70 year 27 Issue, 23 Feb 2018
সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘মাসি গো মাসি, পাচ্ছে হাসি, নিম গাছেতে ধরছে সিম৷ হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা কাকের বাসায় বকের ডিম’৷
শিক্ষায় যে পরিবর্তন আনতে চলেছে সরকার সে সম্পর্কে সুকুমার রায়ের এই কথাটি প্রথমেই মনে পড়ে৷ ধরুন কোনও ছাত্র বলল তার সাবজেক্ট ফিজিক্স– সংস্কৃত–অ্যাকাউন্টেন্সি অথবা ফিলজফি–কেমিস্ট্রি আর রবীন্দ্র নৃত্য! শুনে আপনার কী মনে হবে? আপনি হয়তো বলবেন, এমন হয় নাকি? বিষয় নির্বাচনের একটি বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না? যার যেমন ইচ্ছা তেমন নিতে পারবে? হ্যাঁ, এরকমই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে নতুন সিবিসিএস পদ্ধতির মাধ্যমে৷
সিবিসিএস মানে চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম৷ অর্থাৎ পছন্দ ভিত্তিক ক্রেডিট পদ্ধতি৷ উচ্চ শিক্ষায় এতদিনকার প্রচলিত একেকটি বিষয়ের নম্বর ভিত্তিক মূল্যায়ন ও মান নির্ণয়ের পরিবর্তে এই নীতি চালু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এই সিবিসিএস চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গেও যাদবপুর, বিদ্যাসাগর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদ্ধতি চালুর কাজ শুরু হয়েছে৷ এ রাজ্যে স্নাতক স্তরের পড়াশুনার ক্ষেত্রে তিনটি ডিগ্রির প্রচলন আছে– অনার্স, জেনারেল, মেজর৷ একজন ছাত্র পার্ট ওয়ান, পার্ট টু, পার্ট থ্রি– এই তিনটি পরীক্ষা দিয়ে তিন বছরে ডিগ্রি লাভ করতে পারেন৷ কিন্তু সিবিসিএস পদ্ধতিতে একটি পাঠক্রম দাঁড়াবে ৬টি সেমিস্টারের৷ অর্থাৎ বছরে দুটি করে সেমিস্টার পরীক্ষা এবার দিতে হবে৷ এই পদ্ধতিতে একজন ছাত্র বা ছাত্রী তার ইচ্ছামতো যে কোনও বিষয় নিয়ে সাবজেক্ট কম্বিনেশন সৃষ্টি করতে পারবে৷ বিষয়গুলির মধ্যে পারস্পরিক সামঞ্জস্যের শৃঙ্খলা মানবার দরকার নেই৷ অর্থাৎ জ্ঞানজগতের নানা শাখার বিষয়গুলি শেখার জন্য পারস্পারিক সম্বন্ধযুক্ত এবং পরিপূরক বিষয়গুলিকে একযোগে পড়ার যে বিজ্ঞানসম্মত পাঠধারা ছিল সিবিসিএস তাকেই আঘাত করবে৷ কলেজগুলি যাতে নিজেদের ছাত্র–ছাত্রীদের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নম্বর পাইয়ে দিতে পারে তার ব্যবস্থা হচ্ছে অভন্তরীণ মূল্যায়নের নামে৷ এই পদ্ধতিতে কলেজের শিক্ষকরাই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্রের বিচার করবেন৷ এতে স্বজন–পোষণ, দুর্নীতি বাড়ার সম্ভাবনা কতটা, তার উদাহরণ গুজরাটের পিটিসি কলেজের মর্মান্তিক ঘটনা৷ এই কলেজে ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টে নম্বর কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে দীর্ঘদিন এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে৷ এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে থাকছে ক্রেডিট বিনিময় প্রথা৷ অর্থাৎ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কোনও বিষয়ে কম নম্বর পেলে নম্বর বাড়াবার জন্য অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনও বিষয়ে নাম লিখিয়ে ক্রেডিট অর্জন করে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পেয়ে যেতে পারেন৷
সরকারের যুক্তি, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা খুবই অনমনীয় এবং ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের পরিসর খুবই অল্প৷ এখানে বহুমুখী জ্ঞানার্জনের সুযোগও কম৷ সিবিসিএস পদ্ধতিতে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে পারস্পরিক ক্রেডিট ট্রান্সফার করার সুযোগ থাকায় একজন ছাত্র তার প্রথম প্রতিষ্ঠানে কোনও একটি কোর্স সম্পূর্ণ করার পর অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে সহজেই আরেকটি স্পেশালাইজ কোর্সে ভর্তির সুযোগ নিতে পারবে৷ এছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষা হয় শিক্ষককেন্দ্রিক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক– সিবিসিএস পদ্ধতি নাকি সম্পূর্ণ শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক৷ শিক্ষার্থী এখানে শেখে নিজের মতো করে, উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে৷
কিন্তু মনে রাখা দরকার কোনও বিষয়ে যথাযথ ভাবে শেখার জন্য তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কী কী বিষয় পড়া দরকার সে বিষয়ে পৃথিবীতে সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ধারণা বিদ্যমান৷ কারও মনের ইচ্ছায় বিষয়গুলির কম্বিনেশন গড়ে ওঠেনি৷ সেই সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ধারণাকে সিবিসিএস ব্যবস্থার নামে ধ্বংস করা হচ্ছে৷ ছাত্রদের শৃঙ্খলা বহির্ভূতভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামঞ্জস্যহীন কিছু বিষয় শিখতে বললে তার ফল কী দাঁড়ায়? চিন্তা প্রক্রিয়াটাই এলোমেলো হয়ে যায়৷ গভীরে গিয়ে শেখা, গবেষণা করা– সে সব তো অনেক দূরের বিষয়৷
বিস্তৃত জ্ঞানজগতের নানা বিষয়কে জানার সুযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টি করা এক জিনিস৷ আর জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াটিকেই জলাঞ্জলি দিয়ে একটি বিষয়ের নম্বরের ঘাটতি মেটানোর জন্য যাহোক করে আরেকটি বিষয়ে কিছু নম্বর পেয়ে তা যোগ করে পাশের গণ্ডি উতরে যাওয়ার সুবিধাবাদী পরিকল্পনা সম্পূর্ণ আলাদা৷ তার সাথে শিক্ষার সম্পর্ক কী? এছাড়া সেমিস্টার পদ্ধতিতে একটা পাঠক্রমকে ছোট ছোট মডিউল বা প্যাকেজে বিভক্ত করা হয়৷ এর ফলে সুসংহত জ্ঞান গড়ে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি হয়৷ কারণ প্রতিটি সেমিস্টার পরীক্ষার পর সংশ্লিষ্ট সেমিস্টার পাঠক্রম অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে৷ ছাত্ররা শেষ সেমিস্টারে পৌঁছে পূর্বতন সেমিস্টারগুলিতে যা কিছু শিখেছিল সমস্ত কিছুই ভুলে গিয়েও ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করে যেতে পারে৷ কিন্তু ভবিষ্যতে বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই শিক্ষাবিহীন পরীক্ষার নম্বর তাদের কোন কাজে লাগবে? আরও আছে, বছরে একটার বেশি পরীক্ষার অর্থই হল বেশি পরিমাণে রেজিস্ট্রেশন ফি ও পরীক্ষার ফি দিতে ছাত্রদের বাধ্য করা৷ প্রতিটি সেমিস্টারের জন্য নতুন সিলেবাস ও সেই সংক্রান্ত বইপত্র কেনার জন্যও খরচ করতে হবে অতিরিক্ত অর্থ৷ এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়নে সরকারের নজর নেই৷ উপযুক্ত সংখ্যায় শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে৷ পরিণামে ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়া, নিয়মিত ক্লাস না হওয়ার মতো ভুরি ভুরি অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে উঠেছে৷ তারমধ্যে সেমিস্টার সিস্টেম চালু হলে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় শুধু পরীক্ষা, ফিল্ড স্টাডি, প্রশ্নপত্র তৈরি, উত্তরপত্রের মূল্যায়ন – এসব কাজেই চলে যাবে৷ ফলে কোপ পড়বে শিক্ষা দিবসের উপর৷ এতে আদৌ শিক্ষার মান বাড়বে কি?
সরকার আসলে সিবিসিএসের মধ্য দিয়ে এক দেশে এক সিলেবাস এইসব কথা বলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করে শিক্ষার স্বাধীকার ধ্বংস করতে চাইছে৷ যাতে শিক্ষাবিদদের বদলে শিক্ষার দায়িত্ব বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করা যায়৷ বেসরকারি মালিকদের পরিচালিত শিক্ষা–ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা ফেল করলে মুনাফা কমে যাবে৷ তাই কি সিবিসিএস এনে পাশের সুব্যবস্থা করা? সরকার এসবের মধ্য দিয়ে বেসরকারিকরণকেই ত্বরান্বিত করতে চাইছে৷ তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সেল্ফ ফিনান্সিং কোর্স বাড়াতে বাধ্য করছে৷ শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের আগে শিক্ষক শিক্ষাবিদ, ছাত্রছাত্রী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সাথে কোন আলোচনাই করা হল না৷ এরাজ্যেও শিক্ষামন্ত্রী এই পদ্ধতি চালু করার আগে কারও কোন মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না৷ ছাত্র স্বার্থ বা শিক্ষা স্বার্থ নয়, তাঁদের সকলের লক্ষ্য শিক্ষা ব্যবসা সম্প্রসারিত করা৷ তাই বিভিন্ন সময়ে ছাত্রছাত্রীদের তারা গিনিপিগের মতো ব্যবহার করেন৷ এর ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি অদ্ভুত হযবরল ব্যবস্থার জন্ম হচ্ছে যা শিক্ষানুরাগী মানুষের কাছে খুবই উদ্বেগের৷ ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে৷