পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীরা ভয়াবহ ডিএ বৈষম্যের শিকার। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে সরকারি কর্মচারী শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষাকর্মী, আদালত কর্মচারী, পৌর ও পঞ্চায়েত কর্মচারী সরকার পোষিত সমস্ত সংস্থার কর্মচারী সহ কয়েক লক্ষ পেনশন প্রাপকদের মহার্ঘ ভাতা-ডিয়ারনেস রিলিফের বঞ্চনা অতীতের সমস্ত নজির ছাপিয়ে আজ বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা ও পেনশনাররা পাচ্ছেন ৫০ শতাংশ ডিএ। আর এ রাজ্যের কর্মচারীরা মে মাসের শেষে মাত্র ১৪ শতাংশ ডি এ পাবেন।
এ রাজ্যে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পরে তাদের শ্রমমন্ত্রী বলেছিলেন, ডিএ সরকারি কর্মচারীদের অধিকার নয়। সকলেই জানেন, ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ফলে বেতনের যে অবনমন হয় মহার্ঘ ভাতা তার আংশিক ক্ষতিপূরণ মাত্র। তাই মহার্ঘভাতার কিস্তি বা শতাংশ বৃদ্ধি মানে কোনও বেতন বৃদ্ধি নয়। পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলিও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের মতো হারে (এআইসিপিআই) অনুযায়ী তাদের কর্মচারী, শিক্ষক সহ সমস্ত অংশের সরকারি শ্রমজীবী মানুষ ও পেনশনারদের পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক বেশি মহার্য ভাতা দিয়ে থাকেন। কোনও কোনও রাজ্য ৪০ বা ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কর্মীরা এই বৈষম্যের শিকার হবে কেন?
এটা খুবই অপমানজনক যে, কর্মচারী ও পেনশনাররা মহার্ঘ ভাতা ও ডিয়ারনেস রিলিফের দাবি তুললে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাচ্ছিল্যের সাথে বলেন ‘ঘেউ ঘেউ করবেন না’, আবার কখনও বলেন ‘কোনও মহার্ঘ ভাতা বকেয়া নেই’, ‘১০৬ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিচ্ছি’, ‘৯০ শতাংশ ডিএ মিটিয়ে দিয়েছি’। কর্মচারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এরা সব চোর ডাকাতের সর্দার’, ‘চিরকুটে চাকরি পেয়েছে’। আবার কখনও এও বলেছেন ‘কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা পেতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারে চলে যান, সেখানে যোগ দিন, এখানে দাও দাও করবেন না’। মহার্ঘ ভাতা-ডিয়ারনেস রিলিফ না দেওয়ার যুক্তি হিসেবে রাজ্য সরকার বলেছে, কেন্দ্রের লক্ষ কোটি টাকা বঞ্চনা। রাজকোষে ঘাটতি থাকলে এই সরকার সম্প্রতি বিধায়কদের প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা এবং মন্ত্রীদের ৫০ হাজার টাকা ভাতা বৃদ্ধি করেন কী ভাবে? এদের বেতন ভাতা বৃদ্ধিতে অর্থসঙ্কট হয় না। যত বাহানা কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। এটা কোনও কর্মচারী মেনে নিতে পারেন কি?
রাজ্যের ৫ম বেতন কমিশন, ২০০৯ সালে বছরে দুই কিস্তি মহার্ঘভাতার একটি ১ জানুয়ারিতে এবং অপরটি ১ জুলাইতে নিয়মিত দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছিল। পূর্বতন সিপিএম সরকার এবং বর্তমান তৃণমূল সরকার এই সুপারিশের মান্যতা প্রদান করেনি। পরে ৬ষ্ঠ বেতন কমিশন গঠিত হয়েছিল ২০১৬ সালে। অদ্ভূত বিষয় ৬ষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ নজিরবিহীন ভাবে এই প্রথম প্রকাশ করা হল না। অথচ তার ভিত্তিতে ২০২০-র জানুয়ারি থেকে নজিরবিহীন ভাবে মহার্ঘভাতা-শূন্য নতুন বেতন কাঠামো চালু হয়। অতীতে এই রাজ্য কিংবা অন্য কোনও রাজ্যে কোনও দিন মহার্ঘ ভাতা-শূন্য সংশোধিত বেতন চালু হয়নি। অথচ এটাই ঘটল।
কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ২০২২-এর ২০ মে, এক ঐতিহাসিক রায়ে বলে, মহার্ঘ ভাতা কর্মচারীর হকের পাওনা শুধু নয়, সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারও। কর্মচারীদের স্বার্থের কথা ভাবলে রাজ্য সরকারের উচিত ছিল এই রায় মেনে নেওয়া। কিন্তু সরকার রায় মেনে নেওয়ার পরিবর্তে জনগণের ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে শীর্ষ আদালতে গেল কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকারকে নাকচ করার হীন উদ্দেশ্যে।
এ পর্যন্ত যতটুকু ডিএ কর্মচারীরা পেয়েছেন সবটাই রাজ্যের সর্বস্তরের ডিএ প্রাপকদের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে। ১০ মার্চ ২০২৩ ডিএ-সহ অন্যান্য দাবিতে সরকারি কর্মচারীরা ধর্মঘট করেছেন। এই আন্দোলন ভাঙার জন্য এক অদ্ভুত খেলায় নেমেছিল রাজ্য সরকার। বিগত দিনগুলিতে যখনই কর্মচারী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে তখনই প্রশাসনিক আমলাদের বাড়তি কিছু সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, কিংবা বিশেষ শ্রেণির কর্মচারীদের বা অফিসারদের কিছু পদোন্নতি বা অন্যান্য সুযোগ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অল্প সংখ্যককে পাইয়ে দিয়ে বেশি সংখ্যককে বঞ্চিত করো– এটাই হল সরকারি কৌশল। সব শাসকদের মতো শাস্তিমূলক বদলি কিংবা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করলে একদিনের বেতন ও কর্মজীবন থেকে উক্ত দিনটি কেটে নেওয়াকে রেওয়াজে পরিণত করা হয়েছে তৃণমূল আমলে। সর্বপ্রথম নবান্নে সব ধরনের প্রচার আন্দোলন বন্ধ করে দেয় এই সরকার। পরবর্তীকালে খাদ্যভবন ও অন্যান্য অফিসেও এই নির্দেশিকা জারি হয়। এ ভাবেই বর্তমানে আমলাদের হাতে লাগামহীন ক্ষমতা তুলে দিয়ে সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক ভীতির পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত চলছে।
ডিএ বঞ্চনা নিরসনে কর্মচারীদের আন্দোলন সেই ১৯৫৬ সাল থেকে চলছে। অর্থাৎ কংগ্রেস আমল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের কর্মচারীরা ডিএ বৈষম্যের শিকার। সর্বশেষ ৫ম বেতন কমিশনের সুপারিশ প্রকাশ ও তা দ্রুত রূপায়ণের দাবিতে ২০০৯ সালের সফল ধর্মঘট পূর্বতন সিপিএম সরকারকে ৬ মাসের মধ্যে সংশোধন কার্যকর করতে বাধ্য করেছিল। বর্তমান সময়ে তৃণমূল সরকারের যে বঞ্চনা চলছে তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গণআন্দোলনের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনেও এর জবাব দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদক শুভাশীষ দাস জানান, এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে আগামী দিনে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান সহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে রাজ্যব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।