১৩ এপ্রিল মানবাধিকার সংগঠন সিপিডিআরএস-এর কোচবিহার জেলা কমিটির সম্পাদক আব্দুর রউফের নেতৃত্বে নীরেন রায় ও হরেন বর্মন, এই তিন জনের তথ্য অনুসন্ধানকারী একটি দল কোচবিহার জেলার শীতলকুচি বিধানসভা কেন্দ্রে জোড়পাটকি অঞ্চলের আমতলি গ্রামে ১২৬ নম্বর বুথ এলাকায় যায়। এই প্রতিনিধি দল কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে নিহতদের বাড়িতে ও গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দাদের বাড়িতেও গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে।
নিহত ও আহতদের পরিবারবর্গ ও অন্যান্য গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে প্রতিনিধি দল তাদের লিখিত রিপোর্টে বলেছে, ‘আমরা দৃঢ় ভাবে মনে করি, কেন্দ্রীয় বাহিনী সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় গুলি চালিয়ে মনিরুজ্জামান, হামিদুল, সামিউল এবং নুর আলমকে হত্যা করেছে।’ প্রতিনিধি দল বলেছে, শীতলকুচি বিধানসভার এই বুথে সকাল থেকে ভোট শান্তিপূর্ণ ভাবেই চলছিল। সকাল ন’টা নাগাদ ওই বুথ থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে জাহিদুল হক নামে ১২/১৩ বছরের এক কিশোরকে ভ্রাম্যমান সিআইএসএফ জওয়ানরা প্রচণ্ড মারধর করে। ঘাডে, পিঠে, পাঁজরে আঘাত পেয়ে ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে যায়। তাকেহাসপাতালে ভর্তি করতে হয়়। এদিকে গ্রামে রটে যায়, কেন্দ্রীয় বাহিনী একটি ছেলেকে মারধোর করে তুলে নিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজিত জনতা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা জওয়ানদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। সঠিক খবর না থাকায় পরিবেশ ধীরে ধীরে আরো জটিল হতে থাকে। গ্রামবাসীদের উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ১২৬ নম্বর বুথের ভোটকর্মীরা ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন এবং ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়ে যায়। বুথের ভিতরে এবং ওই স্কুল ক্যাম্পাসের মধ্যে তখনও পর্যন্ত কোন গোলমাল ছিল না।
কিছুক্ষণ ভোট স্থগিত থাকার পর পুনরায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। সকাল পৌনে দশটা নাগাদ রাস্তার দু’দিক থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের দুটি গাড়ি আসে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রথম গাড়িটি স্কুল গেটের সামনে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে নেমে জওয়ানরা যাকে সামনে পায়, তাকেই লাঠিপেটা করতে থাকে। দ্বিতীয় গাড়িটি স্কুল বাউন্ডারির দেওয়ালের শেষ অংশের পাশ দিয়ে (স্কুল ক্যাম্পাসের শুধু সামনেই দেওয়াল, অন্য সব দিক খোলা) কিছুটা ঢুকে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন জওয়ান নেমেই গুলি চালাতে শুরু করে। ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মনিরুজ্জামানের বুকে গুলি লাগে। তিনি লুটিয়ে পডেন়। আতঙ্কে চিৎকার, ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। সামিউল মোবাইলে ভিডিও করছিলেন, তাকে এক জওয়ান হাতের ইশারায় কাছে ডাকে, সামনে যেতেই বুকে গুলি করে। একটি ছেলেকে জওয়ানরা খুব মারছিল, তার দাদা হামিদুল ভাইকে বাঁচাতে এক জওয়ানের পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে ভাইকে ছেড়ে দিতে বলেন। সেই জওয়ান তার পিঠে গুলি করে। উপুড় হওয়া অবস্থায় নিথর হয়ে যায় হামিদুলের দেহ। আর একজন নিহত ব্যক্তি নুর আলম (১২৫ নম্বর বুথের ভোটার) পাশের বুথে ভোট দিয়ে ১২৬ নম্বর বুথের পাশ দিয়ে নিজের লিজ নেওয়া জমিতে বোরো চাষের তদারকি করতে যাচ্ছিলেন। তিনি গুলিগোলা দেখে ভয়ে দৌড়তে থাকেন। ততক্ষণে জওয়ানদের প্রথম গাড়িটি বেরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় গাড়িটি স্টার্ট দেওয়া অবস্থায় ছিল। পরপর তিন জনকে গুলি করে মারার পর গাড়িতে উঠে যাওয়ার আগে ছুটন্ত নুর আলমকে গুলি করে বাহিনীর জওয়ানরা। এলাকার বাসিন্দাদের কথায়, ১২৬ নম্বর বুথে সকাল থেকে যে সিআইএসএফ জওয়ানরা ডিউটি করছিল, তারা ভোটারদের সাথে কোনও খারাপ আচরণ করেননি। কিন্তু এতগুলি তরতাজা যুবকের নিহত হওয়ার দৃশ্য দেখে তারা আর ওখানে থাকার সাহস পায়নি, গাড়িতে উঠে পালায়। গ্রামবাসীদের সব রাগ গিয়ে পড়ে ভোটকর্মীদের ওপর। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ভোট কর্মীরা অরক্ষিত অবস্থায় ছিলেন।
প্রতিনিধি দল দেখেছে, এলাকার বেশিরভাগ মানুষ অতি নিরীহ। বেশিরভাগই অশান্তি এবং বিভেদপন্থার বিরোধী। তবুও গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে রয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বার্থন্বেষী মহল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোরও চেষ্টা করছে। প্রতিনিধি দল এই পরিস্থিতিতে দাবি করেছে – অপরাধী জওয়ানদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইএসএফ জওয়ানদের ও কোচবিহার পুলিশ সুপারকে সাসপেন্ড করতে হবে। তাদের আরও দাবি, গ্রামের একটি সাধারণ কিশোরকে জওয়ানরা মারল কেন, এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে, দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
আত্মরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালানোর মিথ্যা প্রচার বন্ধ করে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশের দাবি করেছে প্রতিনিধি দল। সিপিডিআরএস নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ও আহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঘৃণ্য, পৈশাচিক মন্তব্যকারী বিজেপি নেতাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে।