নীরব মোদি বা বিজয় মালিয়াদের মতো বৃহৎ শিল্পপতিরা ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধ না করে নিশ্চিন্তে বিদেশে ঘুরে বেড়ালেও সরকার বা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ নীরব৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ নীরব মোদি বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন৷ গীতাঞ্জলী গোষ্ঠীর মালিক নীরব মোদির মামা মেহুল চোকসির জালিয়াতির মোট অঙ্ক প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা৷ ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা যে শিল্পপতিরা পরিশোধ করছে না তা স্বীকার করে সম্প্রতি লোকসভায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন–ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা বর্তমানে বেড়ে হয়েছে, ৯,০৬৩ জন৷ এর মধ্যে বৃহৎ ঋণখেলাপি ২৮ জনের নাম কিছুদিন আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়৷ অর্থমন্ত্রক আরও জানিয়েছে এই জালিয়াতির মোট পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা৷
সরকারি বা বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির মূলধনের সিংহভাগই সাধারণ আমানতকারীদের জমানো টাকা৷ কোটি কোটি সাধারণ মানুষ রুটি–রুজির প্রয়োজনে বা ছোটখাটো ব্যবসা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা অথবা বিয়ের প্রয়োজনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কষ্টার্জিত টাকা ব্যাঙ্কগুলিতে জমা রাখে সুরক্ষার দিকে তাকিয়ে৷ ব্যাঙ্ক এই টাকা থেকে বিভিন্ন শিল্পপতিদের ঋণ দেয়৷ শিল্পের মন্দার কারণ দেখিয়ে প্রতিবছর এ দেশের বৃহৎ শিল্পপতিরা ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া টাকা শোধ করে না৷ অথচ দেখা যায় শিল্পের মন্দার বিরামহীন মায়াকান্নার মধ্যেই শিল্পপতিদের পুঁজির পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলে৷ সময়মতো ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় বর্তমানে ব্যাঙ্কগুলি দেউলিয়া হতে বসেছে৷ আবার ব্যাঙ্কগুলিকে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচাতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এফ আর ডি আই বিল আনার কথা ঘোষণা করেছে৷ এই বিল কার্যকর হলে কোনও আলোচনা বা সম্মতি ছাড়াই ব্যাঙ্ক সাধারণ আমানতকারীদের জমানো টাকা বদলে দিতে পারবে শেয়ার, বন্ড বা ডিবেঞ্চারে৷ দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে সরকার সাময়িকভাবে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে এই বিল কার্যকর করা থেকে৷ অন্যদিকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ঘোষণা করেছেন যে ঋণ পরিশোধ না করার যত অভিযোগই থাকুক না কেন, শিল্পপতিদের ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে কোনও অসুবিধা হবে না৷ এ ব্যাপারে ব্যাঙ্কগুলিকে কড়াকড়ি না করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার৷ সাথে সাথে সরকারি কোষাগার থেকে চলতি আর্থিক বছরে ২০টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের জন্য ৮৮ হাজার কোটি টাকা পুঁজির জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে শুধুমাত্র শিল্প মহলের ঋণের জোগান অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে৷ ঋণখেলাপিদের গ্রেপ্তার না করে তাদের ধার দেওয়া অব্যাহত রাখার সরকারি এই ঘোষণা সত্যই তাৎপর্যপূর্ণ৷ এদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের যে আশু প্রয়োজন ছিল তা সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে গেছে বিজেপি সরকার ও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ৷ সরকার ঘোষণা করেছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ছবি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে, যাতে ওই খেলাপিরা লজ্জায় পড়ে ধার মেটান৷ ঋণ খেলাপিদের প্রশাসন বার বার দেশে ফেরার নোটিশ পাঠিয়েছে৷ দেশে ফেরা তো দূরের কথা, বিদেশে অত্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে তারা জালিয়াতির টাকা ফেরত না দেওয়ার হুঙ্কার দিচ্ছে৷ তাদের এ হেন স্পর্ধার পরও কি বিশ্বাস করা যায় যে, সরকার ছবি প্রকাশ করলেই লজ্জায় মাথা হেঁট করে এসে ঋণের টাকা শোধ করে দেবে? এদের কি কোনও লজ্জাবোধ আছে? নীরব মোদি–মেহুল চোকসির মতো পুঁজিপতিরা যুগ যুগ ধরে মানুষের শ্রমশক্তিকে লুণ্ঠন করেই মালিক হয়েছে৷ শোষণ, প্রতারণা এদের মজ্জায় মজ্জায়৷ লজ্জা থাকলে এরা পুঁজির পাহাড় করতে পারত না৷ সরকারের এসব বালখিল্য যুক্তি আসলে এই প্রতারকদের বাঁচাতেই৷ সরকার কি কৃষকদের ক্ষেত্রে এই ঋণদান পলিসি নেবে? এ দেশের বেশিরভাগ চাষি প্রতি চাষের মরসুমে ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হয়, কিন্তু উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পায় না৷ ঋণের টাকা শোধ না করলে তাঁদের কি আবার ঋণ দেওয়া হয়? এঁদের প্রতি কিন্তু সরকার বা প্রশাসন কঠোর৷ এঁদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার সকল পন্থা সরকারের জানা এবং তা প্রয়োগ করতেও সরকার সিদ্ধহস্ত৷ আর বৃহৎ শিল্পপতিদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ছবি প্রকাশ করেই দায় খালাস করতে তৎপর৷ আসলে বিজেপি সরকার তথা দেশের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানে, জনগণকে তাদের প্রয়োজন পাঁচ বছরে একবার ভোটের জন্য৷ আর শিল্পপতিরা সারা বছর মাথায় ছাতা না ধরলে নেতা–মন্ত্রীদের ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ফুলে ফেঁপে ওঠার রাস্তা অচিরেই বন্ধ হবে৷ তাই ঋণখেলাপি শিল্পপতিদের গায়ে আঁচড় পর্যন্ত না লাগার ও এদের পুঁজি বৃদ্ধির সমস্ত রকম উপায়কে সচল রাখতে বিজেপি সরকার বদ্ধ পরিকর৷
70 Year 34 Issue13 April, 2018