Breaking News

শিল্প সম্মেলন অনেক হল, শিল্প নেই কেন?

আরও একটা বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন হয়ে গেল নিউটাউনে, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এ নিয়ে মোট আটবার। ২০১৫ সাল থেকে তৃণমূল সরকার ঘটা করে বাণিজ্য সম্মেলন করে চলেছে। থিম একই– বেঙ্গল মিনস বিজনেস। বাংলা বিনিয়োগের উর্বর ক্ষেত্র, এটা তুলে ধরা সরকারের লক্ষ্য। কারণ বিনিয়োগ না হলে শিল্প হবে না, শিল্প না হলে কর্মসংস্থান হবে না, উন্নয়ন হবে না। কর্মসংস্থান না হলে, বেকারত্ব বাড়বে, অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে। সরকারের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ফলে কর্মসংস্থানের বা শিল্পের সোনালী স্বপ্ন তুলে ধরা ক্ষমতাসীন সরকারগুলো অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন মনে করে। এতে শিল্পায়ন কতটুকু হয় তা মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানে। কারণ শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠা শুধু আবেগ বা ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। শিল্পের প্রতিষ্ঠা বা বিকাশ দেশের বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত একটি গুরুতর বিষয়।

শিল্পপতি ধরে আনার চেষ্টা সব সরকারই করে। পশ্চিমবঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও শিল্পপতি ধরে আনতে বারবার বিদেশ সফরে যেতেন। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটে বারবার ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’ নামক বাণিজ্য সমারোহ করেছেন। এই কদিন আগে কর্ণাটকে শিল্প সম্মেলনের আয়োজন কংগ্রেসও করেছিল। কেন শিল্পপতিদের এখন ধরে আনতে হয়? তাদের কি বিনিয়োগে অনীহা? অনীহা হবে কেন? বিনিয়োগ হলেই তো মুনাফা। তা হলে? আসলে বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখন শুধু এ রাজ্যে নয়, গোটা দেশে, গোটা বিশ্বে অনেকটাই ঝিমিয়ে। বহু চেষ্টাতেও ভোগ্যপণ্যের বাজার চাঙ্গা হচ্ছে না। ক্রেতা যাঁরা হতে পারেন সেই সাধারণ মানুষের পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় যে! তারা তেল-সাবান-শ্যাম্পু পর্যন্ত কেনা কমাচ্ছে বলে সমীক্ষকরা সরকারকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। কেনাকাটা না বাড়লে শিল্পে বিনিয়োগ হবেই বা কী করে? এই সমস্যাটা আড়াল করতে অনেকেই ব্যস্ত। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ– মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী সকলেই বলছেন, এই অর্থব্যবস্থাতেই তারা সমৃদ্ধি আনবেন। মুখ্যমন্ত্রী সমবেত কোরাসে গাইছেন– বাংলা বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র। কে নেই এই কোরাসে? মুখ্যমন্ত্রী বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছেন, চল্লিশটি দেশ তাদের আমন্ত্রণে সামিল হয়েছে, ২৫ জন রাষ্ট্রদূত এসেছেন। শিল্প প্রতিনিধি এসেছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি। উপস্থিত শিল্পপতিরা এ রাজ্যের শিল্প পরিবেশের গুণগানের বন্যা বইয়েছেন।

কর্পোরেট পুঁজি পরিচালিত সংবাদমাধ্যম এবং তাদের প্রচারক স্তাবকরা বলে থাকে, আন্দোলনের জন্যই বাংলা থেকে শিল্পপতিরা মুখ ঘোরাচ্ছেন। ওটা না থাকলেই শিল্পের বান ডাকবে বাংলায়! কিন্তু এ কথা যে ঠিক নয় সরকারি পরিসংখ্যানই দেখিয়েছে। আন্দোলন আদৌ না হলেও মালিকরা কারখানা লকআউট করছে, লে-অফ করছে। অতি মুনাফার লোভে পরিষেবা কিংবা শেয়ারের ফাটকায় খাটানোর জন্য উৎপাদন শিল্প থেকে তারা পুঁজি তুলে নিচ্ছে। পুঁজির নিয়মেই যেখানে বেশি মুনাফার সন্ধান পায়, পুঁজি সেখানে যায়।

একটা কথা সংবাদমাধ্যমের কর্ণধাররা খুব প্রচার করেন, শিল্প গড়তে গেলে সরকারের তরফে অনুদান দিতে হবে, বিনা পয়সায় বা নামমাত্র মূল্যে জমি, বিনামূল্যে জল, বিদ্যুৎ দিতে হবে, সুদবিহীন ঋণ বিনাশর্তে পাইয়ে দিতে হবে, সরকারি খরচে সব পরিকাঠামো গড়ে দিতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু তারা কখনওই বলেন না, বাজার থাকলে শিল্প তো স্বাভাবিক ভাবে গড়ে ওঠার কথা! শিল্প গড়তে পুঁজি মালিকদের এত তোয়াজ করতে হবে কেন? এই তোয়াজেই যদি শিল্পে জোয়ার আসত, তা হলে গুজরাটে ৪০০ বস্ত্র কারখানা, ২০টির বেশি বড় কাগজকল সহ ২ হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে আছে কেন? আমেদাবাদ তার ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার তকমা হারাল কেন? শত শত হিরে শিল্প গত বছর বন্ধ হয়ে গেল কেন? গুজরাটে ৬০০ কেমিক্যাল কারখানা ২০২৩-এ পাততাড়ি গুটিয়েছে কেন? সানন্দে বন্ধ হওয়া ন্যানো গাড়ির কথা না হয় বাদই দিলাম। গুজরাট সরকার তো একেবারে ঢেলে সুবিধা দিয়েছিল! এর কারণ পুঁজিবাদ সৃষ্ট মন্দা।

এ বারের শিল্প সম্মেলনে পুঁজিপতিরা বাংলা সম্পর্কে, বাংলায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা সম্পর্কে এত গদগদ প্রশংসা করলেন কেন? কারণ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের পক্ষ থেকে নানা বিষয়ে প্রভূত সাহায্য, সহযোগিতা এবং সবচেয়ে যেটা বড় কথা বাজার, তা গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বাজার কী ভাবে গড়ে দিচ্ছে? শিল্প সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী তার ৯৪টি সামাজিক প্রকল্পের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, ছাত্রদের সাইকেল দেওয়া, স্মার্ট ফোন দেওয়া ইত্যাদি নানা প্রকল্প যেগুলি এই সরকার চালাচ্ছে তা বারবার উচ্চারণ করে বলেছেন– এই সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি ১ কোটি ৭২ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে তুলে এনেছেন। এ দেশে দারিদ্রসীমার মান নানা সময়ই পাল্টানো হয়েছে। মাপকাঠি অবনমিত করে উন্নয়নের তথ্যও সরকার নানা সময়ে প্রচার করেছে। এর দ্বারা কাগজে-কলমে উন্নয়ন দেখানো যেতে পারে। বাস্তবটা বড় কঠোর। বাস্তবে কেনার ক্ষমতা বেড়েছে কতটুকু?

এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটে বিজেপি সরকারও সরকারি সাহায্য দিয়ে বাজার তৈরি করে দেওয়ার পথেই হেঁটেছে। মধ্যবিত্তদের জন্য বিপুল কর ছাড় দিয়েছে। কয়েক মাস আগে থেকে পুঁজিপতিরা সরকারের কাছে এই আবদারই করেছিল সরকার যাতে নানা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে জনগণের হাতে টাকা পৌঁছায়। কারণ পুঁজিপতিদের পণ্য বিক্রি কমে যাচ্ছিল। তার নানা পরিসংখ্যানও খবরের কাগজে প্রকাশিত হচ্ছিল। এর কারণ কী? কারণ একদিকে তীব্র মূল্যবৃদ্ধি, অন্য দিকে মানুষের রোজগার কমে যাওয়া– এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মানুষের যতটুকু রোজগার তার সিংহভাগ খরচ হয়ে যাচ্ছে খাদ্যপণ্যের পিছনে।

অন্যান্য ভোগ্যপণ্য বা বিলাসপণ্য কেনা মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এই সঙ্কট পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সর্বত্রই। কখনও এই বাজার সংকট একটু কমে তখন অর্থনীতি একটু চাঙ্গা হয়। আবার যখন এই সংকট বাড়ে অর্থনীতি ঝিমোয়। এইভাবে কখনো ঝিমানো এবং কখনো সরকারি সাহায্যে খানিক চাঙ্গা হওয়া, এই প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী অর্থনীতি চলছে। এই সমস্যার জন্যই সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যাপক শিল্পায়ন আজ আর সম্ভব নয়। আজকের যুগটা পুঁজির অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ নয়, একচেটিয়া পুঁজির যুগ। এখন শিল্প শ্রমিক-প্রধান হবে না। শ্রমিক-প্রধান শিল্প যা ছিল তা ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে। প্রযুক্তি প্রধান শিল্প, যেখানে শ্রমিক বেশি প্রয়োজন হয় না, তেমন শিল্প কিছু কিছু গড়ে উঠছে। এতে বিপুল কর্মসংস্থানের কোনও সম্ভাবনা নেই। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ফেরারও আশা নেই।

ঠিক সেই কারণে এতগুলো শিল্প সম্মেলন হলেও এত লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এলেও বাস্তবে তার অতি সামান্য বিনিয়োগ হচ্ছে। প্রস্তাবিত লগ্নির প্রায় সবই ফাইলবন্দি হয়ে থাকছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যেমন, ২০১৯ সালে দিঘার শিল্প সম্মেলন থেকে তাজপুর বন্দরের শিলান্যাস করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। ২০২২ সালে আদানি গোষ্ঠীকে এ সংক্রান্ত আগ্রহপত্র দেওয়া হয়। ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হওয়ার কথা এখানে। শঙ্করপুরে সাইট অফিসও খোলা হয়। তারপরে আর কাজ এগোয়নি। এ বার বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে তাজপুর বন্দর নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি (আনন্দবাজার পত্রিকা-১৪.২.২০২৫)।

কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ এর জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে এ রাজ্যে যত প্রস্তাব আসে, বাস্তবায়িত হয়েছে তার মাত্র ১০ শতাংশ। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এ বারের শিল্প সম্মেলনে ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। গত বছরের থেকে তা প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে মউ বা সমঝোতা পত্র স্বাক্ষর রয়েছে ২১২টি। কোথায় কোথায় লগ্নির প্রস্তাব এসেছে? ৯৩৬৮ কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাবিত হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। বস্ত্রক্ষেত্রে প্রস্তাবিত হয়েছে ৩৬০০ কোটি টাকার মতো। বলা হয়েছে হাওড়া হুগলি নদিয়ায় সাতটি বস্ত্র কারখানা হবে। এতে কিছু মানুষের চাকরি– তা স্থায়ী বা অস্থায়ী যা-ই হোক কিছু হয়ত হবে। কিন্তু বস্ত্রশিল্পে এমনিতেই মন্দা চলছে। বৃহৎ পুঁজির ব্র্যান্ডেড বস্ত্র ব্যবসা ছোট বস্ত্র কারখানাগুলোকে শেষ করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের মতো আন্তর্জাতিক নামী বস্ত্র কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কিছু কারখানা গড়ে তুলতে চায় বলে মনে হচ্ছে। এগুলি কার্যত হয়ে দাঁড়াবে শ্রমিক নিষ্পেষণ কারখানা, যা বাংলাদেশ সহ এশিয়ার নানা দেশে ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। পুঁজিপতিরা ক্রমাগত উৎপাদন শিল্প থেকে সরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিমা ইত্যাদি পরিষেবায় বিনিয়োগের দিক ছুটছে। তাতে কম বেতনের কিছু কাজও তৈরি হতে পারে। কিন্তু মূল বাজারের সংকট এই জায়গায় থাকলে এ সব টোটকায় আদৌ বেশি দিন চলবে না।

দুটি ক্ষেত্র নিয়ে এই শিল্প সম্মেলনের মঞ্চ থেকে খুব হইচই হয়েছে। এক, ডেউচা-পাঁচামিতে কয়লা উত্তোলন প্রকল্প, দুই, উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরে তেল উত্তোলন প্রকল্প। তেল উত্তোলন করবে ওএনজিসি। রাজ্য সরকার এ জন্য ১৫ একর জমিও তাদের দিয়েছে। সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এখানে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ, কিছু কর্মসংস্থান হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে যারা উচ্ছেদ হচ্ছে তাদের পুনর্বাসন জরুরি। ডেউচা-পাঁচামিতে পুনর্বাসন যে ঠিকমতো হচ্ছে না, এ নিয়ে যে বিক্ষোভ মানুষের মধ্যে রয়েছে, তা ইতিমধ্যেই সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে।

শিল্প সম্মেলনে উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রস্তাব হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা লগ্নির। বলা হয়েছে এতে ১৫ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থান হবে। এখানেই রয়েছে ঘোরতর অনিশ্চয়তা। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এমন নিম্নস্তরে রয়েছে যে তা ভোগ্যপণ্য বা বিলাসপণ্যের নির্ভরযোগ্য একটা বাজার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। তাহলে কীসের ভিত্তিতে উৎপাদন হবে? কোটি কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব যে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় না তার কারণ তো এখানেই।

তা হলে সঙ্কটের সমাধান কী? যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে তাকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে। এমন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে উৎপাদন মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে না। এই কাজটিই আজ জরুরি।