জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি টানা ছ’দিন ধরে ধর্মঘট চালালেন ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী, আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে৷ তাঁদের দাবির প্রতি ছাত্র–ভিভাবক–সাধা মানুষের ব্যাপক সমর্থন এবং আন্দোলনকারীদের সংগ্রামী মেজাজ দেখে সরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় বেশ কিছু দাবি মেনে নিতে৷ অবশেষে গত ২৩ জানুয়ারি আবার স্কুলের কাজে ফিরেছেন আন্দোলনকারীরা৷
পড়ানোর কাজ বন্ধ রেখে কেন শিক্ষকরা আন্দোলনের পথে? দরিদ্র, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়ে কর্পোরেট পুঁজির হাতে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার অবাধ অধিকার তুলে দেওয়ার যে পরিকল্পনা চালাচ্ছে মার্কিন সরকারি কর্তৃপক্ষ, তা রুখতেই পথে নেমেছেন শিক্ষকরাও৷ পুঁজিমালিকদের স্বার্থে সরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামো ব্যবহার করে বেসরকারি স্কুল–ব্যবসার রমরমা ঘটাতে চান সেখানকার সরকারি স্কুল বিভাগের জেলা কর্তৃপক্ষ এবং সুপারিনটেন্ডেন্ট৷ তাই গত কয়েক বছর ধরেই এঁরা সরকারি স্কুলগুলির উন্নয়নে কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না৷ ফলে সরকারি সুক্লের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন বৃদ্ধির দীর্ঘদিনের দাবিতে কান না–দেওয়াই শুধু নয়, প্রয়োজনীয় সংখ্যায় সর্বক্ষণের স্থায়ী শিক্ষাকর্মী নিয়োগেও এঁরা রাজি হচ্ছেন না বছরের পর বছর ধরে৷ সরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যাও যথেষ্ট কম৷ ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার মান৷ এই দিকগুলিতে নজর না দিয়ে স্রেফ কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সেখানকার স্কুল–কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত সরকারি স্কুলশিক্ষার বেসরকারিকরণের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ সরকারি সুক্লের জন্য বরাদ্দ টাকা বেসরকারি স্কুলগুলিকে পাইয়ে দেওয়া এবং সরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামো শিক্ষা–ব্যবসার জন্য ব্যবহার করতে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এঁরা ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিচ্ছেন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ভিত৷ ফলে বিপদের মুখে পড়েছে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও মূলত অশ্বেতাঙ্গ ছাত্রছাত্রীরা৷ শিক্ষার অধিকার হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের হাত থেকে৷ পরিস্থিতির ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে ১৮ জানুয়ারি আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সমর্থনে ডাকা সাংবাদিক বৈঠকের বক্তব্যে৷ তাঁরা বলেছেন, বেসরকারি স্কুল গড়ে তোলার এই অপচেষ্টার দ্বারা অশ্বেতাঙ্গ, মেহনতি মানুষের সন্তানদের কাছ থেকে শিক্ষার সুযোগ ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে৷ দীর্ঘ সময় ব্যয় করে দূরবর্তী স্কুলে পড়তে যেতে হচ্ছে তাদের৷ স্থায়ী ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বদলে নিয়োগ করা হচ্ছে অস্থায়ী, অদক্ষ শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে, যার কুফল বর্তাচ্ছে ছেলেমেয়েদের ওপর৷ তিনি মন্তব্য করেন, শুধু লস অ্যাঞ্জেলেসে নয়, গোটা দেশ জুড়ে শিক্ষকদের জীবনধারণের উপযুক্ত বেতন না দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা নিয়ে ব্যবসার এই অপচেষ্টার পিছনে রয়েছে পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার বাসনা৷ পুঁজিবাদ চায় না শ্রমিকরা শিক্ষিত হোক৷ তার প্রয়োজন সস্তা শ্রম ও চটজলদি মুনাফা৷ সেই লক্ষ্যে উন্নত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে৷
এর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদে পথে নেমেছিল শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে সংগঠন ইউটিএলএ (ইউনাইটেড টিচার্স লস অ্যাঞ্জেলেস)৷ দাবি আদায়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন তাঁরা৷ প্রবল বৃষ্টি–বাদল উপেক্ষা করে ধর্মঘটের ছ’টি দিন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী৷ ছিল প্রবল জনসমর্থন৷ সাধারণ মানুষ, অভিভাবকরা ছাড়াও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে পথে নামেন৷
আন্দোলনকারীদের দৃঢ়তা ও জনসমর্থন দেখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় লস অ্যাঞ্জেলেস স্কুল–কর্তৃপক্ষ৷ দাবি মেনে নিয়ে পূর্ণ সময়ের স্থায়ী ও প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা৷ শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্লাসগুলিতে ছাত্রসংখ্যার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিতে রাজি করানো গেছে তাঁদের৷ অভিবাসী পরিবারগুলি থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সরকারি আইনগত সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও আদায় করে নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা৷ আরও একটি উল্লেখযোগ্য দাবি আদায় হয়েছে এই আন্দোলনে৷ যেসব এলাকায় স্কুলের সংখ্যা কম, সেখানে ৩০টি সরকারি স্কুল তৈরির প্রতিশ্রুতি মিলেছে যেগুলির আয়–ব্যয় ও অন্যান্য নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অংশ নেবেন ইউটিএলএ–র সদস্য শিক্ষকরা৷ এর ফলে উপকৃত হবে লস অ্যাঞ্জেলেসের দরিদ্র অশ্বেতাঙ্গ পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা৷
এতগুলি দাবি আদায় হওয়া সত্ত্বেও লড়াইয়ের পথ ছাড়তে রাজি নন ইউটিএলএ–র সদস্যরা৷ যতদিন বেসরকারি স্কুলগুলিকে সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো ব্যবহার করতে দেওয়া হবে, ততদিনই বিপদের আশঙ্কা থেকে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা৷ আন্দোলনকারীদের অনেকেরই দৃঢ় প্রত্যয়– লস অ্যাঞ্জেলেসের এই আন্দোলন গোটা আমেরিকা জুড়ে শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে ন্যায্য দাবি আদায়ের লড়াইয়ে প্রেরণা দেবে৷
আন্দোলনের জয় উপলক্ষে ডাকা এক সাংবাদিক সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষক রন গচেস বলেছেন, ‘‘আমাদের দাবি ন্যায্য বলেই ছাত্র–অভিভাবক সহ সমস্ত সাধারণ মানুষকে আমরা পাশে পেয়েছি৷ আমাদের এই লড়াই শুধু শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে স্বার্থে নয়, গোটা দেশে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই এই আন্দোলন৷ আমরা বুঝি, কেন ধনকুবের পুঁজিপতি শ্রেণি সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে৷ আসলে খেটে খাওয়া মানুষকে চিরদিন পায়ের তলায় রেখে দিতে গেলে যে মৌলিক ক্ষেত্রগুলিকে তাদের ধ্বংস করা প্রয়োজন, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা তার অন্যতম৷ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হেরে গেলে আমাদের চলবে না৷ শ্রমিক শ্রেণির শিক্ষার অধিকার রক্ষা করতে আমরা বদ্ধপরিকর৷’’
দেখা যাচ্ছে, শুধু ভারতে নয়, বহু ভারতীয়ের কাছে স্বপ্ণের ‘সব পেয়েছির দেশ’ আমেরিকাতেও পুঁজিপতিদের মুনাফা লুটের নির্লজ্জ লালসা ও তার পিছনে ধামাধরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার বিরুদ্ধে শিক্ষার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে খেটে–খাওয়া মানুষকে মার্কিন শিক্ষকদের আন্দোলনের এই জয় ভারতেও শিক্ষার ওপর সরকারি আক্রমণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে অনুপ্রেরণা জোগাবে৷