দ্বিতীয় দফার নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রথম বাজেটই দেখিয়ে দিল এই সরকার শিক্ষাকে কোন দৃষ্টিতে দেখে৷ বাস্তবে ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ এই নীতিই প্রতিফলিত হল বাজেটে৷
এ বছর বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা৷ শিক্ষা খাতে এবার বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে বলে সমানে ঢাক পিটিয়ে চলেছে সংঘ পরিবার ও প্রচারমাধ্যমের একাংশ৷ অথচ বাস্তবে গত বছরের ২.৯ শতাংশ থেকে কমে এবার শিক্ষা খাতে খরচ দাঁড়িয়েছে মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপি–র ২.৮ শতাংশ৷ বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগে ২০১৩–’১৪ সালের বাজেটে এটা ছিল জিডিপি–র ৪.৭ শতাংশ৷
খুঁটিয়ে দেখলে বেরিয়ে আসছে আরও ভয়ানক তথ্য৷ দেখা যাচ্ছে, এ বছর শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকার জোগান আসবে বাজেট বরাদ্দ থেকে৷ বাকি ৪৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা আসবে ‘মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা কোষ’ এবং ‘প্রারম্ভিক শিক্ষা কোষ’ থেকে, যা শিক্ষা সেস হিসাবে সমস্ত কেন্দ্রীয় করের সাথে জনগণের ঘাড় ভেঙে আদায় করা হচ্ছে৷ ফলে, বাজেটে শিক্ষা খাতে এবার আদৌ বরাদ্দ বাড়েনি, বরং বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে, এ কথা পরিষ্কার৷ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)–এর ২০১৭–’১৮–র বার্ষিক রিপোর্টে দেখা গেছে, শিক্ষা সেস হিসাবে আদায় করা টাকার মধ্যে ৯৬ হাজার ১৩ কোটি টাকা ব্যবহারই করা হয়নি কেন্দ্রীয় সরকার এ টাকা খরচ করে উঠতে পারেনি শিক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতা বটে! সরকার শিক্ষাখাতে সত্যি সত্যি কত ব্যয় করছে? এ প্রশ্ন উঠছে, কারণ– ‘হায়ার এডুকেশন ফিনান্সিং এজেন্সি’ বা এইচইএফএ–র মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি উন্নয়ন খাতে যে অর্থ পেয়েছে, তাদের তা শোধ করে দিতে হবে৷ সে টাকা শোধ হবে ছাত্রদের ঘাড় ভেঙে বাড়তি ফি আদায় করেই তো? অথচ ‘দেশদ্রোহী’ উপাধি না পেতে হলে মানতেই হবে নরেন্দ্র মোদির মতো শিক্ষাদরদি বিশ্বে আর হয় না দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগী মানুষ দাবি করে আসছেন, কেন্দ্রীয় বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ না করলে দেশে শিক্ষার যথাযথ প্রসার ঘটানো সম্ভব নয়৷ কিন্তু সমস্ত সরকারই বরাদ্দের পরিমাণ কমানোর সাথে সাথে শিক্ষায় সরকারি ভরতুকির পরিমাণও ক্রমে কমিয়ে দিচ্ছে৷
এবারে বাজেটে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি–র জন্য ব্যয় গত বছরের বরাদ্দ ৪ হাজার ৬০১ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৪ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা করা হয়েছে৷ একইভাবে অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন–এর বরাদ্দ ৪৮৫ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৪৫৮ কোটি টাকা৷ প্রধানমন্ত্রী একদিকে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’–এর স্লোগানে চারদিক ভরিয়ে তুলছেন, অন্যদিকে বাজেটে ‘ন্যাশনাল স্কিম ফর ইনসেনটিভ টু গার্ল চাইন্ড ফর সেকেন্ডারি এডুকেশন’ অর্থাৎ মাধ্যমিক শিক্ষায় যেতে মেয়েদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে জাতীয় স্তরের পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ গত বছর এই খাতে বরাদ্দ ছিল ২৫৬ কোটি টাকা, এবার তা নেমে এসেছে মাত্র ১০০ কোটি টাকায়৷
বর্তমানে দেশে ১০ লক্ষেরও বেশি শিক্ষক পদ শূন্য৷ অথচ এবারের বাজেটে সরকার শিক্ষক শিক্ষণ ও বয়স্ক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২০১৮–’১৯ সালের ৮৭১ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে দাঁড় করিয়েছে মাত্র ১২৫ কোটি টাকায়৷ স্কুল–পড়ুয়াদের অপুষ্টি নিয়ে অবিরত চোখের জল ঝরাতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহচরদের৷ অথচ এ বছরে বাজেটে স্কুলছাত্রদের পুষ্টিকর খাদ্য জোগানোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা মিড ডে মিলে ছাত্র পিছু বরাদ্দ বেড়েছে ১৩ পয়সা আর ২০ পয়সা৷ এই বাজেটে কোনও মেডিকেল কলেজ, আইআইটি, আইআইএম এবং গবেষণা সংস্থার মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নতুন করে তৈরির সরকারি পরিকল্পনার কথা বলা হয়নি৷ শুধু তাই নয়, যে সংস্থাগুলি রয়েছে সেগুলির দুর্দশাগ্রস্ত পরিকাঠামোর উন্নতির জন্যও কোনও অর্থ পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়নি৷
অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, শিক্ষা খাতে এই সামান্য বাজেট বরাদ্দের একটা বড় অংশ আবার ব্যয় করা হবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য৷ বাজেটে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ স্থাপনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, এই সংস্থা অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে একই দৃষ্টিতে দেখবে৷ বোঝা কঠিন নয়, এর মাধ্যমে একদিকে গবেষণার অজুহাতে জনগণের অর্থ নিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলি ব্যবসা করবে, অন্যদিকে টাকার অভাবের কথা বলে সরকারি সংস্থাগুলিতে গবেষণার কাজে ব্যাঘাত ঘটানো হবে৷
এবারের বাজেটে শিক্ষার সর্বাত্মক বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে ‘হায়ার এডুকেশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া’ (এইচইসিআই) নামে একটি স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা নির্মাণের বিষয়ে জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী৷ এ ব্যাপারে মতামতও আহ্বান করেছেন তিনি৷ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রস্তাবিত খসড়ার আকারে থাকা অবস্থাতেই জাতীয় শিক্ষানীতি–২০১৯–এর সুপারিশগুলি রূপায়ণের যে ঘোষণা সরকার করেছে, তা থেকেই শিক্ষার প্রতি তাদের অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্টসুলভ মানসিকতার পরিচয় মেলে৷ ফলে এইচইসিআই বিষয়ে মতামত আহ্বান করার বিষয়টিও যে শুধু মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যই, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷
এই শিক্ষাবিরোধী এবং ছাত্রস্বার্থবিরোধী বাজেটের তীব্র বিরোধিতা করেছে সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও৷ দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে গত ৭ জুলাই৷ শিক্ষা প্রসারের নামে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ কর্পোরেট পুঁজিমালিকদের পায়ে ঢেলে দেওয়ার বিজেপি সরকারের এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে দেশের ছাত্রসমাজ সহ সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে৷