একটি দল কাদের স্বার্থে কাজ করে, তা বোঝার একটি উপায় হল কাদের কাছ থেকে সে টাকা সংগ্রহ করে তার উপর৷ কারা টাকা দেয়, কী উদ্দেশ্যে দেয় ইত্যাদি প্রশ্ন একটা দল বিচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, ভারতের পুঁজিপতিরা জাতীয় ও আঞ্চলিক নানা দলকে লক্ষ কোটি টাকা দিয়েছে৷ আর শিল্পপতিদের সেই অনুদানের ৯৩ ভাগই গিয়েছে শাসক বিজেপির পকেটে৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কংগ্রেস৷ তৃতীয় স্থানে রয়েছে বামপন্থী নামধারী সিপিএম৷ এর পরে রয়েছে এনসিপি, সিপিআই এবং তৃণমূল কংগ্রেস৷ অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস সম্প্রতি এই তথ্য পেশ করেছে৷
কংগ্রেস–বিজেপির মতো পুঁজিপতি শ্রেণির প্রধান বিশ্বস্ত দলগুলি পুঁজিপতিদের টাকায় লালিত পালিত পরিপুষ্ট হবে, এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু যারা শ্রমিক শ্রেণির দল, গরিবের দল বলে দাবি করে তারা পুঁজিপতিদের টাকা নেবে কেন? তাদের থেকে টাকা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়া যায় কি? সত্যিই শোষিত মানুষের দল হলে তো দল পরিচালনার তথা গণআন্দোলন গড়ে তোলার এবং আন্দোলন করতে করতে নির্বাচন এসে গেলে তার খরচ শোষিত জনসাধারণই দেবে৷ এটাই তো তার নৈতিক জোর৷ জনসাধারণও যদি বোঝে এই দল তার স্বার্থে লড়াই করছে, তবে তারাও স্বেচ্ছায় সাহায্য করবে৷
ভারতের নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী, কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক দলকে ২০ হাজার টাকার বেশি সাহায্য দিলে, সেই তথ্য নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হয়৷ ২০১৭–’১৮ সালের হিসেব অনুয়ায়ী, ওই সময়ে জাতীয় দলগুলিকে দেওয়া মোট ৪৬৯ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকার মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৪৩৭ কোটি ৪ লক্ষ টাকা৷ কংগ্রেস প্রায় ২৬ কোটি টাকা পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে, সিপিএম ২ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে৷ এরপর এনসিপি ২ কোটি, সিপিআই ১ কোটি ১৪ লক্ষ এবং তৃণমূল ২০ লক্ষ টাকা পেয়েছে৷ বিএসপি জানিয়েছে, তারা কারও থেকেই ২০ হাজার টাকার বেশি সাহায্য পায়নি৷ যদিও অর্থপ্রাপ্তির তালিকা পেশ করতে গিয়ে জাতীয় দলগুলি বিভিন্নভাবে দাতাদের সম্পর্কে তথ্য এড়িয়ে গিয়েছে৷ অর্থাৎ আয়ের উৎস গোপন করতে বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই, তৃণমূল কেউই পিছিয়ে নেই৷ কেন এই তথ্য গোপন করছে? কারণ জনগণের কাছে এই দলগুলি ভোট চাইতে যায় এই সব পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে৷ তাই জনগণ কোনও অবস্থাতেই যেন জানতে না পারে যে, তাদের অর্থের জোগান আসলে পুঁজিপতিরাই দেয়৷ লক্ষণীয় বিষয় দুটি রাজ্যে সরকারি ক্ষমতা হারালেও পূর্বের ন্যায় সিপিএম এবারও শিল্পপতিদের থেকে নেওয়া অনুদানের পরিমাণে তৃতীয় স্থান দখলে রেখেছে৷ বোঝা যায়, ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণি সিপিএমের দেওয়া ৩৪ বছরের সেবায় যথেষ্ট খুশি এবং ভবিষ্যতে যাতে সেবার সুযোগ পেতে পারে সেজন্য এদের অর্থ দিয়ে, প্রচার দিয়ে জনগণের সামনে তুলে ধরতে তাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই৷
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি পুঁজিপতিদের থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক দেশবাসীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ ইতিমধ্যেই বিজয় মাল্য, মেহুল চোক্সি, নীরব মোদির মতো শিল্পপতিরা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা নীরবে হজম করে বিজেপি সরকারের সহযোগিতায় বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন৷ পুঁজিপতিদের থেকে কালো টাকা উদ্ধার আসলে জনগণকে ভোলানোর গল্প৷ ভোট এলেই প্রতিবার এমন গল্প শোনা যায়৷ আগে এই গল্প বলত কংগ্রেস, এখন শোনা যাচ্ছে বিজেপির থেকে৷ এরা পুঁজিপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স ছাড় দেয়, অথচ ফসলের দাম না পাওয়া কৃষকদের কৃষিঋণ মকুব করে না৷ এই সেবার সামান্য মূল্যই বিজেপিকে দিয়েছে পুঁজিপতিরা৷
দেশের শাসক দল ও সংসদীয় বিরোধী দলগুলির সাথে দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের আর্থিক যোগ অত্যন্ত গভীর৷ তাই তারা পুঁজিপতিদের স্বার্থই রক্ষা করে চলে প্রতিনিয়ত৷ ফলে জনদরদের মুখোশ এঁটে সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরুদ্ধ নীতির প্রয়োগ ঘটিয়েই সরকার কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা করে এরা৷ এইসব দল ও নেতারা বাস্তবে সরকারে বসে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক ম্যানেজারির কাজই করে চলেছে৷ এদের মুখে জনদরদের কথা চূড়ান্ত ভণ্ডামি৷
লোকসভা নির্বাচনের বাদ্যি বাজতে শুরু করেছে৷ প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সহ সংসদীয় দলগুলির নেতারা জনসভায় প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ওড়াতে শুরু করেছেন৷ জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক সমস্ত দলেরই ভোট প্রচারের সেই জাঁকজমক কাদের টাকায় হয়, এই রিপোর্ট তা ফাঁস করে দিল ৷