শহরের দু’টি নামী স্কুলে শিশুর যৌন নিগ্রহের অভিযোগকে কেন্দ্র করে তোলপাড় কলকাতা সহ সমগ্র রাজ্য৷ দুটি স্কুলেই দোষীদের গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তির দাবিতে স্কুলের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ, মিটিং, মিছিল, রাস্তা অবরোধ পর্যন্ত করেছেন অভিভাবকরা৷ অন্য স্কুলের অভিভাবকরাও আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ শেষ পর্যন্ত প্রবল বিক্ষোভের চাপে প্রশাসন দুটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করেছে৷ ২০১৪ সালেও জি ডি বিড়লায় একই রকমভাবে শিশুর ওপর যৌন নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল৷ কর্তৃপক্ষ তাতে আমল দেয়নি৷ এম পি বিড়লায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী সাংবাদিকদের জানায় যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এটাই প্রথম অপরাধ নয়৷ সে নিজে পঞ্চম শ্রেণি থেকে অভিযুক্ত মনোজের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে আসছে৷ শুধু এই দুটি স্কুলই নয়, হুগলির এক বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল সহ আরও নানা স্কুলে নানা সময়ে এই ধরনের মারাত্মক অভিযোগ ওঠায় স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকরা সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রবল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন৷
এ রাজ্য সহ সারা দেশে শিশু ও নাবালিকাদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ দশ বছর আগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি দু’জনে একজন শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হয়৷ এখন যে তার মাত্রা আরও বেড়েছে তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না৷ ভারতীয় শিশুরা রক্তাল্পতা, অকালমৃত্যু ও কম ওজনের মতো মাপকাঠিতে অন্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও যৌন নির্যাতনের শিকার হিসাবে অনেক এগিয়ে৷ বালকরাও এই ধরনের নিগ্রহের হাত থেকে রেহাই পায় না৷ এ ঘটনা প্রতি বছর বেড়ে চলেছে৷ ২০১৫–১৬ সালে দেশে শিশুদের উপর নির্যাতন ১১ শতাংশ বেড়েছে৷ এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশে পঞ্চম, যদিও এনসিআরবি–র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অপরাধীদের সাজা দেওয়ার হারে পশ্চিমবঙ্গ সবার শেষে৷ বছরের শেষে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছোট্ট শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের এই চিত্র আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ সংবেদনশীল, সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে, জিডিপি দিয়ে আমরা যদি উন্নয়ন টের পাই তাহলে শিশু যৌন নির্যাতনের মাপে আমাদের সামাজিক মূল্যায়ন কোন স্তরে?
শিশু নিগ্রহ বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এক এক করে বেরিয়ে এসেছে বেসরকারি স্কুলগুলির ভিতরকার প্রকৃত অবস্থা৷ বেসরকারি স্কুলগুলিতে মাত্রাছাড়া ফি দিতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা৷ শুধু তাই নয়, বই, বান্ডিল বান্ডিল খাতা, বছর বছর নতুন ড্রেস, ব্যাগ সহ প্রায় সব কিছুই বাজার দরের থেকে অনেক বেশি দামে স্কুল থেকে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ স্কুলগুলিতে রাজনীতিবিদ, আমলা ও স্কুল ট্রাস্টগুলির মধ্যে অশুভ আঁতাত কাজ করে চলেছে, যেখানে ছাত্রী নিরাপত্তার থেকে স্কুল–ব্যবসায় উত্তরোত্তর লাভই প্রাধান্য পেয়ে থাকে৷ অনেক ক্ষেত্রে শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, রাজনীতিকরাও বেসরকারি স্কুলের রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে৷ উন্নয়ন খাতে প্রতিটি ছাত্রের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা নিচ্ছে স্কুলগুলি৷ অথচ স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে ছাত্রী নিরাপত্তার মতো পরিকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলি চূড়ান্ত অবহেলিত হয়ে চলেছে৷ জি ডি বিড়লার মতো নামি এবং দামী স্কুলে অভিযোগ উঠেছে, গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছেলে ও মেয়েদের একই বাথরুম, বাথরুমে ছিটকিনি লাগে না, বাথরুম অপরিষ্কার, সিসিটিভি নেই৷ অন্য স্কুলগুলির অবস্থা সহজেই অনুমেয়৷
এই অবস্থায় পথ কী? পথ দুটো৷ এক, যতক্ষণ না নিজের চালে আগুন লাগছে ততক্ষণ সবকিছু মেনে নিয়ে চুপ করে থাকা৷ আর তা না হলে জোটবদ্ধ হওয়া৷ অভিভাবকদের ফোরাম গঠন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে৷ যে ফোরাম স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এবং অভিভাবকদের পারস্পরিক দায়িত্ব–সম্পর্ক নিয়ে, ফি–বৃদ্ধি সহ সার্বিক বিষয় নিয়ে, স্কুলের অভ্যন্তরে ছাত্র–ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন করবে, সরকারের কাছে দাবি তুলে ধরবে, প্রয়োজনে অভিভাবকদের নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করবে৷ এই ভাবনাটাই শুভ লক্ষণ৷ সন্তানের নিরাপত্তার দাবিতে অভিভাবকেরা যে দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দিলেন তা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে৷