কোন দল কাদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে তা বোঝার অন্যতম উপায় হল কারা তাদের টাকা দেয় তা দেখা। এই নিরিখে এই মুহূর্তে ভারতে নির্বাচনী দ্বন্দে্ব অবতীর্ণ বৃহৎ দলগুলির মধ্যে কোনও পার্থক্যই দেখা যাচ্ছে না। এস ইউ সি আই (সি) একমাত্র দল যারা কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা সাহায্যের জোরেই নির্বাচনী এবং গণআন্দোলনের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে।
অমিত শাহ বলেছেন, নির্বাচনী বন্ড বাতিল হয়ে ট্রাস্টের মতো সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দেওয়ার ব্যবস্থায় নির্বাচনী রাজনীতিতে কালো টাকা ফিরে আসবে। কিন্তু নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার পরেও ২০১৩-তে কংগ্রেসের চালু করা ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের মাধ্যমে বিজেপি প্রতি বছর টাকা নিয়েছে। ২০১৪-২৩ পর্যন্ত যত টাকা রাজনৈতিক দলগুলির কাছে গেছে তার ৭৬ শতাংশ পেয়েছে বিজেপি। ট্রাস্টের টাকা যদি কালো হয়, তাঁরা তা নিলেন কেন?
নির্বাচনী বন্ড চালু থাকার সময়েই ২০২০-২১-এ প্রুডেন্ট ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট ২৪৫ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা রাজনৈতিক দলকে দিয়েছে, তার মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ২০৯ কোটি টাকা। বাকি ৩৬ কোটি টাকা গেছে জেডিইউ, এনসিপি, কংগ্রেস, আরজেডি, আপ এবং এলজেপি-র কাছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে ১৮টি ইলেক্টারাল ট্রাস্ট নথিভুক্ত হলেও সিংহভাগ চাঁদা লেনদেন প্রুডেন্ট ট্রাস্টের মাধ্যমেই হয়েছে। এতে ৯০ শতাংশ টাকা ঢেলেছে মাত্র ১০টি বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানি। ২০২২-২৩-এ ট্রাস্টের মাধ্যমে পার্টিগুলো পেয়েছে মোট ৩৬৬ কোটি, বিজেপি একা পেয়েছে ২৫৯ কোটি টাকা (দ্য ওয়্যার ৫.০১.২৪)।
রিপোর্টার্স কালেক্টিভ জানাচ্ছে, প্রুডেন্টের মতো ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট নির্বাচনী বন্ডেও ২২০০ কোটি টাকা ঢেলেছে, যার ৭২ শতাংশ পেয়েছে বিজেপি (দ্য রিপোর্টার্স কলেক্টিভ, ১৭.০৩.২৪)। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর)-এর হিসাব অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বন্ড ছাড়া অন্যপথে যত চাঁদা দিয়েছে তার ৯০ শতাংশ গেছে বিজেপির তহবিলে। তারা পেয়েছে ৬৮০.৪৯৫ কোটি টাকা। বাকি সব জাতীয় দল মিলে পেয়েছে ৭০ কোটির কিছু বেশি।
কংগ্রেস পেয়েছে ৫৫.৬২৫ কোটি টাকা, আপ ১১ কোটি টাকা, সিপিএম ২ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকা। সিপিএম নির্বাচনী বন্ড থেকে কোনও টাকা না নিলেও ধারাবাহিকভাবে কর্পোরেট কোম্পানির থেকে টাকা নিয়েছে। ২০১৪-২০১৮ পর্যন্ত তারা কর্পোরেট থেকে পেয়েছে ৩ কোটি ১৬ লক্ষ টাকা। ২০১৯-২০২২-এ নিয়েছে ৬.৯১৫ কোটি টাকা (অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১০.০৪.২২)। ট্রাস্টের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকা দিয়েছে– পরিকাঠামো তৈরির বিতর্কিত সংস্থা মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং, নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সান্টিয়াগো মার্টিনের লটারি কোম্পানি ফিউচার গেমিং, ভারতী এয়ারটেল, আরসেলার মিত্তল গোষ্ঠী (দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়া ১৬.০৩.২৪)। তৃণমূল কংগ্রেসও সান্টিয়অগো মার্টিনের লটারি কোম্পানি, গোয়েঙ্কাদের কোম্পানি ইত্যাদিদের নানা সুবিধা দানের চুক্তিতে ১৬১০ কোটি টাকা পেয়েছে বন্ড থেকে। অন্য পথেও তারা টাকা নিয়েছে।
সান্টিয়াগো মার্টিনের থেকে ২ কোটি টাকা নিয়েছে কেরালার সিপিএম। সেই সময় (২০০৬-১১) ভিএস অচ্যুতানন্দনের সরকার অন্য লটারি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছিল। যদিও তাদের দাবি বিতর্ক হওয়ার পর পরে তারা এই টাকা ফেরত দিয়েছে। উল্লেখ করা দরকার, এই বিতর্কিত লটারি মালিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় তাঁর আইনজীবী হিসাবে কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংঘভি যেমন দাঁড়িয়েছেন, তেমনই কেরালার সিপিএম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের ঘনিষ্ঠ আইনজীবীও সান্টিয়াগোর হয়ে আদালতে দাঁড়িয়েছেন (ডেকান হেরাল্ড, ১৬.০৩.২৪)।
তিরবনন্তপুরমের আরএসপি নেতা শিবু বেবি জন নির্বাচন কমিশনের তথ্য তুলে দেখিয়েছেন, বন্ডের মাধ্যমে টাকা না নেওয়ার যতই গর্ব করুক সিপিএম, তারা বন্ডে টাকা ঢালা বিতর্কিত কোম্পানি মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং, নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং, কাইটে’, মুথহুট, ডাঃ রেড্ডিস ল্যাবরেটরি, ন্যাটকো ফার্মা, আবগারি মামলায় অভিযুক্ত অরবিন্দ ফার্মা ইত্যাদি কর্পোরেট সংস্থা থেকে টাকা নিয়েছে ( টাইমস অফ ইন্ডিয়া ৬.০৪.২৪)। ২০১৯-এ এডিআর রিপোর্ট জানিয়েছিল, কর্পোরেট ফান্ডিং থেকে সবচেয়ে বেশি (৯৮ শতাংশ) টাকা পেয়েছে বিজেপি, দ্বিতীয় কংগ্রেস, তৃতীয় স্থানে ছিল সিপিএম।