সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীতে একটি সিবিএসই স্কুলে ছাত্রদের পড়তে দেওয়া শিশুশ্রেণির সাধারণ জ্ঞানের কুইজ একটি বইতে অদ্ভুত প্রশ্নোত্তরের সম্মুখীন হয়েছেন শিক্ষকরা। প্রশ্নোত্তরটি হল–
প্রশ্নঃ সিন্ধু সভ্যতার প্রথম দেবতার নাম কী?
উত্তরঃ শিব।
সঙ্গে শিবের একটি আধুনিক মূর্তির ছবি, মাথায় যথারীতি সেই চাঁদের ফালি ও জটা; কিন্তু রঙিন নয়, একটি স্লেটরঙা পাথরের মূর্তির আবক্ষ অংশ। প্রথমে বিষয়টিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও তাঁরা পরে উপলব্ধি করেছেন – এই তথাকথিত হাস্যকর প্রশ্নোত্তর ও তার সঙ্গী ছবিটির মধ্যে লুকিয়ে আছে শিশু মস্তিষ্কে কতগুলি বিকৃত ও অসত্য ধারণাকে স্রেফ তথ্য মুখস্থ করানোর ছলে গেঁথে দেওয়ার এক মারাত্মক প্রয়াস। সত্যটা বুঝে হাসির বদলে আশঙ্কাই বড় হয়ে উঠেছে তাঁদের।
বাস্তবিক ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ নামক বিজেপি সরকারের শিক্ষানীতির সাম্প্রতিক আক্রমণ যে আসলে আমাদের সমাজজীবনে জ্ঞানচর্চা ও চিন্তাভাবনার স্তরে কী ধরনের ভয়ঙ্কর হুমকি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। শুধু তাই নয়, সামাজিক স্তরে তার উপাদান ইতিমধ্যেই কী পরিমাণে এবং কতটা মজুত হয়ে রয়েছে, তার একটা আন্দাজ এর মধ্যে দিয়ে পেয়ে শিক্ষকরা উদ্বিগ্ন। যাক, সে এক পৃথক আলোচনা। আপাতত, সিন্ধু সভ্যতায় দেবতা হিসেবে শিবের আদৌ কোনও স্থান ছিল কি না, এবং থাকলেও তা কতটা, তা একটু দেখে নেওয়া যাক।
প্রথমে একটু খতিয়ে দেখা যাক, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে যা পাওয়া যায়– যেমন কোনও ধ্বংসস্তূপ, সিলমোহর, শিলালেখ, কোনও চিঠি বা এইরকম বাস্তব কিছু– তার সাথে ‘ইতিহাসের’ সম্পর্ক আসলে কী? অবশ্যই এগুলিকে ভিত্তি করেই ইতিহাস রচিত হয়, কিন্তু তার প্রক্রিয়াটি ঠিক কী? ইতিহাসবিদরা তাঁদের ধারণার উপর ভিত্তি করে এই উপাদানগুলোর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হন, সেই সময়ের প্রাপ্ত অন্য উপাদানের সাথে তাদের সম্পর্ক নিরূপণ করে সেই সময়ের মানুষের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণার জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই কাজের ধরনের কারণেই ‘পাথুরে প্রমাণ’ হিসেবে তখন সামনে যা থাকে, তার ব্যাখ্যায় মিশে যায় যে ইতিহাসবিদ তাকে ব্যাখ্যা করছেন তাঁর নিজস্ব সময়, চিন্তাভাবনা ও ধারণা। এগুলি কিন্তু সবটাই তাঁর নিজস্ব এবং সাবজেকটিভ। আর ঠিক এখানেই ইতিহাস ঐতিহাসিক উপাদানের অবজেকটিভিটি থেকে সরে যায়, হয়ে পড়ে কল্পনাশ্রয়ী। সেই কারণেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে ইতিহাস রচনার জন্য সবসময় চেষ্টা করা দরকার, ইতিহাসের প্রামাণ্য তথ্য থেকে ঠিক যেটুকু নিশ্চিতভাবে বলতে পারা যায়, ইতিহাসবিদের ব্যাখ্যাকে ঠিক ততটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা। না হলেই কল্পনার বল্গা হরিণ ছুটতে আরম্ভ করে গুলিয়ে দেবে গোটা বিষয়টিকেই।
সিন্ধু সভ্যতায় সিলমোহরে যে মূর্তির রিলিফ পাওয়া গেছে, তার সাথে পরবর্তী দেবতা ‘শিব’-এর ধারণার কতটা সত্যি মিল আছে? সিলমোহরে মূর্তিটিকে ঘিরে বিভিন্ন পশুকে দেখা যায়। সিন্ধু সভ্যতার ভাষার পাঠোদ্ধার আজও হয়নি। তাই তাকে সে যুগের মানুষ তাকে সত্যিই যে নামে ডাকত তা না জানার ফলে পশুপতি বলা হয়। এই নামটি কিন্তু পুরোপুরি আধুনিক কয়েনেজ। আবার পরবর্তী আর্য যুগের (বৈদিক নয়, তার পরবর্তীকালে) দেবতা শিবেরও আরেক নাম, তথা ধারণা পশুপতি। এই শিবের প্রাথমিক ধারণাও আর্যরা অনার্যদের কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিল বলে ধারণা করা হয়। যদিও সেই অনার্যদের সাথে সিন্ধুসভ্যতার কতটুকু যোগসূত্র ছিল তা আমাদের অজানা এবং সেই কারণেই বিষয়টা অনিিচত। এই সব মিলিয়ে অনেকের মধ্যে একটা ধারণা গড়ে ওঠে এবং আধুনিক হিন্দু ধর্মোদ্ভূত ভাবনা ও পরিবেশের কল্যাণে সার জল পেয়ে তা রীতিমতো ছড়িয়েও পড়তে শুরু করে যে, শিব হল সিন্ধু সভ্যতার সময়ের দেবতা। আমাদের বোঝা দরকার – এই ধারণাটি একটি আধুনিক ফ্যালাসি বা বিভ্রান্তি মাত্র। আগেই বলা হয়েছে, ইতিহাস নির্মিত হয় পাথুরে প্রমাণের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু সেই প্রমাণকে যখন কেউ ব্যাখ্যা করেন, ঐতিহাসিক যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদেই যে ব্যাখ্যার দরকারও আছে, কিন্তু সেই সময়েই আবার ঘনিয়ে আসতে পারে অন্য বিপদ। ইতিহাসের এবং বিজ্ঞানের নির্মোহ দৃষ্টিতে তা পরিচালিত না হলে ওই ব্যাখ্যা ব্যাখ্যাকারের নিজস্ব ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ফলে বাস্তবে তা হয়ে দাঁড়ায় অনেকটাই মনগড়া। ইতিহাসের প্রকৃত চিত্রের বদলে প্রচলিত ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয় তা। ফলত প্রকৃত প্রমাণভিত্তিক ইতিহাস থেকে তা অনেকটাই দূরের বিষয়। ‘সিন্ধু সভ্যতার দেবতা ছিল শিব’- এই ধারণাটি এই কারণেই প্রমাণ্য ইতিহাসের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কবিহীন। আর ‘প্রথম’-এর তো কথাই ওঠে না, কারণ সিন্ধু সভ্যতার দেবতাদের দুনিয়া বা প্যানথিওন এবং তার গঠন সম্পর্কে আমরা এখনও পর্যন্ত প্রায় কিছুই জানি না।
সিলমোহরটি ১৯২০ সালে আবিষ্কৃত হয়। এএসআই-এর তৎকালীন ডিরেক্টর জন মার্শাল প্রাথমিকভাবে একে শিব বা রুদ্র বলে অভিহিত করেন। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাসবিদরা প্রায় সকলেই এই ধারণার বিরোধিতা করে বলেছেন, এটি একটি আধুনিক প্রচলিত ধারণাকে জোর করে ইতিহাসের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস মাত্র।
ইতিহাসবিদ ডরিস শ্রীনিবাসনের মতে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের এই সিলমোহরের শিবের মতো তিনটি মুখমণ্ডল নেই, তার ভঙ্গির সাথেও যোগরত শিবের ভঙ্গির পার্থক্য আছে। তা ছাড়া বৈদিক দেবতা রুদ্রের ধারণার সাথে পশুপতির ধারণা সংশ্লিষ্টই নয়। ইতিহাসবিদ আলফ হিলটেবাইটেল পাথুরে প্রমাণের উপর কোনওরকম অতিরিক্ত ধারণাকেই চাপিয়ে দিতে অস্বীকার করে মূর্তিটিকে শুধুমাত্র মহিষদেবতা বলে অভিহিত করেছেন যা সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতিতে মহিষের সম্ভাব্য গুরুত্বের ইঙ্গিতবাহী।
আবার ইতিহাসবিদ গ্রেগরি পোশেল মূর্তিটিকে একটি দেবতা বলে স্বীকার করলেও, কিছুটা জলহস্তীর অনুকরণে তা গঠিত এবং তার ভঙ্গি কোনও চালু ধর্মীয় আচারের অনুবর্তী বলে মনে করেন। আর একটি সিলমোহরে ওই মূর্তিটির পাশে কোনও পশু নেই। ফলে পশুপতির ধারণাও এখানে দুর্বল। কিন্তু শিবের এমনকি কোনও আদি ধারণার সাথেও তাকে মেলাতে গেলে কল্পনাকে অনেক দূর পর্যন্ত স্বাধীনতা দিতে হয় বলেই মনে করেন তিনি। আবার কেউ কেউ, যেমন হাইনরিখ সিমার মূর্তিটির সাথে প্রথম জৈন তীর্থংকর ঋষভনাথেরও সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। মোটমাট বোঝাই যাচ্ছে, জন মার্শালের প্রাথমিক অনুমানটি আধুনিক ঐতিহাসিকদের কাছে আর গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত নয়।
তা হলে এইরকম একটি সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক ধারণাকে সাধারণ জ্ঞানের নামে যুক্তিবুদ্ধির স্তর গড়ে ওঠার আগেই শিশুমনের উপর চাপিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? নাকি তার পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য বিদ্যমান? উত্তরটাও জানা, বিজেপি সরকার তাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এইরকম বিকৃতিই ঘটাতে চাইছে। সব মিলিয়ে ইতিহাস, বিজ্ঞান আজ বিপন্ন। যে শিক্ষকরা এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছেন তাঁদের পাশে আজ সকলকে দাঁড়াতে হবে।