রাজারাজড়াদের আমলে তাঁদের নানা খেয়ালের কোপে সাধারণ মানুষের গর্দান যেত৷ তবু শোনা যায়, তাঁদের কেউ কেউ নাকি ছদ্মবেশে প্রজাদের মনের কথা শোনার চেষ্টা অন্তত করতেন৷ কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দু’চারজন ‘বিশেষ মিত্র’ ছাড়া দেশের আর কোনও মানুষের মনের কথা শুনতে আগ্রহী বলে কেউ জানে না৷ কিন্তু তাঁর ‘মন কি বাত’ দেশের মানুষকে শুনতে হয় এবং সেই ‘মন কি বাত’ কেন্দ্রীয় সরকারের কোষাগারের শত কোটির বেশি খরচ করে প্রতি মাসে দূরদর্শন এবং রেডিওতে প্রচারিত হয়৷ ২০১৪ সাল থেকে সরকারি প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ চলছে৷
অবশেষে গত ৩০ এপ্রিল পার হল এই অনুষ্ঠানের শততম পর্ব৷ বিভিন্ন সরকারি অফিসে, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করার ব্যবস্থা করা হয়৷ বলা বাহুল্য তার জন্য সরকারি কোষাগারের অর্থে কোনও ঘাটতি ছিল না৷ নির্দেশ ছিল খুব কড়া– প্রধানমন্ত্রীর মনের কথা বলে ব্যাপার, যত কাজই থাক, মন চাক বা না চাক– শুনতেই হবে৷
সেই নির্দেশ অমান্য করলে কী হয় টের পেয়েছেন চণ্ডীগড় পিজিআইএমইআর–এর ৩৬ জন নার্সিং ছাত্রী৷ তাঁরা ওই অনুষ্ঠানে গরহাজির ছিলেন৷ আর তাতেই রুষ্ট হয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দেয় প্রথম বর্ষের ২৮ জন এবং তৃতীয় বর্ষের ৮ জন ছাত্রী এক সপ্তাহের জন্য হস্টেলের বাইরে বেরোতে পারবে না৷ কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্তাবকের বাইরে কেউ প্রশাসকের চেয়ারে থাকবেন এমনটা এই ‘গণতন্ত্রের পীঠস্থানে’ আশা করাই বৃথা, তাই শাস্তি তো হবেই। এই ঘটনায় এই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ঝাঁঝরা হওয়া আসল চেহারাটা ফুটে বেরিয়েছে! স্বৈরাচারী হিটলার–মুসোলিনিদের্ অনুসারী বলে গর্ব করতেন নরেন্দ্র মোদিজির গুরু আরএসএস নেতা হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকর সাহেবরা৷ প্রধানমন্ত্রী তাদের মান রাখছেন বৈ কী!
আমাদের প্রধানমন্ত্রী এতই ‘গণতান্ত্রিক’ যে তাঁর শাসনকালে আজ পর্যন্ত একটিবারও জনগণের কোনও অংশই তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি৷ এমন কী নরেন্দ্র মোদি আজ পর্যন্ত একবারও সাংবাদিক সম্মেলন পর্যন্ত করেননি৷ আম্বানি–আদানিদের টিভি–চ্যানেলে কিছু বশংবদ সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিলেও, সাধারণ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি তিনি৷ কারণ তিনি জানেন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগের পাহাড় জমা হয়েছে৷ তাই সাংবাদিকদের, তথা দেশের মানুষের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়৷ খোদ মোদিজির দলের সাংসদ এবং জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং–এর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের সুরাহা চেয়ে দিল্লির যন্তর–মন্তরে দীর্ঘদিন ধরে ধরনায় বসে আছেন দেশের পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিররা৷ তাঁদের মনের কথা কি প্রধানমন্ত্রী শুনতে চাইতে পারতেন না? এই পদকজয়ী কন্যারা তাঁর বেটি বাঁচাওয়ের স্লোগান কান ভরে শুনেছেন৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কানে অত্যাচারিত এই বেটিদের কথা পৌঁছায়নি৷ কারণ মূল অভিযুক্ত হল তাঁর দলের ছয় বারের সাংসদ৷ শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে লালকৃষ্ণ আদবানির কুখ্যাত ‘রথযাত্রা’য় সে ছিল ‘রথ’ অর্থাৎ গাড়ির চালক৷ কাজেই এমন ভয়ংকর অপরাধের অভিযোগ সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি মোদিজির পুলিশ৷ উল্টে দেশের এই কৃতী কন্যাদেরই হেনস্থা এমনকী গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেছে৷
এইভাবে দেশের অগণিত ছাত্র–ছাত্রীর মনের কথাও প্রধানমন্ত্রী শোনেননি, তাদের স্বার্থরক্ষার কথা, উচ্চতম স্তর পর্যন্ত উন্নত মানের শিক্ষা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবেননি৷ ভাবলে, তাঁর সরকার চূড়ান্ত শিক্ষাবিরোধী, ছাত্রস্বার্থবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ চালু করতে পারত না৷ এই ব্যাপারে ছাত্র–শিক্ষক–আধ্যাপক-আভিভাবক-শিখাবিদ কারও মতই সরকার নেয়নি৷ কোভিডজনিত লকডাউনের আড়াল নিয়ে এই শিক্ষানীতি জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে৷
কৃষকের মনের কথা কি প্রধানমন্ত্রী শুনেছেন? যাঁদের শ্রমের সোনার ফসল দেশবাসীর অন্ন জোগায়, তাঁদের চোখের জল কি তাঁর মনে কোনও দাগ কেটেছে? বাস্তব বলছে, না৷ না হলে সংসদে কোনও আলোচনা করতে না দিয়ে চরম কৃষক–স্বার্থবিরোধী তিনটে কৃষি আইন আনতেন না৷ বিদ্যুৎ বিল ২০২১ এনে কৃষক সহ সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করতে চাইতেন না৷
কৃষকরা এক বছরের বেশি সময় ধরে দিল্লির সীমান্তে ধরনায় বসে থাকলেন৷ তীব্র শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার মধ্যে অটল এই কৃষকদের সাতশো জনের বেশি প্রাণ দিলেন ধরনাস্থলেই৷ প্রবল জনমতের চাপে কৃষকবিরোধী আইনগুলি আপাতত তুলে নিতে বাধ্য হলেও কর্পোরেট ‘মিত্র’–দের মনের কথা শুনে পিছনের দরজা দিয়ে প্রতিশ্রুতির বিপরীত কাজ করে চলেছে বিজেপি সরকার৷ অন্যদিকে শ্রম কোডে পরিবর্তন এনে নতুন শ্রম আইন লাগু করে শ্রমিকদের সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথে অর্জিত সমস্ত অধিকার তারা কেড়ে নিতে চাইছেন, যার বিরুদ্ধে দেশের শ্রমিক শ্রেণি আন্দোলনে নেমেছে৷ সুতরাং শ্রমিকের মনের কথা শোনার তাগিদও অনুভব করেননি মোদিজি৷
আসলে মোদিজি জানেন, দেশের সাধারণ মানুষের মনের কথা শুনতে গেলে একচেটিয়া পুঁজি মালিক কর্পোরেট মিত্রদের কথা আর শুনতে পারবেন না৷ আর এই মিত্ররাই তাঁর আসল প্রভু, তাঁর গদি টিকিয়ে রাখার ভরসা৷ কাজেই তিনি নিরাপত্তাবাহিনীর ঘেরাটোপে থেকে মাসে একটিবার যে ‘মন কি বাত’ মোদিজি শোনান সে আসলে ওই ধনকুবেরদেরই মনের কথা৷