সেটা কি শুধু দৈনন্দিন দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই করা? আমি বলি, এ তো আছেই, কিন্তু এটাই লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। গত ৪০ বছর যাবৎ ভারতবর্ষের শ্রমিক মাইনে বাড়াবার জন্য, আইনকানুন পাল্টাবার জন্য, অধিকার বাড়াবার জন্য লড়াই করে আসছে। অধিকার আপনারা কিছু কিছু অর্জনও করেছেন। এর কোনও তাৎপর্য নেই, এ কথা আমি বলছি না। এর যথেষ্ট তাৎপর্য আছে। কিন্তু সে তাৎপর্য শুধু একটাই। তা হচ্ছে এই অধিকারগুলো ব্যবহার করে দৈনন্দিন গণআন্দোলনগুলো শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে এমন অমোঘ বিপ্লবী সংগঠনশক্তি গড়ে তোলা যাতে একদিন এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই উচ্ছেদ করে শোষণহীন শ্রমিকশ্রেণির রাজ কায়েম করা সম্ভব হয়। কিন্তু সে যদি না হয়, শুধু দু’চার-পাঁচ টাকা মাইনে বাড়ানোই যদি আপনাদের আন্দোলনের বা লড়াইয়ের মূল উদ্দেশ্য হয় তা হলে শ্রমিক আন্দোলনে এক ধরনের সুবিধাবাদের জন্ম হতে বাধ্য, এবং আপনারা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন ভারতবর্ষের শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী মনোভাবকে এই সুবিধাবাদ ইতিমধ্যেই অনেকাংশে গ্রাস করে ফেলেছে।
শ্রমিক আন্দোলনে এই সুবিধাবাদের অনুপ্রবেশই আপনাদের মধ্যে এই ধরনের মনোভাব গড়ে তুলছে যে, যে সমস্ত নেতাদের ধরলে তাঁরা মালিকদের কাছ থেকে এ ধরনের সুবিধা আপনাদের আদায় করে দিতে পারবেন, আপনারা তাঁদের পেছনেই চলবেন। আর এইভাবে যদি চলতে থাকেন তা হলে আপনাদের এই দুর্ভাগ্য কেউ পাল্টাতে পারবে না, স্বয়ং ঈশ্বরও পাল্টাতে পারবে না। ঈশ্বরেরও ক্ষমতা নেই যে আপনাদের দুর্ভাগ্য পাল্টাতে পারে। তা হলে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী রাজনৈতিক সংঘশক্তি কোনও দিনই গড়ে উঠবে না এবং পুঁজিবাদী শোষণ থেকে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি কোনও দিনই অর্জিত হবে না।
ফলে এ রাস্তা ছাড়তে হবে। আপনাদের দুর্ভাগ্য একমাত্র পাল্টে যেতে পারে যদি আপনারা বুঝতে পারেন, আপনাদের প্রকৃত মুক্তির প্রশ্নটা ভারতবর্ষের গোটা সমাজব্যবস্থাকে পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবের আঘাতে পরিবর্তিত করার মধ্যেই নিহিত। আর এ পরিবর্তনটা শুধু মাঠে ঘাটে ‘এটা চাই’ ‘ওটা চাই’ করে চিৎকার করলেই হয় না। সুনির্দিষ্ট ও সচেতন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন ও সম্প্রসারণ এবং দাবিদাওয়া আদায় করার জন্য লড়াই করার অর্থ হচ্ছে পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার মধ্যেই খানিকটা সুযোগসুবিধা অর্জন। পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাকে উচ্ছেদের কোনও বাস্তব ও সর্বাত্মক পরিকল্পনা না নিয়ে শুধুমাত্র আইনকানুন পাল্টানো ও অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের লড়াই পরিচালনা করার অর্থ দাঁড়ায় যে, শোষণটা যেমন চলছে তেমনি চলুক, যেমন গোলাম হয়ে আপনারা রয়েছেন তেমন গোলাম হয়েই থাকতে আপনারা রাজি, তাতে আপনাদের আপত্তি নেই, তাতে আপনাদের আত্মসম্মানে লাগবে না, আপনারা পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তি অর্জন করতে চান না– শুধু শোষণের জ্বালাটা একটু কমানো, একটু মোলায়েম করাই আপনাদের আন্দোলনগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এর ফলে মালিক মালিকই থাকছে, আপনি মজুর মজুরই থাকছেন, আপনাকে শোষণ করার তার পুরো অধিকার থাকছে এবং সামাজিক উৎপাদনের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকছে, উৎপাদনের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনই থাকছে। এই অবস্থা যদি থাকে তা হলে পুঁজিবাদী শোষণ থেকে কোনও দিন শ্রমিকের মুক্তি অর্জিত হতে পারে না।
‘শ্রমিক আন্দোলনে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে’