কর্মসংস্থানের ভয়াবহ চিত্র আবারও সামনে এল রাজ্যের বনবিভাগে কর্মী নিয়োগকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি বন-সহায়ক পদে ২০১৩টি শূন্য পদের জন্য জমা পড়েছে ২০ লক্ষ আবেদনপত্র! হাতি তাড়ানো, বন পাহারা দেওয়া, চারাগাছ লাগানো ও পরিচর্যা করা ইত্যাদি যে কাজগুলির জন্য ধার্য যোগ্যতামান অষ্টম শ্রেণী পাস, সেখানে দেখা যাচ্ছে আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন এমএ, এমএসসি, পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিতরাও।
মাত্র ১০ হাজার টাকা বেতনের চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী এই পদের জন্য এই বিপুল সংখ্যক আবেদনের ঘটনা থেকে কি রাজ্যের বেকারত্বের ভয়ানক চেহারাটি স্পষ্ট হয়ে যায় না? এ চিত্র শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা দেশের। কয়েক বছর আগে উত্তরপ্রদেশে ৩০০টির মতো পিয়ন পদের জন্য আবেদন করেছিলেন প্রায় ২৫ লক্ষের মতো কর্মপ্রার্থী, যাদের মধ্যে এমএ, এমএসসি, পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা ছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা দক্ষ বেকাররাও ছিলেন। অন্যান্য রাজ্যেও এমন অভিজ্ঞতা অসংখ্য।
বেকার সমস্যা গোটা ভারতেই ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এ কোনও বিশেষ সরকারের ব্যর্থতা, তা নয়। বরং বলা যায়, ক্ষমতায় আসীন একের় পর এক সরকারের চাকরি প্রদানে পুঞ্জীভূত ব্যর্থতা বেকার সমস্যাকে আজ এমন বারুদের স্তূপের উপর দাঁড় করিয়েছে।
কেন সব সরকারই বেকার সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ? বর্তমান শাসকবর্গ বলতেই পারেন, করোনা অতিমারির সঙ্কট সমস্ত ক্ষেত্রে উৎপাদনকে স্তব্ধ করে দেওয়ায় কর্মহীনতার যে বাড়তি সমস্যার জন্ম হয়েছে তার ফলেই চাকরির পরীক্ষায় এত আবেদনকারী। কিন্তু আবেদনের এই প্রাবল্য প্রাক-করোনা পরিস্থিতিতেও কম ছিল না। তা হলে এই সংকটের শিকড় কোথায়? সমাধানই বা কি?
কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি বলছে তারা রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। কখনও বলছে, সোনার বাংলা গড়বে। কিন্তু তাদের ‘রামরাজত্বে’ এই ভয়াবহ বেকার সমস্যার সমাধান কোন পথে হবে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা এ বিষয়ে একটি কথাও পরিষ্কার করে বলছেন না। বস্তুত ফাঁপা কিছু স্লোগান ছাড়া বেকার সমস্যা দূর করার কোনও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিই বিজেপির বা কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। বরং তাদের বেসরকারিকরণ, বিলগ্নীকরণের নীতি, জনবিরোধী শ্রমসংস্কার আইন, পদবিলোপ নীতি কর্মসংস্থানের সমস্যাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলছে। এর ওপর করোনা অতিমারিকে অজুহাত করে যেভাবে অনলাইন কার্যকলাপের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে তাতে আগামী দিনে কর্মসংস্থানের দরজা আরও বেশি করে বন্ধ হয়ে যাবে। রুজি-রোজগারের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকা অসংখ্য কর্মপ্রার্থীর কাছে এ চিত্র অত্যন্ত বেদনার ও আশঙ্কার। এই অবস্থায় কাজের সংস্থান করা দূরের কথা, উল্টেকি সরকারি, কি বেসরকারি– সমস্ত ক্ষেত্রেই সবচেয়ে কম সংখ্যক কর্মী দিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার নীতিই অনুসৃত হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে খরচ কমিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা লোটার লক্ষ্য। এটাই হল পুঁজিবাদী উৎপাদনের মূল লক্ষ্য। সর্বোচ্চ মুনাফা লুটের এই পুঁজিবাদী লালসায় মালিকদের কাছে দেশের বেকার জনগণের, এমনকি গোটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির় ভালো-মন্দ বিচারের কোনও স্থান নেই। এ দেশের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রাখতে গিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক সরকার বেকার সমস্যাকে এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে। মাত্র ২০১৩টি বন-সহায়ক পদের জন্য ২০ লাখ কর্মপ্রার্থীর আবেদন সেই পরিস্থিতির একটি সূচক মাত্র।
একটি আঞ্চলিক পুঁজিবাদী দল হিসেবে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার কিংবা কেন্দে্রর বিজেপি সরকার যে নীতি নিয়ে চলছে তাতে চাইলে কেবল কিছু বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে মাত্র– গোটা দেশের এই ভয়াবহ সমস্যা দূর করার ক্ষমতা তাদের নেই। বেকার সমস্যার মূল কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে দেশের সকল কর্মপ্রার্থীর জন্য কাজের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তার জন্য চাই পরিকল্পিত অর্থনীতি, যা সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি। এই সত্য এ দেশের বিপুল বেকারবাহিনী যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই মঙ্গল।