এ দেশে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু মৃত্যুর হার ৩৪ শতাংশ, পাঁচ বছরের কমবয়সীদের ক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ এবং শতকরা ২৫ জন সদ্যোজাত শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে৷ মূল কারণ মা ও শিশুর অপুষ্টি৷ শিশুদের ৫৯.৭ শতাংশ এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে ৫৪.৪ শতাংশ অপুষ্টিজনিত কারণে রক্তাল্পতার শিকার৷ শিশুরাই সমাজের ভবিষ্যৎ নাগরিক৷ স্বাভাবিকভাবেই সুস্থ–সবল শরীর ও মনের অধিকারী শিশু জাতির বিকাশের পক্ষে সহায়ক৷ আবার সুস্থ মা–ই সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারেন৷ কিন্তু ক্ষুধা সূচকে যে ভারতের স্থান ১১৯ টি দেশের মধ্যে ১০২তম, সেই দেশে মায়েরা–শিশুরা যে সুস্থ থাকতে পারে না, তা বোঝার জন্য আর কোনও পরিসংখ্যানের দরকার হয় না৷
স্বাধীনতার প্রায় তিন দশক পরে ১৯৭৪ সালে একটা জাতীয় শিশুনীতি ঘোষণা করা হল৷ শিশুর জন্মের আগে থেকেই অর্থাৎ শিশু যখন মাতৃজঠরে তখন থেকে শিশুর গড়ে ওঠার কাল (ছয় বছর) পর্যন্ত সুসংহতভাবে মা ও শিশুর পরিচর্যা ও দেখভালের জন্য ১৯৭৫ সালে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হল৷ নাম দেওয়া হল ‘ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস’– অর্থাৎ ‘সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্প’৷ এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথা ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু ঘোষণার তিন বছর পরেই সে ভাবনার মৃত্যু হয়৷ ১৯৭৮ সালে জনতা পার্টির সরকার এটা বন্ধ করে দেয়৷ তারপর আবার ১৯৯৫ সালে দশম–পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই ‘আইসিডিএস’ প্রকল্পকে কার্যকরী করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়৷
এর ফলে গ্রামীণ এলাকাগুলিতে অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার গড়ে তোলা হয়৷ এই সেন্টারে একজন কর্মী তথা সেবিকা ও একজন সহায়িকা থাকেন৷ তাঁদের কর্তব্যের তালিকায় রয়েছে একটি নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে মা ও শিশুদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যের দেখভাল করা, অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে মায়েদের সচেতন করা, প্রয়োজনে আশা কর্মীদের সাহায্য করা, বাড়ি বাড়ি যাওয়া, শিশুদের প্রাক বিদ্যালয় পড়া ও খেলাধূলা করানো, এ ছাড়াও ব্লকে রিপোর্ট করা, হিসেব রাখা ইত্যাদি৷ এতসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও এঁরা কিন্তু সরকারি কর্মী হিসেবে স্বীকৃত নন৷ তাই এঁদের ন্যূনতম বেতনও জোটে না৷ সাম্মানিক হিসাবে সামান্য কিছু টাকার সাথে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কিছু অনুদান যুক্ত হয়৷ সেন্টারগুলি চালাতে বরাদ্দ খাদ্য সামগ্রী–চাল, ডাল ও ডিম নিয়মিত আসে না৷ জ্বালানি, সব্জি, মশলা সেবিকাদেরই খরচ করে সুপারভাইজারের মাধ্যমে বিল পাঠাতে হয়৷ টাকা পেতে দেরি হয়৷ এই প্রকল্প নিয়ে বড় বড় কথা সরকার যতই বলুক, এর প্রতি পদক্ষেপে সরকারি অবহেলা, সদিচ্ছার অভাব আর দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট৷ আর্থিক শোষণে জর্জরিত দেশের নিরন্ন মানুষের কাছে রাষ্ট্রের একটা মানবিক মুখ তুলে ধরার উদ্দেশ্যে সুক্লের মিড–ডে মিল, পোষণ অভিযান (রাজস্থান) ইত্যাদি চালু হলেও আসলে সরকার এগুলিকে কী দৃষ্টিতে দেখে তা বরাদ্দের পরিমাণ দেখলেই মালুম হয়৷ মিড–ডে মিলে ছাত্র পিছু দৈনিক বরাদ্দ প্রাথমিকে ৪.৪৮ টাকা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৬.৭১ টাকা৷
গত পাঁচ বছরে প্রকল্পে বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে ১৩ শতাংশ৷ আর যাঁরা দৈনিক প্রায় আট ঘন্টা হাড়ভাঙা শ্রম দিয়ে বাজার করা, রান্না করা, পরিবেশন করা এবং পরিশেষে ধোওয়া–ধুয়ি করে এই প্রকল্পটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, সেই রাঁধুনি পান মাসে মাত্র ১০০০ টাকা, যার মধ্যে কেন্দ্র দেয় ৬০০ টাকা, বাকিটা দেয় রাজ্য৷ আবার এই ‘সাম্মানিক’ টাকাটাও তাঁরা পেতেন বছরে দশ মাসের জন্য৷ সম্প্রতি হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে ১২ মাসই এই সাম্মানিক অর্থ দেওয়ার কথা বলেছে৷
অপুষ্টির মূল কারণ দারিদ্র৷ গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষদের সারা বছর কাজ থাকে না৷ ফলে খাবারও জোটে না৷ গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প তৈরি হয়েছিল৷ দুর্নীতি ও বরাদ্দের স্বল্পতায় এই প্রকল্পটিও প্রচারেই থেকে গেল৷ মানুষের হাতে দু’বেলা পেট ভরে খাবার পয়সা এল না৷ এইভাবেই সামগ্রিক দিক থেকে অপুষ্টি দূরীকরণে সরকারের প্রকল্পগুলির ঢক্কা নিনাদ শূন্য কলসির আওয়াজের মতোই বেজে যাচ্ছে৷
এই জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দে সরকারের কার্পণ্য থাকলেও, সাম্প্রতিক আর্থিক মন্দায় মুষ্টিমেয় বৃহৎ শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়াতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাদের ১.৪৪ কোটি টাকা কর ছাড় দিয়ে দিল৷ অথচ এই টাকার অর্ধেক পরিমাণ টাকায় ১০০ দিনের প্রকল্পকে দ্বিগুণ করা যেত, এর মাত্র পঁচিশ শতাংশ টাকা দিয়ে অঙ্গনওয়াড়ি এবং মিড–ডে মিল প্রকল্প দু’টিকে দ্বিগুণ করা যেত৷ ভারতের ৪০,০০০ অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারের ৮০,০০০ সেবিকা ও সহায়িকা এবং ৪৮ লক্ষ মা ও ২ কোটি ৩০ লক্ষ শিশু, মিড–ডে মিলের ২৫ লক্ষ কর্মী আর এ দেশের প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকের কয়েক কোটি ছাত্রছাত্রীদের জড়িত করে যে সামাজিক প্রকল্পগুলি বিরাট এক পরিসরে কাজ করে, তাদের যথার্থ উদ্দেশ্য পূরণে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দের চিন্তার চেয়ে সরকারের কাছে বেশি জরুরি পুঁজিপতিদের স্বার্থ৷ তাই এই সমস্ত প্রকল্পের সাথে যুক্ত শ্রমজীবী মহিলারা আজ এই প্রকল্পগুলি যথাযথভাবে বাঁচিয়ে রাখতে রাস্তায় নেমেছেন৷ এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছে কোটি কোটি শিশু ও মায়ের বাঁচার অধিকার৷