জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২০ প্রস্তুত করেছিল যে কস্তুরীরঙ্গন কমিটি, তাদের বক্তব্য ছিল–আমরা এই শিক্ষানীতির মধ্যে সমস্ত কিছুই নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে চেয়েছি, যা একুশ শতকের শিক্ষার আশা–আকাঙক্ষা ও লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে৷ শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষানুরাগী জনসাধারণ যাঁরা তলিয়ে ভাবেননি এই ‘একুশ শতকের আশা–আকাঙক্ষা’ কথাটার মানে ঠিক কী, আজ তাঁরা উদ্বিগ্ণ এই শিক্ষানীতির রূপ দেখে৷
একচেটিয়া পঁজিপতিদের আজ্ঞাবহ নরেন্দ্র মোদির পরামর্শদাতা আরএসএসের চিন্তাবিদদের আঁতুডঘরে প্রস্তুত এই শিক্ষানীতির মোডকের মধ্যে রয়েছে বাছাই করা বেশ কিছু চমকদার শব্দবন্ধ৷ এই শিক্ষানীতি নাকি ভারতকে ‘গ্লোবাল সুপার পাওয়ার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে৷ ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গঠনের একটা উচ্চতায় জাতিকে পৌঁছে দেবে৷ অনেকেই এসব শুনে গর্ব অনুভব করতেই পারেন৷ ভাবতেই পারেন, কোটি কোটি হতাশাগ্রস্ত শিক্ষিত ছাত্র– যুব–মহিলা, আপামর জনসাধারণের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আবার কী আছে? কিন্তু না, এইসব শব্দবন্ধের আড়ালে লুকিয়ে ভয়ঙ্কর সব পরিকল্পনা৷ ইউজিসিকে দিয়ে একটা পর একটা সার্কুলার জারি করানো হচ্ছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান সহ জ্ঞানচর্চার যে প্রক্রিয়া আজও এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে যতটুকু রয়েছে তাকে অবলুপ্তির দিকে পাঠানো হবে৷ এক কথায় ভারতীয় নবজাগরণের মনীষী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গডে ওঠা জনসাধারণের টাকায় গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থাকে সংকুচিত করতে করতে ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়ার মারাত্মক পরিকল্পনা পাকা করে ফেলা হয়েছে৷ শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ সম্পূর্ণ করতে, পঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে শিক্ষাকে নিয়ে আসতে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে লাটে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গডে ওঠা সরকারি কোষাগারের একটা ভাল পরিমাণ অংশ যেখানে শিক্ষাখাতে ব্যয় করা, শিক্ষান্তে কাজ দেওয়ার যে দায়িত্ব জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের ছিল, তাকে সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে৷ এরই পোশাকী নাম ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গঠনের শিক্ষা৷ অতীতে যে ভারত অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সাহিত্যে, বিজ্ঞানে বিশ্বের কাছে সম্মানজনক স্থান অর্জন করেছিল, এই ‘গ্লোবাল সুপার পাওয়ার’ গড়ে তোলার লক্ষ্য কিন্তু তা নয়৷ এই ‘গ্লোবাল সুপার পাওয়ার’ গড়ে তোলার কারিগর হবে ভারতের মুষ্টিমেয়পুঁজিপতি গোষ্ঠী, যারা দেশের মানুষকে শোষণ করতে করতে মুনাফার পাহাড় তৈরি করেছে৷ তারা যাতে বিশ্বের দরবারে সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে পারে, তারই উপযোগী সিলেবাস, পঠন–পাঠন তৈরি করা হচ্ছে৷ তাদের আরও বেশি পরিমাণ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার৷ সেজন্য, সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে গুণগত কোনও পার্থক্য রাখা হবে না৷ প্রয়োজনে দু’ধরনের প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যার গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রাইভেট–পাবলিক পার্টনারশিপ’৷
সরকার উচ্চশিক্ষায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে কিছু তথাকথিত স্বশাসিত সংস্থার আড়াল নিয়ে৷ অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন, ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশন, নীতি–আয়োগের মতো স্বশাসিত সংস্থাগুলির স্বাতন্ত্র্যকে ধুয়ে মুছে ফেলে কিছু স্তাবক শিক্ষাবিদকে সঙ্গে নিয়ে আরএসএসের চিন্তকমণ্ডলীর তৈরি করা শিক্ষার নকশাকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার উঠে পড়ে লেগেছে৷ সেই লক্ষ্যেই ইউজিসিকে দিয়ে একটার পর একটা সার্কুলার জারি করে চলেছে৷ শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষাবিদদের যুক্ত করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নীতি নির্ধারণের যে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, তাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে সরকার স্বৈরতান্ত্রিক পথে হাঁটছে৷ অতি সম্প্রতি ইউজিসি–কে দিয়ে তৈরি করা ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউশন’ এবং ‘প্রফেসর অফ প্র্যাক্টিস’–এর সার্কুলার তাদের এই উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে দিয়েছে৷ তাতে বলা হয়েছে ২০৩০–র পরে ‘সিঙ্গেল ইনস্টিটিউশন’ বলে কিছু থাকবে না৷ সবটাই মূলত হবে ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অটোনমাস ইনস্টিটিউশন’৷ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত থাকতে হবে৷ পুঁজিপতিরা যা চাইবে সেভাবে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় চলতে না চাইলে তাদের হঠে যেতে হবে৷ সরকার সেগুলোকে টাকা দেবে না৷ স্বভাবতই সেগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে৷ সেই অনুযায়ী সমাজ মনন তৈরি করা হচ্ছে৷ যে কারণে ইতিমধ্যেই এ কথা চলে এসেছে যে, প্রথাগত শিক্ষা নিয়ে কী হবে? সরকারি চাকরি কোথায়? ছাত্ররা শিক্ষান্তে নিজেরাই নিজেদের কাজ দিতে পারবে এমন ধরনের চমক সৃষ্টিকারী নতুন নতুন কোর্স তৈরি করে ঝাঁ চকচকে ইনস্টিটিউশন গডে শিল্পপতিরা ছাত্রদের আকৃষ্ট করবে৷ ছাত্র–ভিভাবকরা সেই দিকে ছুটতে বাধ্য হবে৷ এই হল জাতীয় শিক্ষানীতির মূল চিন্তাভিত্তি৷ লক্ষ করা যাচ্ছে সরকারি প্রচারমাধ্যম সফল৷ এ বছর দীর্ঘ সময় দেওয়া সত্ত্বেও বহু কলেজে ছাত্র ভর্তি হয়েছে গত বছরের তুলনায় অনেক কম৷
অনলাইন এডুকেশন ব্যবসাকে শিক্ষার মূলধারা করার দিকে এগোচ্ছে মোদি সরকার৷ মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এডুকেশনের কথা বলতে গিয়ে তারা ঋগবেদের কথা বলছে, ৬৪ কলার কথা বলছে৷ তারপর বলছে, এই বহুমুখী পডাশুনা কেবল অফলাইন এডুকেশন দিয়ে হবে না৷ তাই অনলাইন এডুকেশন আনতে হবে৷ তারা নিয়ে আসছে ‘প্রফেসর অফ প্র্যাকটিস’৷ মানে এমন ধরনের শিক্ষক, যিনি ইন্ডাস্ট্রির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এবং সেখানে কোন ধরনের স্কিলড লেবার লাগবে তা তৈরি করার জন্য শিক্ষা দিতে পারবেন৷ সেক্ষেত্রে তাদের ইউজিসি অনুমোদিত কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও চলবে৷ তারা ছাত্রদের শেখাবেন, কী করে একই সঙ্গে কারখানার ম্যানেজমেন্ট এবং শ্রমিকের কাজ করার দক্ষতা অর্জন করা যায়৷ এভাবেই ছোট ছোট শিল্প, কলকারখানা অল্প পুঁজি দিয়ে গডে তোলা এবং তা পরিচালনা করার উপযোগী শিক্ষা ছাত্ররা তাদের কাছ থেকে নেবে৷ যেহেতু এখনকার শিক্ষকরা এই জাতীয় শিক্ষা দিতে পারবে না, তাই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা শিক্ষকদের আর প্রয়োজন হবে না৷ ফলে ‘প্রফেসর অফ প্র্যাক্টিস’–এর মধ্য দিয়ে পুঁজিপতিদের চাহিদা মতো শিক্ষক নিয়োগ হবে৷ এদের বেতন দেবে সংশ্লিষ্ট কলেজ৷ স্বভাবতই, ওই কোর্সগুলোর ব্যয়ভার বহন করতে হবে ছাত্রদেরকেই৷ সাধারণ কলা, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, বাণিজ্য বিভাগগুলি ধীরে ধীরে উঠে যাবে৷ কারণ পুঁজিপতিদের স্বার্থে গড়ে তোলা এই শিক্ষা ব্যবস্থায় এসব জ্ঞানচর্চার কোনও প্রয়োজন নেই এবং তা জাতীয় শিক্ষানীতির প্রণেতারা দেখছেন না৷
এখন নানাভাবে সার্কুলার দিয়ে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় চাপ দেওয়া হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে, জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২০ যদি কার্যকর না করা হয় তবে তাদের সমস্ত সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হবে৷ ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম অর্থাৎ ভারতীয় জ্ঞানধারা নামে যা আনা হচ্ছে তা ছাত্রদের মগজে কুসংস্কার, অন্ধতা, উগ্র জাত্যাভিমান গডে তোলার পক্ষে যথেষ্ট৷ পাশাপাশি বিজ্ঞানের নামে কিছু কারিগরি দিক শেখানো হবে৷ এভাবেই দেশে ফ্যাসিবাদের উপযোগী মনন তৈরি করতে মরিয়া কেন্দ্রের মোদি সরকার৷ আসল কথা, শিক্ষক–ধ্যাপক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ঐতিহাসিক ও বিজ্ঞানীরা এর বিপদ উপলব্ধি করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন৷