মহা আড়ম্বরে সম্পন্ন হল রাজ্যের তৃণমূল সরকার আয়োজিত ষষ্ঠ বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন (বিজিবিএস)। এই সম্মেলন ঘিরে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকারের প্রত্যাশা থাকার কথা– যদি কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যদি শিল্পে কিছুটা জোয়ার আসে। এই প্রত্যাশা ও সম্ভাব্য প্রাপ্তি সামনে রেখে কিছু বিষয় ভাবা জরুরি।
এই সম্মেলনে এ দেশ ছাড়া আরও ৪২টি দেশের শিল্পপতিদের উপস্থিতিতে ৩.৪২ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ আসার কথা শোনা গেছে। এই বিনিয়োগের হাত ধরে প্রায় ৪০ লক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। যদি এটা সত্যি হয় তা হলে প্রায় ২ কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হতে পারেন। তাঁদের মুখে হাসি ফুটতে পারে।
কিন্তু তাল কেটে দিচ্ছে আগের পাঁচটি শিল্প সম্মেলনের অভিজ্ঞতা। রাজ্য সরকারের দাবি, সেগুলিতে প্রায় ১২.৩৫ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু তার মধ্যে কতটুকু বাস্তবে এসেছে, কটা শিল্প হয়েছে, কতজন কাজ পেয়েছে, সবটাই ধোঁয়াশা। এসব নিয়ে সরকারের কোনও বক্তব্য নেই। বিগত ১৫-২০ বছরে রাজ্যে উল্লেখ করার মতো বড় শিল্প কিছু হয়নি। গত ডিসেম্বরে কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালের মর্গে ডোমের ছ’টি শূন্যপদের জন্য আবেদনপত্র জমা পড়েছিল প্রায় আট হাজার। যোগ্যতামান অষ্টম শ্রেণি পাশ হলেও প্রার্থীদের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাও ছিলেন। তা হলে কর জর্জরিত মানুষের দেওয়া রাজকোষের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শিল্প-সম্মেলন থেকে বাস্তবে কী পাচ্ছে রাজ্যবাসী?
শিল্পের নামে এই সম্মেলন কার্যত স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাকে পুরোপুরি বাণিজ্যে পরিণত করার রাস্তা আরও সুগম করল। জানা গেছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বেসরকারি সংস্থা। তারা মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ করবে, আবার সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পিপিপি মডেলে চিকিৎসা ব্যবসায় নামবে। মেডিকেল শিক্ষার পরিকাঠামো বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু যে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবার তা হল, বেসরকারি পুঁজি স্বাস্থ্য ব্যবসাতে নামবে সর্বোচ্চ মুনাফা করতেই। ফলে চিকিৎসার খরচ বাড়বে অত্যধিক। ইতিমধ্যে চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, চিকিৎসা করাতে গিয়ে একটা বিরাট অংশের মানুষকে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে হচ্ছে। আরেকটি সংকটও আছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশিরভাগ বেসরকারি কলেজগুলির মান সারা ভারতেই সরকারি কলেজের তুলনায় খারাপ। সেখানে পড়াশোনাও যেমন অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ, তেমনি চিকিৎসাও। এতে সাধারণ মানুষের লাভ হবে? বরং এখন যতটুকু সরকারি চিকিৎসার সুযোগ আছে, মেডিকেল শিক্ষার পরিকাঠামো আছে, সেটাও ধীরে ধীরে বেসরকারি হাতে গেলে মানুষ হারাবে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার। শিল্প সম্মেলন এই বিপদই বাড়িয়ে দিল।
শিল্প সম্মেলনের নামে শিক্ষার বেসরকারিকরণের দরজাও খুলে দেওয়া হল। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালের মালিক শিক্ষাক্ষেত্রে ২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা জানিয়েছেন। আদানি গোষ্ঠী শিক্ষায় বিনিয়োগ করবে বলে শোনা যাচ্ছে। সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তৃণমূল শাসনে গত ১১ বছরে রাজ্যে পাঁচ শতাধিক বেসরকারি স্কুল তৈরি হয়েছে। যা তিনি বলেননি তা হল, এই সময়ে একটিও সরকারি স্কুল তৈরি হয়নি এবং বেসরকারি শিক্ষার সুযোগ করে দিতে অনেকদিন ধরেই তাঁরা সুকৌশলে সরকারি শিক্ষার বেহাল অবস্থা তৈরি করেছেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের লক্ষ্যও শিক্ষার বেসরকারিকরণ। মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের যত বিরুদ্ধতা করুক, রাজ্যের তৃণমূল সরকার এই সম্মেলনে তাদের সেই লক্ষ্যকেই আরও পোক্ত করল। কিন্তু ব্যয়বহুল বেসরকারি শিক্ষা মানুষ কিনতে পারবে কেমন করে, সে প্রশ্ন ভাবায়নি সরকারি কর্তাদের।
দেখা যাচ্ছে, শিল্পের স্লোগান শাসক দলগুলির কাছে লোক-ঠকানোর কৌশল মাত্র। রাজারহাটে রাজ্যপাল যখন এই শিল্প সম্মেলন উদ্বোধন করছেন, ঠিক সেই সময় রাজ্য বিজেপির সভাপতি সিঙ্গুরে গিয়ে কৃষকদের বললেন, ‘এ রাজ্যে বিজেপি সরকার হলে, কৃষকেরা যদি চান, তা হলে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে শিল্প করে দেখাব’। এমন আশ্বাস সিঙ্গুরের মানুষ বহু শুনেছেন। কিন্তু সিঙ্গুর থেকে টাটার ন্যানো মোদির রাজ্য গুজরাটের সানন্দে গিয়ে আঁতুড় ঘরেই কেন মরে গেল তা অবশ্য তিনি বলেননি। কিন্তু যে জিনিসটি বেরিয়ে এল, শিল্পায়নের স্লোগান কারও ক্ষমতায় আসার, কারও ক্ষমতায় থাকার মোক্ষম চালাকি।
বিজেপিও গুজরাটে ঘটা করে কয়েক বছর পর পর শিল্প সম্মেলন করে। সেখানেও লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব শোনা যায়। শেষপর্যন্ত কী হয়? কতজন প্রকৃতই কাজ পায় সেখানে? এ সব প্রশ্নের উত্তরে মেলে শুধু দীর্ঘ নীরবতা অথবা দেশদ্রোহী তকমা। তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে গুজরাটে বন্ধ হয়েছে ২ হাজার কারখানা। ‘২১ সালে ঝাঁপ ফেলেছে আরও ১৯৩৮টি সংস্থা (ইকনমিক টাইমস, ৮ ফেব্রুয়ারি, ‘২২)। সারা দেশে ২০১৯ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে ৬ লক্ষ ৮০ হাজার সংস্থা। ২০২২-এর জানুয়ারিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া সংস্থার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ লক্ষ ৩০ হাজার (স্ট্যাটিকস্টিকস.কম এবং ইন্ডিয়া সিএসআর.ইন)।
এ রাজ্যের পূর্বতন সিপিএম সরকারও শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখাত। যদিও তাদের শাসনের শেষ লগ্নে রাজ্যে ছোটবড় ৫৬ হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাজ্য সরকারের স্টেট অব এনভায়রনমেন্ট রিপোর্ট ২০২১ বলছে, বাংলায় ২০১৬ থেকে ‘২১-এ ২১ হাজার ৫৪১টি শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বড় শিল্প বন্ধ হয়েছে ২৭১টি।
কেন এই সাড়ে ২১ হাজার শিল্পে ঝাঁপ পড়ল? এক সময় প্রচার ছিল জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জন্য বাংলা থেকে শিল্প পালিয়েছে। কিন্তু এখন শিল্প বন্ধ হচ্ছে কেন? এখন তো আন্দোলন নেই! সিপিএমের কায়দাতেই তৃণমূলও ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে কব্জা করে শ্রমিক আন্দোলনকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সিটু সহ বামপন্থী নামধারী ট্রেড ইউনিয়নগুলি ৩৪ বছর ধরে সিপিএম সরকারকে রক্ষা করতে গিয়ে আন্দোলন ভুলে গিয়েছে। তৃণমূল সরকার ও দল বনধ, ধর্মঘটের বিরুদ্ধে প্রায় জেহাদ ঘোষণা করেছে। সরকার ধর্মঘটকারীদের শাস্তি দেওয়ার ফরমান জারি করেছে। সিপিএম আমল থেকেই কথা চালু হয়েছে– পশ্চিমবঙ্গে এখন শ্রমিকরা নয়, দাবিসনদ দেয় মালিকরা। তা হলে কীসের ভয়ে শিল্প পালাল? শ্রমিকদের আন্দোলনের জন্য শিল্প পালায়, এটা নেতাদেরই লোক ঠকানো মিথ্যাচার। আসলে এর মধ্য দিয়ে আড়াল করা হয় শিল্পে লাল বাতি জ্বলার আসল কারণ।
সেই কারণটা কী? আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি, এর পিছনে আসল কারণ হল মন্দা– মানে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। এই মন্দা পুঁজিবাদী শোষণের ফল। মন্দা আজ এত ভয়াবহ যে, পুঁজিপতিরাই তা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। শিল্পমহল স্বীকার করে দেশের সর্বত্র লগ্নির খরা (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ এপ্রিল, ‘২২)। অর্থাৎ বাংলাতেই শুধু শিল্প হচ্ছে না তা নয়, বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম বা অন্যান্য আঞ্চলিক দল শাসিত সব রাজ্যেরই এক চিত্র। জনগণের এই ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন সরকার নানা খয়রাতি প্রকল্প চালালেও সমস্ত পণ্যের তীব্র মূল্যবৃদ্ধি তা আরও নামিয়ে দিচ্ছে। দেশের সিংহভাগ মানুষের ধসে যাওয়া ক্রয়ক্ষমতাকে ভিত্তি করে শিল্পায়ন হতে পারে না। পুঁজিবাদী শোষণমূলক ব্যবস্থা মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে নামিয়ে দিয়ে শিল্পায়নের সামনে একটা মারাত্মক সংকট হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাধা না সরিয়ে শিল্পায়ন হতে পারে? সর্বোচ্চ মুনাফার দিকে তাকিয়ে উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর অল্প কিছু কল-কারখানা হতে পারে। কিন্তু এরই পাশে শিল্প যেমন বন্ধ হচ্ছে তা হতেই থাকবে। ক্রমাগত শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে দেশের অধিকাংশ পরিবারের কেনার ক্ষমতা চলে যেতে থাকবে। আরও বাড়তে থাকবে বন্ধ কল-কারখানার সংখ্যা।
এই অবস্থায় বছর বছর যত ঘটা করেই শিল্প-সম্মেলন হোক না কেন, তার জাঁক-জমকটুকুই সার। ফলের আশা বৃথা।