বিজেপি আবার শুরু করেছে মন্দির রাজনীতি৷ গত চার বছর পড়ে থাকা আলখাল্লাটিকে ধুলো ঝেড়ে আবার গায়ে চাপিয়েছেন বিজেপি নেতারা৷ স্লোগান তুলেছেন, ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’৷ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর পাঁচশো বছরের পুরনো যে ঐতিহাসিক স্থাপত্যকর্মটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি–সংঘ বাহিনী সেই বাবরি মসজিদের জায়গাটিতেই বানাতে হবে রামমন্দির৷ সামনে লোকসভা নির্বাচন৷ তাঁদের আশা এই স্লোগানে ফয়দা উঠবে নির্বাচনে৷ হিন্দু ভোট একত্রিত হবে৷ রক্ষা পাবে তাঁদের গদি৷ ৬ ডিসেম্বর দিনটিকে সামনে রেখে বিজেপি–সংঘ পরিবারের নেতারা দেশের নানা প্রান্তে অসংখ্য রথযাত্রার কর্মসূচি নিয়েছেন যাতে দেশজুড়ে একটা সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি করা যায়৷ এই ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে ৬–১২ ডিসেম্বর ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সপ্তাহ’ পালনের আহ্বান জানিয়েছে দেশবাসীর কাছে৷ নিয়েছে অসংখ্য কর্মসূচি৷
কিন্তু গত নির্বাচনে বিজেপি নেতারা যে স্লোগানগুলি তুলেছিলেন– ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’, ‘আচ্ছে দিন’, ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘কালো টাকা উদ্ধার’, এমন আরও কত কী– সেগুলি কোথায় গেল? এবার আর সেগুলি তুলছেন না কেন সব ছেড়ে মন্দির রাজনীতিতে ফিরতে হল কেন বিজেপিকে?
গত চার বছরে এই স্লোগানগুলির প্রত্যেকটিই ভাঁওতা প্রমাণিত হয়েছে৷ বিজেপি সরকার পাশে থেকেছে শুধুমাত্র দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের৷ বিকাশ হয়েছে শুধু তাদেরই এবং তা অভাবনীয়, আকাশছোঁয়া৷ দেশজুড়ে জনগণের সম্পত্তি তারা লুঠ করে চলেছে অবাধে৷ এই সরকার যে দেশের কোটি কোটি সাধারণ শ্রমিক কৃষক গরিব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষের সরকার নয়, পুঁজিপতিদের সরকার তা আজ প্রমাণিত৷ বাড়ছে মানুষের ক্ষোভ৷ ফেটে পড়ছে বিক্ষোভে৷ বিজেপি নেতারাও শুনতে পাচ্ছেন সেই বিক্ষোভের আওয়াজ৷ বুঝতে পারছেন, তাদের উন্নয়নের, বিকাশের স্লোগান ভাঁওতা তা মানুষ ধরে ফেলেছে৷ তা হলে উপায়? উপায় সেই ধর্মীয় জিগিরে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ফিরে যাওয়া৷ দেশের একচটিয়া পুঁজিপতিদের বিশ্বস্ত সেবক বিজেপির ধর্মের জিগির তোলা ছাড়া আর পুঁজি নেই৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মেই একই সাথে শোষিত জনগণের এবং শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির উন্নয়ন ঘটতে পারে না৷ পুঁজিপতি শ্রেণির উন্নয়নের মূল্য চোকাচ্ছে জনগণ৷ জনগণের উপর অবাধে শোষণ–লুণ্ঠন চালিয়ে মুনাফার পাহাড় জমাচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণি৷ আর এটা যাতে পুঁজিপতিরা নির্ঝঞ্ঝাটে চালাতে পারে সরকারে বসে সেই কাজটিই করছে বিজেপি৷ আর, জনগণ যাতে এই শোষণের চরিত্র ধরতে না পারে, তার জীবনের সমস্ত সংকটের মূলে যে এই পুঁজিবাদী শোষণ, এটা বুঝতে না পারে, এর হাত থেকে রেহাইয়ের রাস্তাটা খুঁজে না পায়, যাতে তার দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় তার জন্যই বিজেপির এই হিন্দুত্বের জিগির৷ সাধারণ মানুষের মনে ধর্ম সম্পর্কে যে আবেগ, বিশ্বাস রয়েছে তাকে কাজে লাগাও, তাই দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত কর৷ পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষ যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে, তার জন্য সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালিয়ে সেই ঐক্যকে ভাঙো৷ পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে বিজেপি দক্ষতার সাথে এই কাজটিই করে চলেছে৷
বিজেপিকে দিয়ে এ কাজ করাতে তাদের পিছনে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢেলে চলেছে পুঁজিপতি শ্রেণি৷ তাদেরই পরিচালিত সংবাদমাধ্যম প্রচার দিচ্ছে দেদার৷ কিন্তু মাত্র চার বছরেই বিজেপির এই পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী এবং জনবিরোধী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষ৷ তাদের মনে ক্রমাগত ক্ষোভ জমা হচ্ছে, যা দেশের প্রান্তে প্রান্তে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের আকারে ফেটে পড়ছে৷ আর সেই ক্ষোভ যাতে সংগঠিত আন্দোলনের আকারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে, তাই পুঁজিপতি শ্রেণি তাদেরই আর একটি বিশ্বস্ত দল কংগ্রেসকে মাঠে নামিয়েছে৷ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর মুখের গরম গরম বুকনি খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলি মুহূর্মুহূ পৌঁছে দিচ্ছে দেশের মানুষের কাছে৷ অথচ এই কংগ্রেসই ১৯৮৬ সালে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে আজকের এই মারাত্মক পরিস্থিতির জমি তৈরি করে দিয়েছিল৷ ১৯৯২ সালে কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারে থাকার সময়ে বিজেপি–সংঘ পরিবার প্রকাশ্য দিবালোকে সংবাদমাধ্যমের সামনে বাবরি মসজিদ ভাঙা সত্ত্বেও তা আটকানোর কোনও চেষ্টা করেনি৷ বিজেপি নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেয়নি৷ মাত্র চার বছর আগেই কংগ্রেসের দুর্নীতি আর অপশাসনে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ বিজেপির মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল৷ আজ সেই কংগ্রেসই বিরোধী জোট গড়ে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ডাক দিচ্ছে৷ সেই ডাকে গলা মেলাচ্ছে যেমন তৃণমূল কংগ্রেস সহ আঞ্চলিক দলগুলি, তেমনই সিপিএমের মতো বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলিও৷ উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানির নেতৃত্বে যে রথযাত্রা দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বালিয়েছিল, এ রাজ্যে সেই রথকে আটকায়নি তৎকালীন সিপিএম সরকার৷ বিরোধী এই সব দলগুলির কারও লক্ষ্য সরকারি গদির দখল কারও পার্লামেন্টে কিছু আসন বাড়িয়ে নেওয়া৷ এই দলগুলি মানুষের বিজেপি বিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে৷ বিজেপির ব্যর্থতাগুলি তুলে ধরে তাদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য বলছে৷
এখানে একটা কথা স্পষ্ট বোঝা দরকার, বিরোধী ঐক্যের দ্বারা বিজেপিকে যদি ক্ষমতা থেকে সরানোও যায়, তবু তার দ্বারা বিজেপির বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাস্ত করা যাবে না৷ রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস কিংবা এ রাজ্যে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তৃণমূল এবং অন্য দলগুলি যে রাজনীতির চর্চা করছে তা–ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আর এক রূপ৷ রাহুল গান্ধী তো নরেন্দ্র মোদির সাথে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন– কে কত বেশি মন্দিরে যেতে পারেন৷ একদিকে রাহুল গান্ধী নিজেকে শিবভক্ত বলে প্রচার করছেন, বলছেন, তাঁরা অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের বিরোধী নন৷ আবার মধ্যপ্রদেশ রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যগুলির নির্বাচনে কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি বিলোচ্ছে, তারা ক্ষমতায় গেলে কত সংখ্যক গোশালা তৈরি করে দেবে৷ সংবাদমাধ্যম এর নাম দিয়েছে ‘নরম হিন্দুত্ব’৷
এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসও বিজেপির সাথে হিন্দুত্ব প্রচারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে৷ রামনবমী থেকে হনুমান জয়ন্তী পালন– কে কাকে টেক্কা দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে৷ যে রামের পুজোর কোনও প্রচলনই এ রাজ্যে ছিল না, মহাকাব্যের নায়ক ছাড়া আলাদা করে দেবতা বলে যার স্বীকৃতি ছিল না, যে হনুমানকে এ রাজ্যের মানুষ দেবতা বলে কখনও মনে করেনি, গণেশের পুজো একমাত্র ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল– দুই দলের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এখন সেগুলিকেই রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই এই দলগুলির কারও পক্ষেই বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে আদর্শগত ভাবে পরাস্ত করা সম্ভব নয়৷
এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে বামপন্থী দলগুলির কর্তব্য ছিল শাসক শ্রেণির এই সর্বনাশা চক্রান্তকে সামনে তুলে ধরে জনজীবন বিপর্যস্তকারী সমস্যাগুলি নিয়ে যুক্ত বামপন্থী গণআন্দোলন গড়ে তোলা, বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র আদর্শগত সংগ্রাম চালানো৷ সেই কর্তব্য ভুলে গিয়ে সিপিএমের মতো বামনামধারী দলেরও এখন মূল লক্ষ্য বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করে কোনও নীতির তোয়াক্কা না করে কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলির একটা জোটপাটের মধ্য দিয়ে কয়েকটা সিট বাড়িয়ে নেওয়া৷
মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস নেতৃত্ব সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণার সঙ্গে আপস করে ছিল৷ ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে জনগণের মধ্যে পশ্চাৎপদ সামন্তী চিন্তার প্রভাব দূর করে, ধর্ম সম্পর্কে ইতিহাসসম্মত ধারণা তুলে ধরে সমাজের গণতন্ত্রীকরণের কাজটি করেনি৷ ফলে মানুষের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ, জীবনযাপন সম্পর্কে সীমাবদ্ধতা থেকেই গিয়েছে৷ স্বাধীনতার পরেও সেগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার পরিবর্তে রঙ নির্বিশেষে শাসক দলগুলি তাদের ভোট রাজনীতির কাজে লাগিয়েছে৷ বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এই আপসেরই ফল৷ তাই আদর্শগত ভাবে সেগুলিকে পরাস্ত করে গণতন্ত্রের যথার্থ ধারণার প্রসার সমাজে ঘটাতে না পারলে, নির্বাচনে বিজেপি পরাস্ত হলেও, তার বিষাক্ত রাজনীতি পরাস্ত হবে না৷ মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িকতা শুধু একটি দলের বিষয় নয়, মানুষকে বিভক্ত করতে এটি পুঁজিপতি শ্রেণির একটি ষড়যন্ত্র৷ তাই কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় থেকেছে সে যেমন সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছে, ভোট রাজনীতিতে ফয়দা তোলার জন্য তাকে ব্যবহার করছে, পরে বিজেপি ক্ষমতায় বসে তার মাত্রা আরও চড়িয়েছে, ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় বসবে তারাও নানা কায়দায় এর চর্চা চালিয়ে যাবে৷
সাম্প্রদায়িকতা বুর্জোয়া শ্রেণির একটা মারাত্মক ষড়যন্ত্র৷ এই ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করতে হলে তা নীতিহীন ভোটসর্বস্ব রাজনীতি দিয়ে হবে না৷ প্রয়োজন উচ্চ নীতিনৈতিকতার আধারে শোষণমুক্তির সংগ্রামের সাথে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামকে যুক্ত করে শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলা৷ এসইউসিআই (সি) সেই সংগ্রামেই লিপ্ত রয়েছে৷