উত্তর ২৪ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের রূপমারি অঞ্চলের কুমিরমারি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল ইছামতির শাখা ডাঁশা নদীর জলে ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের দিন। ১১টি জায়গায় বাঁধ ভেঙে গ্রামের শতাধিক বাড়ি, রাস্তা, চাষের জমি, পুকুর, ভেড়ি প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। ২৬ মে থেকে এক মাসের বেশি হয়ে গেলেও বহু পরিবার এখনও বাস করছেন রাস্তায় পলিথিন খাটিয়ে। এই পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে ১ জুন থেকে একটানা কমিউনিটি কিচেন চালিয়ে যাচ্ছে বিদ্যাসাগর দ্বিশত জন্মবর্ষ উদযাপন কমিটি, বসিরহাট কোভিড রিলিফ সোসাইটি এবং এআইকেকেএমএস যৌথভাবে। প্রতিদিন দু’বেলা করে ৩৫০ মানুষের রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে ওই কমিউনিটি কিচেনে। একই সাথে এই সংগঠনগুলি ৭ থেকে ১৩ জুন প্রতিদিন ১৩০০ মানুষের জন্য কমিউনিটি কিচেন চালিয়েছে ওই অঞ্চলেরই বাঁশতলা গ্রামে। রান্না করছেন গ্রামের মানুষই। দুটি স্থানেই মেডিকেল ক্যাম্পেরও ব্যবস্থা করেছে তিনটি সংগঠন।
এই প্রয়াসের পাশে দাঁড়ানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যের নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুধু নয় বহু সাধারণ মানুষ। রিলিফ অ্যান্ড পাবলিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার, সার্ভিস ডক্টররস ফোরামের মতো স্বেচ্ছাসেবী এবং চিকিৎসকদের সংগঠন তো আছেই এছাড়াও এসেছেন অনেকে। তাঁদের সকলের জোরেই একটানা চলছে কমিউনিটি কিচেন। ২৫ জুন এমনই দুটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে কুমিরমারি পৌঁছে শোনা গেল গ্রামবাসীদের কথা। সেদিন ওই গ্রামে পৌঁছেছিলেন প্রাক্তন কমসোমলদের সংগঠন ‘মধ্য কলকাতা অনুভব’ এবং আশুতোষ কলেজের প্রাক্তনীরা। ২০০৫ সালে এই গ্রামে প্রথম বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকার চাষের জমিকে গ্রাস করেছিল নদী। পরে সামান্য কিছু অংশে কংক্রিটের বাঁধ তৈরি হলেও বেশিরভাগ জায়গাতে নতুন করে আর সে বাঁধ বাঁধেইনি সরকার। গ্রামবাসীদের চাপে পরে নদী থেকে বহু দূরে কিছুটা মাটির তৈরি রিং বাঁধ হয়েছে। ফলে নোনা জলের গ্রাসে চলে যাওয়া চাষের জমি আর উদ্ধার হয়নি। এ বছর সেই বাঁধটুকুও প্রায় শেষ। যা দেখিয়ে প্রভাস সরদার, দীপঙ্কর নাথ, সানাতন আড়ির মতো অনেকেই বললেন, কংক্রিটের বাঁধ না হলে এবার আমাদের বেঁচে থাকাই দুষ্কর।
গ্রামবাসীরা দেখালেন নদীর গভীরতা কমছে, জাগছে চর আবার একই সাথে বাড়ছে ভাঙন এবং বন্যা। সেই সিপিএম সরকারের আমল থেকে এই তৃণমূল সরকার কারও নদী নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা নেই। কেন্দ্রীয় সরকার সুন্দরবনের মানুষগুলির অস্তিত্বের কথা জানে কি না, সেটাই বোঝা যায় না! গ্রামের এক প্রবীণ মানুষের কথায়– ‘ভোট মানে যেন আজ অফারের রাজনীতি চলছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো নানা কিছু পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষের ভোট কিনতে ব্যস্ত। অথচ মূল সমস্যাগুলো নিয়ে তারা নীরব।’ বলে গেলেন, ‘ত্রাণ দিয়ে আমাদের ভুলে যাবেন না, স্থায়ী সমাধানের জন্য আমাদের পাশে দাঁড়ান’।
কিন্তু সুন্দরবনের নদী, পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষা করতে হলে যে সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার, তা করবে কে? স্বাধীনতার পর থেকে রাজ্যে কেন্দ্রে গদিয়ান কোনও সরকারেরই তো মাথাব্যথা নেই!
কমিউনিটি কিচেনের অন্যতম উদ্যোক্তা এ আই কে কে এম এস-এর নেতা অজয় বাইন ছিলেন নদীর পাড়ে, গ্রামবাসীদের নিয়ে পরের দিনের কটালের সম্ভাব্য বিপদ সম্বন্ধে কথা বলছিলেন। গণদাবীর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘কংক্রিটের বাঁধ এবং ম্যানগ্রোভের বলয় তৈরির জন্য আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। ইতিমধ্যেই সুন্দরবন জীবন জীবিকা রক্ষা কমিটি গড়ে উঠছে।’ গোটা সুন্দরবন জুড়েই যে দাবি আজ মানুষের মধ্যে উঠছে–শুধু ত্রাণ নয়, চাই স্থায়ী সমাধান। সেই দাবিতেই জোট বাঁধছে রূপমারি অঞ্চলের মানুষও।