‘‘মার্কসবাদ বলছে– এই যে আমাদের সমাজ, এই যে আমরা সোস্যাল বিইং, এখানে মানুষে মানুষে সম্পর্ক হল উৎপাদন সম্পর্ক। অনেকে মনে করেন, বহু পণ্ডিতেরা মনে করে, মার্কসবাদের এই কথাটা ঠিক নয়। কারণ, বাবা-মার সাথে সন্তানের সম্পর্কটা কি উৎপাদন সম্পর্ক? উৎপাদন সম্পর্ক বলতে এই মূর্খের দল মনে করছে শুধু আর্থিক সম্পর্ক। না, তা নয়। মার্কসবাদ যখন উৎপাদন সম্পর্ক বলেছে, তখন নিছক আর্থিক সম্পর্ক বলেনি। কারণ মার্কসবাদ যখন উৎপাদন কথাটা বলেছে, তখন দুই উৎপাদনের কথাই বলছে। একটা হল মেটেরিয়াল উৎপাদন বা বস্তুগত উৎপাদন এবং অপরটি হল, স্পিরিচুয়াল উৎপাদন বা ভাবগত উৎপাদন। মানুষের উৎপাদন সৃষ্টির দুটি দিক আছে – একটি তার ব্যবহারিক জীবনে লাগে, তাকে আমরা বলি মেটেরিয়াল প্রোডাকশন; আর একটি মনের খোরাক সৃষ্টি করে, যাকে আমরা বলি ভাবগত উৎপাদন। যার থেকে শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি, ভাবধারা, নীতিনৈতিকতা, ধর্ম, ঐতিহ্য, আদর্শবাদ, বিপ্লববাদ এই সবের জন্ম। এই সবই তো মনুষ্য সৃষ্ট। তাহলে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে বাঁচার তাগিদে হাতে-কলমে কাজ করতে গিয়ে দুরকম উৎপাদন করেছে, একই সঙ্গে মেটেরিয়াল প্রোডাকশন আর স্পিরিচুয়াল প্রোডাকশন। এই দুটি উৎপাদনই সে করেছে একদিকে নিজে তা ভোগ করার জন্য এবং অন্যদিকে নিজের বিকাশের জন্য – ব্যক্তির এবং সমাজের বিকাশের জন্য, সভ্যতার বিকাশের জন্য, সমাজের অগ্রগতির জন্য। কাজেই উৎপাদন হচ্ছে মানুষের ক্রিয়ার ফল, মস্তিষ্কের চিন্তাগত ক্রিয়ার ফলে ভাবগত উৎপাদন এবং শারীরিক ও চিন্তাগত ক্রিয়ার সংমিশ্রণের ফলে মেটেরিয়াল উৎপাদন।
যাই হোক, উৎপাদন সম্পর্ক বলতে মার্কসবাদ বলতে চেয়েছে একটি মূল্যবান কথা– এই সমাজ উৎপাদন করার প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে। সকল মানুষ বাঁচার তাগিদে উৎপাদন করতে গিয়ে পরস্পর সম্বন্ধিত হয়েছে, তবেই আমরা সমাজবদ্ধ হয়েছি, তবেই আমরা সামাজিক জীব হয়েছি। তা না হলে আমাদের সাথে জন্তু-জানোয়ারের কোনও পার্থক্য নেই। আমরা শুধু একসঙ্গে থাকি বলেই আমরা সামাজিক জীব নই। তাহলে পিঁপড়েকেও তো সামাজিক জীব বলা যেত। আমরা কি পিঁপড়েকে সোসাল বিইং বলি? হাতিরাও একসঙ্গে থাকে, তাই বলে কি হাতিকে আমরা সোস্যাল বিইং বলি? আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচার তাগিদে সম্মিলিতভাবে উৎপাদন করছি, এক সঙ্গে উৎপাদন করছি এবং একত্রে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সচেতনভাবে লড়াই করতে গিয়ে উৎপাদনের জন্ম দিচ্ছি, উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলছি। এই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়াতেই আমরা সামাজিক জীব।
তাই উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে, উৎপাদনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইতিহাসের বিকাশের কোনও স্তরেই এবং কোনও সময়েই মানুষ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। সমাজবদ্ধ মানুষ সমাজে বাস করবে আর উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক থাকবে না, তা হলে এই সম্পর্কটা তার কী ধরনের? সে সক্ষম হতে পারে, অক্ষম হতে পারে, আংশিক বুঝতে পারে, অর্ধসত্য আবিষ্কার করতে পারে, পুরো সত্য আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু সে বুঝুক আর না বুঝুক, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তার সম্পর্ক বোঝা না বোঝার উপর নির্ভর করবে না। ইট ইজ ইন্ডিপেন্ডেন্ট অফ হিজ আন্ডারস্ট্যান্ডিং। হি ক্যান নট বাট এস্ট্যাবলিশ সাম সর্ট অফ রিলেশন উইথ এগজিস্টিং প্রোডাকশন সিস্টেম। সেজন্যই বলছিলাম, হোয়াট ইজ দ্যা অনারেবল ওয়ে অফ লিডিং আওয়ার লাইফ? কেউ যদি মনে করে আমি মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন করব, আমি কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই, কাউকে শোষণও করব না, জুলুমও করব না, আমি শুধু ডাক্তারি করব, না হয় শুধু মাস্টারি করব। তা হয় না কি? এ হয় না, হতে পারে না। আমি কি জানি মেডিকেল প্রফেসনে কাউকে ঠকাবো না ভেবে ডাক্তারি করতে গেলেও আমি মানুষকে না ঠকিয়ে প্রফেসনে এক পাও এগোতে পারি না। কাজেই অনারেবল ওয়ে অফ লাইফ লিড করার এসব উপায় নয়। আবার এই সবগুলোই মানব কল্যাণের কাজে আমি লাগাতে পারি। মাস্টার তার শিক্ষা দেওয়ার কাজটাকে, ডাক্তার তার চিকিৎসা করার কাজকে, ইঞ্জিনিয়ার তার যন্ত্রবিজ্ঞান ব্যবহার করার কাজকে হিউমিলিয়েশন থেকে মুক্ত করে সমাজপ্রগতির কাজে লাগাতে পারে যখন বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্রগতির সহায়ক ও পরিপূরক অর্থে তার ব্যবহার হবে। তখনই সে এটা একমাত্র পারে। বাকিটা হল সে চাক বা না চাক, কনশাসলি বা আনকনশাসলি, ডায়রেক্টলি বা ইনডায়রেক্টলি সার্ভিং দ্য এক্সপ্লয়টেটিভ সিস্টেম, প্রফিট মেকিং মোটিভ অফ দ্য সোসাইটি। এগজিস্টিং সোসাইটির সোস্যাল সেটআপ, মেন্টাল মেকআপ, তার মানসিকতা; তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তার ধ্যানধারণার যত বিচিত্র রকম রূপ– তা হল মানুষকে অ্যাপলিটিক্যাল করার জন্য। যে সংগ্রামে সমাজ একমাত্র পাল্টাতে পারে, যে সংগ্রামের দ্বারা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পাল্টাবে, এই জগদ্দল পাথর হটানো যাবে, যে সংগ্রাম দ্বারা সমাজের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন হতে পারে, প্রগতি আসতে পারে, সেই সংগ্রামটাকে বুর্জোয়ারা যেমন সরাসরি বিরুদ্ধতা করে, আবার অন্য নানা কৌশলেও বিরুদ্ধতা করে। রাজনীতির কথা সে একদম বলছে না, কিন্তু এমন সব ধ্যান ধারণা সে চালু করছে, এমন সব দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিচ্ছে, এমন সব নীতিনৈতিকতার ধারণা সৃষ্টি করছে, এমন সব ফিলানথ্রপিক সমাজসেবার ধারণা সৃষ্টি করছে, যার দ্বারা মানুষের সমাজের প্রতি কল্যাণ করার মনোভাব বিপ্লবমুখী না হয়ে ফিলানথ্রপিক রামকৃষ্ণ মিশন বা মিশনারীদের মূর্তি হয়ে বিপ্লবের পথটাকে আটকে দেয়। তেমন ডাক্তারের, ইঞ্জিনিয়ারের, মাস্টারমশাইদের মনোভাব কিছু সমাজসেবা আর উদার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে আটকে পড়ে থাকে, অর্থাৎ সমাজবিপ্লবে যেন না যায়। যেখানে সরাসরি সমাজবিপ্লব খারাপ বলা চলে সেখানে তাই বলছে, যেখানে সমাজবিপ্লবের কথা খারাপ বলে লোকজনদের আটকানো যাবে না, সেখানে বলছে মানুষের সেবা করাও তো একটা কাজ। এটা না হয় না পারো, ওটা করো। অর্থাৎ আসল কথা হচ্ছে, যে বিপ্লবের মাধ্যমে, যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমাজের পরিবর্তন হবে, যে কোনও কৌশলে যে কোনও নীতি, যে কোনও আদর্শের কথা বলে, যে কোনও তত্ত্ব আউড়ে মানুষকে যতদূর সম্ভব তার থেকে বাইরে রাখার কৌশল। কাজেই, এই যে সব থিওরি, আমি সেবা করব, আমি মড়া পোড়াবো, আমি দুঃস্থ মানুষকে খেতে দেব, আমি যদি পয়সা-টয়সা রোজগার করি, তবে আর কিছু পারি না পারি গ্রামের গরিব মানুষদের মুখে তো দুটো অন্ন তুলে দিতে পারি। এটাও তো একটা কাজ। হ্যাঁ, খুব বড় কাজ। আমরাও করি, কিন্তু বিপ্লবীরা এই কাজটা করে মানুষকে বাঁচাবার জন্য বিপ্লবের সহায়ক সংগ্রাম অর্থে। বিপ্লবকে কাউন্টারপোজ করে নয়। বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি একটা আন্দোলনের অর্থে নয়। সেই জন্য বিপ্লবীদেরও অনেক সময় রিলিফ ওয়ার্ক করতে হয়। এই ধরনের কাজ বিপ্লবীরা করে এই অর্থে। আবার অনেকেই করে, ছেলেদের একটা স্পোর্টসের বন্দোবস্ত করে দেওয়া, লাইব্রেরি করে দেওয়া, ডনখানায় শরীরচর্চা করার ব্যবস্থা করে দেওয়া। তা শরীর ভাল হয়ে কী হয়, তারপর গোপাল পাঁঠার দল তাদের টেনে নেয়। ডনবৈঠক করে সব যখন তাগড়াই হল, বুকের ছাতি মেপে দেখলো তৈরি হয়েছে, তখন আমাদের দেশে সব ক্ষমতাশীল দল রয়েছে তারা সব টেনে নিচ্ছে তাদের দিকে যাও, কিছু পয়সা পাবে। তার দ্বারা কী কাজ হচ্ছে, বুকের ছাতি বেড়েও কিছু লাভ হয় না। আসল কথা হচ্ছে, যে কারণের জন্য সবল সুস্থ করে যুবকদের গড়ে তুলতে হবে, সেটাতো বিপ্লবী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য। তাহলে সেই বিপ্লবী সংগ্রাম থেকে খানিকটা পথভ্রষ্ট করার জন্য অনেক রকমের রাস্তা ওরা বের করে। কোথাও রামকৃষ্ণ মিশনের সেবার কাজ মানে সেবাধর্ম, কোথাও স্কুল, কোথাও ফিলানথ্রপিক অ্যাটিচিউড, কোথাও ভূদান, কোথাও এটা, কোথাও সেটা। কোথাও একজন মনে করল আর কিছু না পারি অন্তত একটা দানখয়রাত করে কিছু গরিব মানুষের কিছুটা উপকার করছি, লোকগুলো বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে বিনা পয়সায় তাদের চিকিৎসা করছি। আমি তো আর কিছু পারছি না। এই কাজটা করছি। একবারও ভাবছে না যে আপনি অন্য কিছু করতে পারছেন না, এ কথাটা এভাবে ধরলেন কেন? যে লোকের এতখানি ত্যাগ করার শক্তি, তার দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক হলে সে কি বিপ্লবী আন্দোলনের সহায়ক কাজ করতে পারত না? না আপনি ধরে নিয়েছেন, এই দান খয়রাত করাটা একটা মহৎ কাজ। হ্যাঁ, এটা একটা মহৎ কাজ। এইভাবে গরিবদের সঙ্গে থাকা, তাদের কথা শোনা, তাদের উপকার করা মহৎ কাজ, যদি এই কাজের দ্বারা তাদের এডুকেট করতেন যে তোমাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার দরকার। তোমাদের সংঘবদ্ধ হয়ে এই সমাজের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আনার জন্য বিপ্লবী দল গঠন করা দরকার। গরিব মানুষের মুখে অন্ন জোগাতে গিয়ে, সেবা করতে গিয়ে যদি এই কথাগুলো বলতেন এবং এই সংগঠন জনতার মধ্যে গড়ে তুলতেন, তাহলে এই কাজটা ছিল যথার্থ কাজ। তাহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা নয় – বিপ্লবের সহায়ক কাজ, বিপ্লবের উপকারী কাজ হতো। তা এই সমাজে আমরা চাই বা না চাই, উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করে আমরা কোনও মতেই চলতে পারি না। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক আমাদের খাওয়া-পরা, নীতিনৈতিকতা, ধ্যান ধারণা যা কিছু আমরা লালন পালন করি, শোষক শ্রেণির স্বার্থের অনুকূলে যেগুলো এই সমাজে রয়েছে, আমরা যদি সেগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হই এবং সেগুলোকে নিতে থাকি উইদাউট অ্যাটেম্পটিং টু ব্রিং অ্যাবাউট এ চেঞ্জ অফ দ্য সোসাইটি, তবে আমরা জেনে হোক, না জেনে হোক, পুঁজিবাদী স্বার্থেরই পৃষ্ঠপোষকতা করি। ফলে এখানে আমি কমপ্রোমাইজ করছি। আমি এইরকম মনে করি না যে, মালিক আমাকে যে পয়সাটা দিচ্ছে, প্রভু আমাকে যে পয়সা দিচ্ছে, গোলামের মনোভাব থেকে আমি সে পয়সাটা নিচ্ছি না। আমি জানি, আমি ডিপ্রাইভড। আমি জানি আমাকে এক্সপ্লয়েট করা হচ্ছে। আমি জানি আমার ন্যায্য হক চুরি করে, ফাঁকি দিয়ে, নানা কৌশলে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। আমি সেইজন্য এনগেজড ইন পুটিং অ্যান এন্ড টু দিস এক্সপ্লয়টেশন। এই সংগ্রামে আমি যদি নিয়োজিত না থাকি তবে আমি একজন আনকনসাস ওয়ার্কার, যে ওয়ার্কার হয়েও, এক্সপ্লয়েটেড হয়েও ইনস্ট্রুমেন্টাল ইন মেনটেনিং এন্ড স্ট্রেনদেনিং দ্য ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেম হয়েছি। ওয়ার্কার হয়ে কাজ করে আমি শোষিত বলেই যে পুঁজিবাদী সমাজকে সার্ভ করছি না, তা নয়। একমাত্র ক্লাস কনসাস ওয়ার্কার যে এক্সপ্লয়টেশনের স্বরূপ আন্ডারস্ট্যান্ড করে এবং তাকে দূর করার জন্য শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলে, বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করে, সেই মজুর গোলামির মনোভাব থেকে মুক্ত। সে মজুর বাস্তবে মালিকি ব্যবস্থার অবসানের সংগ্রামে নিয়োজিত আছে বলে সে কিন্তু হিউমিলিয়েশন থেকে মুক্ত। সে ক্যাপিটালিজমকে সার্ভ করছে না। সে সোসাল প্রগ্রেসের আন্দোলনকে সার্ভ করছে। ফলে সে ক্লাস কনসাস।”
‘বিপ্লবী জীবনই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাময়’ বই থেকে